প্রেম, ভালোবাসা ও ট্র্যাজেডির মাথিনের কূপ
আমরা অনেকে জানি না, টেকনাফের মাথিনের কূপের কথা। নাফ নদীর পাশে টেকনাফ থানার ভেতরে এই মাথিনের কূপ। এই কূপের সঙ্গে ভালোবাসা ও ট্র্যাজেডি দুই-ই জড়িত। এই কূপের পেছনে রয়েছে একটি মর্মান্তিক প্রেমকাহিনী। রাখাইন জমিদারকন্যা মাথিন ও ধীরাজ ভট্টাচার্যের প্রেমের স্মৃতি এই কুয়া। আমরা আগে জানতাম, এই কূপে মাথিন তাঁর ভালোবাসার মানুষের ধোঁকার কারণে ঝাঁপ দিয়ে নিজের জীবন দিয়েছিলেন।
তাই এ জন্য এই কূপের নামকরণ করা হয়েছিল। কিন্তু টেকনাফ থানার ভেতরে লেখা ইতিহাস পড়ে আমরা নতুন কিছু জানতে পারি, যা নিয়ে অনেকের দ্বিমত আছে। ঐতিহাসিক কারণে এটি আজ দর্শনীয় স্থানে পরিণত হয়েছে। প্রেমের আত্মত্যাগের নিদর্শন হিসেবে পুলিশ প্রশাসন এই জায়গাটি সংরক্ষণ করে এটিকে ‘মাথিনের কূপ’ হিসেবে নামকরণ করে। ২০০৬ সালে ধীরাজ-মাথিনের ইতিহাসের প্রায় ৮০ বছর পর কূপটির সংস্কার করা হয়।
থানার ভেতরে দেয়ালে নিম্নের লেখাটি দেওয়া আছে, যা হুবহু তুলে দেওয়া হলো :
বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকের ঘটনা। কলকাতার সুদর্শন কর্মকর্তা ধীরাজ ভট্টাচার্য অতি ভয়ংকর ও দুর্গম এলাকা টেকনাফ থানায় বদলি হয়ে আসেন। সবুজ পাহাড়ে ঘেরা টেকনাফ থানা—অদূরে সমুদ্রের নীল জলরাশি। থানায় তার তেমন কোনো কাজকর্ম ছিল না। অনেকটা এখানে সেখানে ঘুরেফিরে সময় কাটাতেন। থাকতেন থানার আধাপাকা ঘরের একটি কক্ষে। একদিন একাধিক নারী কণ্ঠের অস্পষ্ট মৃদু গুঞ্জনে ধীরাজের ঘুম ভেঙে যায়। থানার ছোট বারান্দায় এসে দেখলেন রং-বেরঙের ফতুয়া (থামি-ব্লাউস) পরিহিতা ৫০/৬০ জন মগী রাখাইন তরুণী পাত কুয়ার চারদিকে জড়ো হয়ে হাসিগল্পে মশগুল। তাদের সুউচ্চ কলহাস্যে থানার প্রঙ্গণ মুখরিত। এটাই ছিল সমগ্র টেকনাফে একটি মাত্র কুয়া। প্রতিদিন তরুণীরা পাত কুয়ায় জল নিতে আসতেন। আর ধীরাজ থানার বারান্দায় চেয়ারে বসে তরুণীদের জল তোলার দৃশ্য দেখতেন। একদিন ধীরাজের নজরে পড়ে সম্পূর্ণ নতুন সাজে সজ্জিত আরেক তরুণীকে, সুন্দরী এই তরুণীর নাক-চোখ-মুখ বাঙালির মেয়েদের মতো। নাম তার মাথিন। টেকনাফের জমিদার ওয়ান থিনের একমাত্র মেয়ে। প্রথম দর্শনেই মেয়েটিকে তার ভালো লেগে যায়। প্রতিদিন ভোর হওয়ার আগেই ধীরাজ ভট্টাচার্য্য থানার বারান্দায় চেয়ারে গিয়ে বসতেন এবং মাথিনের আগমনের প্রতীক্ষা করতেন। মাথিন যখন কলসি কাঁখে তার সুউচ্চ গ্রীবা দুলিয়ে থানা প্রাঙ্গণ দিয়ে হেঁটে আসতেন, ধীরাজ তন্ময় হয়ে সে