দেশভাগের ৭৫ বছর পর তিন ভাইবোনের আবেগঘন সাক্ষাৎ
১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান দেশভাগের সময় পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান মমতাজ বিবি নামের এক পাকিস্তানি নারী। প্রায় ৭৫ বছর পর সম্প্রতি তাঁর দুই ভাই—গুরমুখ সিং ও বলদেব সিংয়ের সঙ্গে দেখা করতে পেরেছেন তিনি। আর, তিন ভাইবোনের এমন আবেগঘন মুহূর্তের সাক্ষী হয়ে ছিল পাকিস্তানের কর্তারপুর সাহেব গুরুদ্বার। খবর বিবিসির।
পঁচাত্তর বছর পরে হারিয়ে যাওয়া বোনকে ফিরে পাওয়ার পর দুই ভাই দেখতে পান—তাঁরা হিন্দু ধর্মাবলম্বী হলেও তাঁদের বোন বেড়ে উঠেছেন পাকিস্তানের একটি মুসলিম পরিবারে। যদিও এতে ভাইদের কোনো আপত্তি নেই। বরং তাঁরা এত দিন পর বোনকে খুঁজে পেয়েই অনেক খুশি। তাঁদের কথা—ধর্ম যাই হোক না কেন, শরীরের রক্ত তো একই। আর, তাই তো গুরুদেব নানক বলেছেন, ‘মানাস কি জাত সাবহি এক প্যাহচান হ্যায়।’ যার অর্থ দাঁড়ায়—সব মানুষের পরিচয় একই।
গুরমুখ সিং আরও জানান, তাঁর বোন মমতাজকে একজন মুসলিম হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছিল। কিন্তু, তাঁরা দুই ভাই এসব মেনে নিয়েই বোনকে গ্রহণ করেছেন।
গুরমুখ সিং বলেন, ‘যখন আমরা দেখা করি, আমরা বাকি সব ভুলে গিয়েছিলাম। তা ছাড়া বোন মুসলিম হলে কী হবে? তার শিরা দিয়ে তো একই রক্তই প্রবাহিত হচ্ছে। আর, এটাই আমাদের কাছে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।’
১৯৪৭ সালে দেশভাগের ফলে দুটি স্বাধীন দেশ—ভারত ও পাকিস্তানের জন্ম হয়। কোনো যুদ্ধ কিংবা দুর্ভিক্ষ ছাড়াই এটি ছিল উপমহাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় দুর্যোগ। এ সময় প্রায় এক কোটি ২০ লাখ মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে পড়ে। এ ছাড়া পাকিস্তান-ভারত ধর্মীয় সহিংসতা ও দাঙ্গায় প্রায় পাঁচ লাখ থেকে ১০ লাখ মানুষ নিহত হয়।
এত দিন পর বোনের সঙ্গে দেখা করতে পেরে উচ্ছ্বসিত ভাই গুরমুখ সিং বলেন, ‘জীবদ্দশায় আমাদের বোনের সঙ্গে দেখা করতে পেরে আমরা খুবই আনন্দিত।’
৭০ বছর বয়সি গুরমুখ সিং আরও বলেন, ‘(১৯৪৭ সালের) ওই দাঙ্গা আমাদের ধ্বংস করে দিয়েছে।’
গুরমুখ সিংয়ের ছোট ভাই বলদেব সিং জানান, দাঙ্গার সময় পাকিস্তানে তাঁদের মা নিহত হলে তাঁদের বাবা পালা সিং পাকিস্তান থেকে ভারতের পাঞ্জাব রাজ্যের পাতিয়ালা জেলায় চলে আসেন। স্ত্রীর মৃত্যুর পর পালা সিং ভেবেছিলেন—তাঁর মেয়ে মমতাজ বিবিও ওই দাঙ্গায় নিহত হয়েছে। কিন্তু পাকিস্তানে, মমতাজ বিবিকে এক মুসলিম দম্পতি খুঁজে পান। পরে তাঁরা মমতাজকে দত্তক নিয়ে বড় করে তোলেন। এদিকে, ভারতে এসে সে সময়কার ঐতিহ্য অনুযায়ী, পালা সিং তাঁর শ্যালিকাকে বিয়ে করেন।
বলদেব সিং বলেন, ‘বছর দুয়েক আগে আমাদের ছেলেরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আমাদের বোনের কথা জানতে পেরেছিল।’
নাসির ধিলোন নামের পাকিস্তানি এক ইউটিউবার দেশভাগের সময় বিচ্ছিন্ন হওয়া বেশ কয়েকটি পরিবারকে তাঁদের স্বজনদের খুঁজে পেতে সহায়তা করেছিলের। তাই মমতাজ নিজের পরিবারকে আবার ফিরে পাওয়ার আশায় ওই ইউটিউবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।
