ঢাকার কাছেই প্রকৃতির মাঝে ১০ ক্যাম্পিং সাইট
ঘুরে বেড়ানোর সময় যারা প্রকৃতিকে অনেক কাছ থেকে উপলব্ধি করতে চান তাদের জন্য বহু প্রত্যাশিত অভিজ্ঞতা হলো ক্যাম্পিং। এই রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা প্রকৃতির বন্যতাকে সুক্ষ্মভাবে পরখ করার আমেজ দেয়। সেখানে ভয় ও উত্তেজনাকে ছাপিয়ে সরবে আবির্ভূত হয় রাতভর আড্ডা আর পূর্ণিমার আলোয় ঝিঝি পোকার ডাক। ব্যস্ততার বেড়াজাল থেকে রেহাই দিয়ে ঠিক এমনি অভিজ্ঞতা দিতে পারে ঢাকার কাছেই কিছু দারুণ ক্যাম্পিং সাইট। তাই হুট করে কোন এক শীতের সকালে ক্যাম্পিংয়ের সরঞ্জাম সঙ্গে করে বেরিয়ে পড়তে পারেন। তবে তার আগে চলুন জেনে নিই, তেমন কিছু জায়গার খোঁজ।
ঢাকার কাছেই দশটি ক্যাম্পিং সাইট
দ্য বেস ক্যাম্প বাংলাদেশ, গাজীপুর
গাজীপুরে অবস্থিত এই ক্যাম্পটি প্রথমবারের মত বেসরকারিভাবে প্রকৃতির মাঝে নির্মিত ক্যাম্প। এখানে ক্যাম্পিংয়ের পাশাপাশি ব্যবস্থা আছে রোপ সাইক্লিং, ক্লাইম্বিং, আর্চারিসহ দারুণ কিছু আউটডোর এক্টিভিটিসের। সাধারণত সেপ্টেম্বর থেকে মার্চ মাস অব্দি দ্য বেস ক্যাম্প বাংলাদেশে ক্যাম্পিংয়ের সুযোগ দিয়ে থাকে। এক্টিভিটিসগুলোর ওপর নির্ভর করে স্কুল, পরিবার অথবা করপোরেট গ্রুপগুলোর ক্যাম্পিং প্যাকেজ ভিন্ন হয়ে থাকে। বিশ জনের একটি দলের প্রতি দুই সদস্যের এখানে তাবুতে থাকার জন্য ভাড়া পড়ে আড়াই হাজার টাকা।
বৃন্দাবন রিসোর্ট, গাজীপুর
গাজীপুরের অনেকগুলো রিসোর্টের মধ্যে বৃন্দাবন রিসোর্টটি আলাদা হওয়ার মূল কারণ হলো এর প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে সাজানো স্থাপনা। তাই এটি ঢাকার ভ্রমণপিপাসুদের পরিপাটি ক্যাম্পিংয়ের ক্ষেত্রে প্রথম পছন্দ। ঢাকার থেকে মাওনা ফ্লাইওভার দিয়ে শিশুপল্লী পার হয়ে কিছুদূর সামনে গেলেই গাজীপুরের তেলিহাটি ইউনিয়নের বৃন্দাবন রিসোর্ট। পুরো যাত্রায় বাস ও রিকশায় মোট খরচ হতে পারে প্রায় ১৭০ টাকার মত। এই রিসোর্ট এরিয়ার মধ্যে ক্যাম্পিং খরচ জন প্রতি ২০০ টাকা।
নীলা বর্ষা রিভার কুইন, সাভার
পরিবার নিয়ে নৌকা ভ্রমণ ও ঘুড়ি উড়ান; সর্বপরি ক্যাম্পিংয়ের আদর্শ জায়গা নীলা বর্ষা রিভার কুইন। স্থানীয় বাসিন্দারাসহ ঢাকার ভ্রমণপ্রিয়দের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা সাভারের এই রিসোর্টটিতে পৌঁছাতে নৌকা যোগে ছোট্ট নদী পার হতে হয়। ঢাকা থেকে প্রথমে সাভার থানা স্ট্যান্ড যেয়ে সেখান থেকে মিনিট দশেক পায়ে হেঁটে ভাগলপুর ঘাট। সেখান থেকে নৌকা নিয়ে বংশী নদী পার হলেই ক্যাম্পিং সাইট।
