রাঙামাটির অচেনা রঙ ‘জুরাছড়ি’
নীল জলরাশির ছোট্ট একটা ঘাটে আপনার লঞ্চ ভিড়তেই পেয়ে যাবেন সারি সারি মোটরবাইক। হাসিমুখে বাইকাররা আপনাকে স্বাগত জানাবে, যেতে হবে জুরাছড়ি বাজারের দিকে। পথের দুপাশে দেখবেন আদিবাসীদের ঘর, প্রাচীন বৃক্ষ আর সবুজের সমারোহ। দূরে দাঁড়িয়ে থাকা সারি সারি পর্বতমালায় আপনার চোখ আটকে যাবে। পাহাড়ের শরীরে সবুজ চাদর আপনাকে অভ্যর্থনা জানাবে। রাঙামাটির অচেনা রঙ ‘জুরাছড়ি’র কথা বলছি।
কোথায় জুরাছড়ি
জুরাছড়ি পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটির একটি উপজেলা। উপজেলা হলেও, এর বাজারটা বেশ ছোট। হাতে গোনা কয়েকটি দোকান। আর তারই একপাশে উপজেলা পরিষদ। জুরাছড়ি খুব একটা পরিচিত জায়গা নয়। অনেকের কাছে রাঙামাটিতে বেড়ানোর জায়গা বলতে সুবলং ঝরনা, ঝুলন্ত সেতু কিংবা নৌকায় চড়ে কাপ্তাই লেকে এক চক্কর! অথচ কাপ্তাই লেকের কোলজুড়ে বসে থাকা জুরাছড়ির সৌন্দর্যর পুরোটাই প্রাকৃতিক। মানুষের হাতে তৈরি কৃত্রিম কোনো সৌন্দর্য এখানে খুঁজে পাওয়া যাবে না। এমনকি জুরাছড়ির পথেরও যে সৌন্দর্য, তা খুবই আলাদা।
যা দেখবেন
নীলাভ লেক আর সবুজ পাহাড় বেষ্টিত জুরাছড়ির সৌন্দর্যে মুগ্ধ হবে যে কেউ। এমন দুর্গম প্রান্তিক পাহাড়ে সবসময় খুঁজে পাওয়া যায় বুনোগন্ধ আর নীরবতা। মোটরবাইক ভাড়া করে এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়, কিংবা নৌকা নিয়ে লেকের নীলাভ জলরাশির ওপর ভেসে চলা, সব মিলিয়ে অবর্ণনীয়।
ঘণ্টার পর ঘণ্টা আপনি জলরাশিতে ভাসার পর মনে চাইবে হাঁটি হাঁটি পায়ে পাহাড় বাইতে। প্রথমে মনে হবে খুব সহজেই ওঠা যাবে এসব পাহাড় চূড়ায়। কিন্তু, এর ওঠার পথ বেশ খাড়া। ভেজা শরীরেও ঘাম ঝরতে লাগবে। তবে, ক্লান্ত লেক-নদী ছুঁয়ে আসা বাতাস আপনার পাহাড় বেয়ে ওঠার কাজটাকে কিছুটা হলেও সহজ করে দিবে।
পাহাড়চূড়ায় উঠতে উঠতে দেখা যাবে দূরের ঢেউখেলানো পাহাড়ের সারি। এ যেন অন্য রকম এক শৈল্পিক রূপ। প্রশস্ত কাপ্তাই লেকের বুকে ছোট-বড় দ্বীপপুঞ্জ, সমতল ভূমিতে মানুষের ঘরবাড়ি দেখা যাবে যেন পাখির চোখে। পাহাড়ের গায়ে সারিবদ্ধ নারিকেল, গর্জন ও জারুল গাছের হাতছানি উপেক্ষা করার মতো নয়। যতই তাকিয়ে থাকবেন, মুগ্ধ হবেন।
দেশের সবচেয়ে বড় বৌদ্ধমূর্তি
এখানেই শুভলং শাখা বন বিহারে সাধনানন্দ মহাস্থবির (বনভান্তে) কমপ্রেক্স। সেখানে রয়েছে দেশের সবচেয়ে বড় বৌদ্ধমূর্তি। অনেকের মতে, দক্ষিণ এশিয়ায়ও এরচেয়ে বড় ‘শুয়ে থাকা’ বৌদ্ধমূর্তি নেই। ১২৬ ফুট সিংহশয্যা গৌতম বুদ্ধের মূর্তিটি দেখলে অবাক হতে হবে। বিহার কর্তৃপক্ষ জানায়, এত বড় ধ্যানরত বৌদ্ধমূর্তি বাংলাদেশে প্রথম। এমনকি দক্ষিণ এশিয়ায়ও এরচেয়ে বড় শুয়ে থাকা গৌতম বুদ্ধের মূর্তি আছে কি-না জানা নেই। ২০১৬ সালে এটির নির্মাণ কাজ শুরু হয়। ২০১৭ সালের জুলাইয়ে এলাকাবাসীর উদ্যোগে কায়িক শ্রমে বৌদ্ধমূর্তিটি ঢালাই দেওয়া হয়। সেসময় দূর-দূরান্ত থেকে হাজার হাজার পূণ্যার্থী অংশগ্রহণ করেন।
জুরাছড়ি রাতযাপনের কোনো ব্যবস্থা নেই। তাই লঞ্চে ফিরতে হবে রাঙামাটির পথে। ফেরার পথে মনে হবে, দুর্গমতা কীভাবে ঢেকে রাখে তার প্রকৃতির গোপন সৌন্দর্য।এই সৌন্দর্যের নিবিড় ডাকে সাড়া দিলে জীবনটা হয়ে উঠবে উপভোগ্য।
যাতায়াত
জুরাছড়িতে রাঙামাটি হয়েই যেতে হয়। রাঙামাটির রিজার্ভ বাজার থেকে লঞ্চ করেই জুরাছড়ি যেতে হয়। সারাদিনে মাত্র দুটো লঞ্চ জুরাছড়ি আসা-যাওয়া করে। সকাল সাড়ে ৭টায় ও দুপুর আড়াইটায় আরেকটি লঞ্চ জুরাছড়ির উদ্দেশে ছেড়ে যায়। ফেরার লঞ্চের সময়- দুপুর দেড়টা ও রাত সাড়ে ৮টা।
থাকা-খাওয়া
জুরাছড়ি থাকার তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই। খাওয়ার জন্যও আধুনিক কোনো রেস্তোরাঁ গড়ে ওঠেনি। তবে উপজেলা কমপ্লেক্সের পাশে মোহম্মদ আলী হোটেলে সুস্বাদু খাবার মেলে, দামও কম। যেহেতু থাকার কোনো ব্যবস্থা নেই, সেহেতু দিন যেয়ে দিনেই ফিরে আসতে হবে রাঙ্গামাটি শহরে।