এদিকে, গুরমুখ সিং বোনের সঙ্গে তাঁদের যোগাযোগ নিশ্চিত করতে পাকিস্তানের শেখুপুরা জেলায় তাঁদের পৈতৃক ভিটা গ্রামের এক দোকানির সঙ্গে যোগাযোগ করেন। ওই দোকানিই হারিয়ে যাওয়া ভাই-বোনদের মিলিয়ে দেন।
তবে, গুরমুখ সিং স্বীকার করেছেন—প্রাথমিকভাবে তাঁর পরিবারের মমতাজের পরিচয় নিয়ে সন্দেহ ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে তাঁরা দুভাই প্রমাণ করতে সক্ষম হন যে, মমতাজই তাঁদের সেই হারিয়ে যাওয়া বোন। উচ্ছ্বসিত গুরমুখ সিং বলেন, ‘সে সময় আমাদের আনন্দের সীমা ছিল না।’
ছোট ভাই বলদেব সিং জানান, পরিচয় শনাক্তের পরে তাঁরা যেকোনো মূল্যে মমতাজের সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু, বাদ সাধছিল ভিসার সমস্যা। সেইসঙ্গে যুক্ত হয় কোভিড মহামারিও। এ কারণে তাঁদের দেখা করার প্রক্রিয়া আরও দীর্ঘায়িত হয়।
অবশেষে গত ২৪ এপ্রিল দুই ভাই তাঁদের পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের নিয়ে গুরুদ্বারে পৌঁছান। সেখানেই দেখা পান বোন মমতাজের। এ সময় মমতাজও নিজের পরিবারকে সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন।
আনন্দঘন সে মুহূর্তের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলদেব সিং আবেগপ্রবণ হয়ে ওঠেন। তিনি বলেন, ‘আমরা পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে খুব কেঁদেছিলাম। আমরা কখনোই আলাদা হতে চাইনি। আমরা একে অপরকে প্রতিশ্রুতি দিই—যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ভিসা পাওয়ার চেষ্টা করব। সে (মমতাজ) এরই মধ্যে ওর কাগজপত্র জমা দিয়েছে। আর, আমরা এদিকে আশা করছি শিগগিরই সে আমাদের সঙ্গে আবারও দেখা করতে পারবে।’
এর আগে গেল জানুয়ারিতে এমন আরেকটি পরিবারের সন্ধান পাওয়া যায়। ওই পরিবারের সদস্যেরাও দেশভাগের সময় একই ভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। তারাও করতারপুর সাহেব গুরুদ্বারে নিজ হারিয়ে যাওয়া পরিবারের সঙ্গে দেখা করেন।
সিক্কা সিং নামের এক ব্যক্তি দেশভাগের সময় পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে তাঁর মায়ের সঙ্গে ভারতে রয়ে গিয়েছিলেন। পরে, তিনি তাঁর ভাই সাদিক খান ও বাবার সঙ্গে দেখা করতে পাকিস্তান যান। অবশেষে মে মাসে সিক্কা সিং তাঁর দীর্ঘদিনের হারানো ভাইবোনকে নিয়ে ভারতে ফিরে আসেন একজন অত্যন্ত সুখী মানুষ হিসেবে।
গুরমুখ সিং কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, ‘করতারপুর সাহেব আমাদের মতো আরও অনেক পরিবারকেই তাদের হারিয়ে যাওয়া স্বজনদের সঙ্গে দেখা করতে সাহায্য করেছেন।’
তবে, ভারত সরকারের কাছে সিক্কা সিংয়ের অনুরোধ—সরকারের ‘উচিত করতারপুর সাহেব পরিদর্শন এবং দুদেশের মধ্যে ভিসা প্রক্রিয়া আরও সহজ করা।’
আর, গুরমুখ সিং বলেন, ‘আমাদের দেখা করতে ৭৫ বছর লেগেছে। এখন আমরা বারবার দেখা করতে চাই এবং একসঙ্গে সময় কাটাতে চাই।’