সারিঘাট, কেরানীগঞ্জ
বিগত কয়েক বছর ধরে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা ঢাকার নিকটেই এই জায়গাটি ক্যাম্পিংয়ের জন্য বেশ উপযুক্ত। এর আশেপাশের পুরো শান্ত পরিবেশ ঘুরে দেখার জন্য কায়াকিংয়েরও ব্যবস্থা আছে।
ঢাকা থেকে প্রথমে যাত্রাবাড়ী যেতে হবে। পরে সেখান থেকে জুরাইন রেল গেইট। অতঃপর পোস্তগলা ব্রিজের পার হলেই পাওয়ার যাবে সারিঘাটের সিএনজি চালিত অটো রিকশা। এই পুরো যাত্রায় খরচ হতে পারে বাস ও অটোরিকশা মিলে প্রায় ৪০ টাকার মত।
মায়াদ্বীপ, নারায়ণগঞ্জ
এটি মূলত নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও উপজেলার মেঘনা নদীর ঠিক মাঝখানে জেগে ওঠা ত্রিভুজ আকৃতির একটি চর। ক্যাম্পিংয়ের আসল রোমাঞ্চকর আমেজের ষোল আনাই পরিপূর্ণ হবে এই গ্রামটিতে। গুলিস্তান থেকে বাসে করে মোগড়াপাড়া; তারপর সেখান থেকে সিএনজি চালিত অটোরিকশা করে বৈদ্যের বাজার বা আর একটু ভেতরে আনন্দ বাজার ঘাট। এখান থেকেই নৌকা নিয়ে রওনা হওয়া যাবে মায়াদ্বীপের উদ্দেশে। পুরো যাতায়াতে খরচ পড়তে পারে বাস, অটোরিকশা ও নৌকা নিয়ে সর্বমোট প্রায় ৮০ টাকা।
আড়াইহাজার, নারায়ণগঞ্জ
ঢাকার কাছেই সবচেয়ে সুন্দর গ্রাম দেখতে হলে যেতে হবে নারায়ণগঞ্জের এই উপজেলায়। এর গ্রামগুলো প্রত্যেকটিই নয়নাভিরাম। বিশেষত বিশনন্দি ইউনিয়নের মানিকপুর গ্রামকে সবাই এখন মিনি কক্সবাজার বলেই ডাকে। এই গ্রামগুলো যে কোনটিতেই ক্যাম্পিং করে একটা পুরো দিন কাটিয়ে দেয়া যায়। এগুলোর মধ্যে কালাপাহাড়িয়া, খালিয়ারচর, কদিমচর, রাধানগর, খাগকান্দা গ্রামগুলো ক্যাম্পিংয়ের জন্য সেরা।
ঢাকার গুলিস্তান থেকে প্রথমে বাসে করে আড়াই হাজার আসতে হবে। আড়াইহাজার থানার মোড় থেকে খাগকান্দা ঘাটে এলেই দূর থেকে চোখে পড়বে চৌদ্দার চর। এটিই এখানকার সবচেয়ে জনপ্রিয় ক্যাম্পিং সাইট। আড়াইহাজার পৌঁছতে খরচ পড়তে পারে প্রায় ৫০ টাকা।
ক্যাম্পসাইট ক্যাফে, কেরানীগঞ্জ
