করোনায় বিপর্যস্ত ইন্দোনেশিয়া, বাসাবাড়িতে নিঃসঙ্গ মৃত্যু
বাড়ির ভেতর থেকে মৃতদেহ বের করছেন অগ্নিনির্বাপণ বাহিনীর কর্মীরা। মৃতদের মধ্যে অনেকে প্রাণ হারিয়েছে অক্সিজেন সংকটের কারণে। মৃত্যুর সময় তাদের পাশে কেউ ছিল না। অনেক ক্ষেত্রে প্রতিবেশীরা উদ্ধারকর্মীদের খবর দিয়েছে আসার জন্য। নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ও মৃত্যুতে ইন্দোনেশিয়ার পরিস্থিতি এখন এমনটাই দাঁড়িয়েছে। সংবাদমাধ্যম বিবিসি এ খবর জানিয়েছে।
বিবিসি ইন্দোনেশিয়ার সাংবাদিক ভালদিয়া বারাপুতরি লিখেছেন, এশিয়া মহাদেশের মধ্যে ইন্দোনেশিয়া করোনাভাইরাস সংক্রমণের নতুন আরেকটি হটস্পট হয়ে উঠেছে। গত দেড় বছরের মধ্যে ইন্দোনেশিয়ায় নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ এখন সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি তৈরি করেছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
ইন্দোনেশিয়ায় এখন পর্যন্ত ২৬ লাখ মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে। চলতি সপ্তাহে আক্রান্তের সংখ্যা রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। প্রতিদিনই ৪০ হাজারের বেশি মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে।
অতিসংক্রামক ডেলটা ভ্যারিয়্যান্টের কারণে ইন্দোনেশিয়ায় এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
ফায়ার সার্ভিসকর্মী এখন কোভিড ফ্রন্টলাইনার
উইরাওয়ান ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তায় কর্মরত আছেন অগ্নিনির্বাপণকর্মী হিসেবে। কিন্তু, আগুন নেভানোর পরিবর্তে তিনি এখন করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃতদের মরদেহ উদ্ধারের কাজ করছেন। গত এক বছরে তিনি এবং তাঁর আরও সাত সহকর্মী বাসা-বাড়িতে গিয়ে মরদেহ উদ্ধার করে সেগুলো কবর দেওয়ার কাজ করছেন।
উইরাওয়ান বলেন, বেশির ভাগ মানুষ একলা অবস্থায় মারা যাচ্ছে। এর একটি হতে পারে তারা হয়তো প্রাথমিক চিকিৎসা পায়নি, নয়তো হাসপাতাল থেকে তাদের ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
উইরাওয়ান বলেন, “প্রায়ই মৃতদের প্রতিবেশীরা আমাদের ফোন করে বলেন—‘অমুক ব্যক্তি সেলফ আইসোলেশনে থাকা অবস্থায় তাঁকে আর দেখা যায়নি।’ তারপর তাঁরা জানতে পারেন সে ব্যক্তি মারা গেছেন। এ ধরনের ঘটনা আমরা প্রতিদিন দেখছি।’
নভেল করোনাভাইরাসের সর্বশেষ ঢেউ আসার আগে উইরাওয়ান প্রতিদিন দুই-তিনটি মৃতদেহ কবর দেওয়ার জন্য ফোন পেতেন। কিন্তু, এখন তিনি প্রতিদিন অন্তত ২৪টি মৃতদেহ দাফনের জন্য ফোন পাচ্ছেন।
ঈদের ছুটিতে বিধিনিষেধ উপেক্ষিত
মে মাসের শুরুর দিকে ইন্দোনেশিয়ায় করোনাভাইরাসের সংক্রমণ হঠাৎ করেই মারাত্মক আকার ধারণ করে। তখন ঈদের ছুটিতে প্রায় ১৫ লাখ মানুষ বিধিনিষেধ উপেক্ষা করে যাতায়াত করেছে।
বিদেশ থেকে যারা ইন্দোনেশিয়ায় ঢুকছে, তাদের কোয়ারেন্টিন করার ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ শিথিল করা হয়েছে। ইন্দোনেশিয়াতে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট কখনও বন্ধ করা হয়নি। সম্প্রতি বিদেশফেরত যাত্রীদের ক্ষেত্রে আট দিন কোয়ারেন্টিনে থাকা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এটি আগে ছিল ছিল পাঁচ দিন। দেশটির স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, সীমান্ত খোলা রেখে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধ করা প্রায় অসম্ভব বিষয়। তবে সরকার বলছে, সীমিত সংখ্যক বিদেশি নাগরিক ইন্দোনেশিয়ায় ঢুকতে পারে।
নভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ইন্দোনেশিয়ায় এ পর্যন্ত ৬৯ হাজার মানুষ মারা গেছে। এর মধ্যে গত সপ্তাহে প্রতিদিন প্রায় এক হাজার মানুষ মারা গেছে। তবে, মৃতের সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে বলে অনেকে মনে করেন।
ইন্দোনেশিয়ার একটি স্বতন্ত্র পরিসংখ্যান গ্রুপ ল্যাপোর কোভিড-১৯ বলছে, জুন থেকে এখন পর্যন্ত ৪৫০ জন করোনায় আক্রান্ত রোগী তাদের বাড়িতে মারা গেছে। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পর তারা সেলফ আইসোলেশনে ছিল, কারণ হাসপাতালগুলোতে রোগী ভর্তি করানোর জায়গা ছিল না।
অক্সিজেন সংকট
ইন্দোনেশিয়ায় করোনাভাইরাস সংক্রমণের মূল কেন্দ্র হচ্ছে সবচেয়ে জনবহুল জাভা দ্বীপ। জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে সেখানকার একটি হাসপাতালে অক্সিজেন সংকটের কারণে ৬৩ জন কোভিড রোগী মারা গেছে।
এসব মৃত্যুর ঘটনা পুরো ইন্দোনেশিয়াকে শোকাহত করেছে। যদিও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দাবি করছে—সংবাদমাধ্যম মৃত্যুর সংখ্যা বাড়িয়ে বলেছে। তখন থেকে বিভিন্ন হাসপাতালে অক্সিজেন সংকটের কারণে নতুন রোগী ভর্তি করা বন্ধ করে দেওয়া হয়।
ইন্দোনেশিয়ার হসপিটাল অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব লিয়া গার্দেনিয়া পারটাকুসুমা বলেন, সাধারণত একটি হাসপাতালে এক সপ্তাহে তিন টন অক্সিজেনের প্রয়োজন হয়। কিন্তু, এখন এই পরিমাণ অক্সিজেন এক দিনেই শেষ হয়ে যাচ্ছে।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, সংক্রমণের পরিস্থিতি এতটা খারাপ হবে, সেটি সরকার অনুমান করতে পারেনি। সেজন্য অক্সিজেনের সংকট দেখা দিয়েছে।
নিজেদের পরিবারের সদস্য ও স্বজনদের জন্য অনেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট দিয়ে অক্সিজেন ট্যাংক এবং হাসপাতালে শয্যার জন্য আকুতি জানাচ্ছে।
অক্সিজেন সংকটের কারণে ইন্দোনেশিয়ার বেশির ভাগ অক্সিজেন স্টোর বন্ধ হয়ে গেছে। যে কয়েকটি অক্সিজেন স্টোর খোলা রয়েছে, সেখানে মানুষের দীর্ঘ সারি দেখা যায়।
অক্সিজেন সংকটের এই সময়ে অনেকে প্রতারণার শিকার হচ্ছে, অথ্য দিয়েও অক্সিজেন পাচ্ছে না।
এগিয়ে আসছে সমাজের মানুষ
ইন্দোনেশিয়ার সরকার পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যর্থতার অভিযোগে নানা সমালোচনার মুখে পড়েছে। কিন্তু, আক্রান্তদের সহায়তায় সাধারণ মানুষ এগিয়ে আসছে।
২৪ বছর বয়সী একজন চিকিৎসক ভিডিও কলের মাধ্যমে বিনা খরচে চিকিৎসা সেবা দিতে এগিয়ে এসেছেন।
চিকিৎসক রিও পুংকি ইরাওয়ান বুঝতে পেরেছিলেন—সেলফ আইসোলেশনে থাকা অনেকেই চিকিৎসা পাচ্ছেন না। সেজন্য তিনি প্রথমে হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে চিকিৎসা সেবা দেওয়া শুরু করেন। গত ৭ জুলাই এই সেবা চালু করার পর এখন পর্যন্ত ৮০০ কল পেয়েছেন বলে জানান এই চিকিৎসক।
জাভার পশ্চিমাঞ্চলের কৃষক ডিজকি হারিয়াদি নিজের জমিতে উৎপাদিত চাল সেলফ আইসোলেশনে থাকা ব্যক্তিদের জন্য ট্রাকে করে পৌঁছে দিচ্ছেন।
এ ছাড়া রোগীদের জন্য অক্সিজেন ট্যাংক জোগাড় করে দেওয়ার কাজও করেন ডিজকি হারিয়াদি। তিনি বলেন, ‘সংক্রমিত হওয়ার ভয়ে অনেকে রোগীদের খোঁজ-খবর নেয় না। আমরা যদি মাস্ক পরি এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি ও নিয়ম মেনে চলি, তাহলে বিষয়টি নিয়ে ভয়ের কিছু নেই।’