দৃশ্য উপভোগ করতেন। অন্যান্য তরুণী আসার আগেই মাথিন পাতকুয়ায় আসতেন এবং জল নিয়ে ফিরতেন। ভোরের স্নিগ্ধ আলোয় নীরব নিস্তব্ধ পরিবেশে তারা একে অপরের সঙ্গে গভীর প্রেম ও মোহবেশে আচ্ছন্ন হয়ে থাকতেন। পরস্পর পরস্পরের দিকে চেয়ে সম্ভব-অসম্ভব নানা কল্পনার রঙিন জাল বুনতেন। দেখাদেখি, হাসাহাসি এভাবেই তাদের প্রেম ঘনীভূত হয়। দিন গড়াতে থাকে। একদিন-দুদিন এভাবে। ইতোমধ্যে দুজনের প্রেমের কথা সবাই জেনে যায়। নানা বাধা সত্ত্বেও দুজনের মধ্যে বিয়ের কথা পাকাপাকি হয়। এরই মাঝে কলকাতা থেকে বাবার চিঠি আসে ধীরাজের কাছে। ধীরাজকে কলকাতা যেতে হবে এক মাসের ছুটি নিয়ে। ছুটি না মিললে চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে হলেও যেতে হবে। ধীরাজ সিদ্ধান্ত নেন কলকাতা যাবেন। সিদ্ধান্তের কথা মাথিনকে জানানো হলো। মাথিন রাজি হলেন না। তাই অনেকটা বাধ্য হয়ে ধীরাজ এক সন্ধ্যায় টেকনাফ ছাড়ে পালিয়ে গেলেন। ধীরাজের এভাবে চলে যাওয়াকে প্রেমিকা মাথিন সহজভাবে মেনে নিতে পারেননি। মাথিনের মনে হলো, বাবার অসুখের কারণ দেখিয়ে ধীরাজ বরং বিয়ে করার ভয়েই পালিয়েছে। প্রাণপুরুষ ধীরাজকে হারিয়ে মাথিন অন্নজল ত্যাগ করে হন শয্যাশায়ী। জমিদার বাবা ওয়ান থিনসহ পরিবারের সদস্যরা শতচেষ্টা করেও মাথিনকে অন্নজল ছোঁয়াতে পারেননি। তার এককথা, ধীরাজকে চাই। প্রেমের এই বিচ্ছেদ এবং অতিকষ্টে একদিন মাথিন মারা যান। এ কারণে প্রেমের সাক্ষী মাথিনের কূপ দেখে এখনো হাজারো প্রেমিক-প্রেমিকা তাদের ঐতিহাসিক প্রেমের কথা স্মরণ করে আবেগ আপ্লুত হয়।
মাথিনের কূপের ইতিহাস
(সাহিত্যিক ধীরাজ ভট্টাচার্য্যের লিখিত যখন পুলিশ ছিলাম থেকে এই লেখাটি নেওয়া হয়েছে)
যা যা দেখবেন
টেকনাফ দেখার মতো আছে শাহপরীর দ্বীপ, আমার দেখা বাংলাদেশের সুন্দর বিচ টেকনাফ বিচ, বার্মিজ মাকেট, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় করা বাঙ্কার।
টেকনাফে থাকার মতো অনেক হোটেল ও রিসোর্ট আছে। যার মধ্যে হোটেল নাফ ও হিলটপ টাকার মধ্যে রুম পাওয়া যাবে।
টেকনাফে খাবারের জন্য অনেক রেস্টুরেন্ট আছে। এসব খাবারের দোকানে ১৩০ থেকে ১৫০ টাকার মধ্যে দুপুরের ও রাতের খাবার গ্রহণ করা যায়।
যেভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে সরাসরি টেকনাফের বাস আছে। এসি বা ননএসি দুই ধরনের বাস পাওয়া যায়। বাস থেকে নেমে হেঁটে অথবা রিকশায় টেকনাফ থানা আর থানার ভেতরে এই মাথিনের কূপ। কক্সবাজার থেকে অনেক বাস সার্ভিস আছে, ভাড়ায় জিপ পাবেন।