কেরানীগঞ্জের কলাতিয়াতে নৌখোলা নদীর পাড়ে সরু রাস্তার পাশে অবস্থিত এই ক্যাফে। দারুণ লেক ভিউসহ এখানকার গ্রাম্য পরিবেশে ক্যাম্পিং প্যাকেজ জন প্রতি ১,১৯৯ টাকা। পাশেই গাড়ি অথবা বাইক পার্কিংয়ের ব্যবস্থা আছে। তাই পরিবার-পরিজনদের নিয়ে ক্যাম্পিংয়ের জন্য উপযুক্ত জায়গা এই ক্যাফেটি। শুধু তাই নয়, ক্যাম্পিং ছাড়াও প্যাকেজের মধ্যে আছে লেকের পানিতে সুইমিং, সাইক্লিং, ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ, বারবিকিউ ও স্ন্যাক্সের ব্যবস্থা।
ঢাকার গুলিস্থান থেকে বাস অতঃপর অটোরিকশায় ক্যাম্পসাইট ক্যাফে আসতে খরচ পড়তে পারে প্রায় ৫০ থেকে ৬০ টাকার মত। এছাড়া মোহাম্মদপুর থেকেও সিএনজি যোগে এই ক্যাফেতে যাওয়া যায়; প্রায় একই রকম খরচ পড়বে।
পদ্মহেম ধাম, মুন্সিগঞ্জ
ঢাকার পার্শ্ববর্তী জেলা মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখানের পদ্মহেম ধাম জায়গাটিতে লালন সাঁইয়ের পদধূলি না পড়লেও তার ভক্ত প্রথম আলো’র সাংবাদিক কবির হোসেন সাঁইয়ের স্মরণে গড়ে তুলেছেন এই আখড়াটি। ইছামতি নদীর তীরে অবস্থিত এই ধামটিতে ক্যাম্পিং করে একটি রাত কাটানো সারা জীবনের শ্রেষ্ঠ সঞ্চয় হতে পারে। বালুচর গ্রামের ভেতরে অবস্থিত এ জায়গাটিকে গ্রামবাসীরা বাউল বাড়ি বলে ডাকে।
ঢাকার যাত্রাবাড়ী দিয়ে প্রথমে পোস্তগোলা, সেখান থেকে মোল্লার বাজার এসে নদী পার হতে হবে। এরপর পাওয়া যাবে পদ্মহেম ধামের গাড়ি। পুরো যাত্রায় সিএনজি ও নৌকা ভাড়া পড়তে পারে প্রায় ২৫০ টাকার মত।
বালুনদী, ঢাকা
এ জায়গাটি ঢাকার একদম প্রাণকেন্দ্র গুলশানে অবস্থিত। নতুন বাজারের ভাটারা থানা থেকে সিএনজিতে মাত্র ২০ মিনিটের পথ ১০০ ফুট রাস্তার শেষ প্রান্তের বেরাইদ। সেখানেই দেখা মিলবে ৩০ ফুট প্রশস্ত এই ক্যাম্পিং সাইট। সিএনজি ভাড়া পড়বে জনপ্রতি ২৫ টাকা।
এখানে ক্যাম্পিংয়ের পাশাপাশি রয়েছে বারবিকিউয়ের সুবিধা। শহরের আলো নিভে যাবার সঙ্গে সঙ্গে ক্যাম্পের ভেতরে অথবা বালুনদীতে ট্রলার দিয়ে ভ্রমণের সময় নিঃসঙ্গ নদীতে অভিজ্ঞতাটুকু চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
৩০০ ফিটের হ্যালিপ্যাড চত্ত্বর, ঢাকা
ঢাকার পূর্বাচলের ৩০০ ফিট সড়ক ও এর আশপাশ ইতোমধ্যে দর্শনার্থীদের বেশ প্রিয় জায়গায় পরিণত হয়েছে। এখানকার হ্যালিপ্যাড চত্ত্বর ক্যাম্পিং ভ্রমণের জন্য সেরা। ঢাকার মত হৈচৈয়ের শহরেও এখানে মিলবে ঘুটঘুটে অন্ধকার ও পিনপিতম নিরবতা। বাংলাদেশের কোন পাহাড়ি অঞ্চল অথবা কোন নির্জন দ্বীপে ক্যাম্পিংয়ের জন্য এখানকার ক্যাম্পিংটি প্রাথমিক অভিজ্ঞতা হিসেবে কাজ করবে।
কুড়িল বিশ্ব রোড থেকে ৯নং সেক্টরের বাসস্ট্যান্ড বা নিলা মার্কেটের পরে নেমে অটোরিকশাতে করে হ্যালিপ্যাড চত্ত্বর। খরচ পড়বে প্রায় ৩০ টাকা।
ক্যাম্পিংয়ের প্রয়োজনীয় কিছু টিপস
দুঃসাহসিক অভিযানেও প্রয়োজন পূর্ব প্রস্তুতি ও যথাযথ সর্তকতা, নতুবা পুরো ভ্রমণটাই নষ্ট হয়ে যেতে পারে। ক্যাম্পিংয়ের প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের মধ্যে যেগুলো অবশ্যই তালিকাভুক্ত করতে হবে সেগুলো হলো ফার্স্ট এইড কিট, টর্চ, পাওয়ার ব্যাংক, যথেষ্ট পরিমাণে পলিথিন, রিচার্জেবল লাইট, পোকা-মাকড় নিরোধক, সর্বোপরি একটি টেকসই, হালকা ও সহজে বহনযোগ্য তাবু। ক্যাম্পিংয়ের আনন্দ আরেকটু বাড়িয়ে নিতে হ্যামক নেয়া যেতে পারে। শীতের ক্যাম্পিংয়ের জন্য শীতের পোষাক নেয়াটা জরুরি। তবে অবশ্যই ব্যাকপ্যাক যাতে ভারি না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। ক্যাম্পিংয়ের সময় খাবারের উচ্ছিষ্ট ও অন্যান্য অতিরিক্ত জিনিসপত্র যেখানে সেখানে ফেলে পরিবেশ নষ্ট না করার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে।
সাবধানতার ক্ষেত্রে, ক্যাম্পিংয়ের প্রথম শর্ত হচ্ছে দলবদ্ধভাবে ভ্রমণ করা। দলের মধ্যে স্থানীয়দের কেউ থাকলে উত্তম। তবে না থাকলে স্থানীয়দের কারো যোগাযোগের নম্বর রাখা যেতে পারে। এছাড়া স্থানীয় থানার নাম্বারও সংগ্রহে থাকা উচিত।
সবশেষে, ক্যাম্পিং মানেই নিত্য নৈমিত্তিক আবাসন সুবিধাগুলোর ঘাটতি থাকবে এবং পরিবর্তন আসবে যে কয়দিন ক্যাম্পিং করা হচ্ছে সে কয়দিনের জীবন ধারণে। যারা এটা জেনেই ক্যাম্পিংয়ের পরিকল্পনা করছেন তারা যে কোন পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুতি নিয়ে তবেই বের হবেন। এরপরেও বর্তমানের রিসোর্টগুলো যেরকম কৃত্রিম পরিবেশ তৈরি করছে সেগুলোতে আসল ক্যাম্পিংয়ের কোন স্বাদই অবশিষ্ট থাকে না। ওগুলোকে ক্যাম্পিং না বলে একটু ব্যতিক্রমধর্মী অভিজাত স্যুইট বলা যেতে পারে। কিন্তু যেগুলো কোন রিসোর্ট বা রেস্টুরেন্ট সংলগ্ন নয় সেগুলোতে পাওয়া যেতে পারে ক্যাম্পিংয়ের আসল আমেজ। বিশেষ করে মায়াদ্বীপ, আড়াইহাজারের চৌদ্দার চর, ঢাকার বালুনদী ও ৩০০ ফিট রোমাঞ্চকর ক্যাম্পিংয়ের উপযুক্ত জায়গা। তবে এ জায়গাগুলোতে ক্যাম্পিংয়ের জন্য অবশ্যই স্থানীয়দের অনুমতি নিয়ে নিতে হবে।