পারভেজ মোশাররফের ঘটনাবহুল জীবন
পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট জেনারেল (অব.) পারভেজ মোশাররফ। আজ রোববার (৫ ফেব্রুয়ারি) সাবেক এই স্বৈরশাসক দুবাইয়ের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। তার বয়স হয়েছিল ৭৯ বছর।
পারভেজ মোশাররফ ১৯৯৯ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের সেনাপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০১ সালে দেশটির দশম প্রেসিডেন্ট হন তিনি। খবর দ্য ডনের।
১৯৪৩ সালে ব্রিটিশ ভারতের দিল্লিতে জন্মগ্রহণ করেন পারভেজ। তবে দেশভাগের পর তার পরিবার পাকিস্তানের করাচিতে স্থায়ী হয়। সেখানে তিনি সেন্ট প্যাট্রিক স্কুলে পড়াশোনা করেন। পরে, তিনি পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমিতে যোগ দেন এবং ১৯৬৪ সালে সেই প্রতিষ্ঠান থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন। পরবর্তীতে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কমিশন লাভ করেন।
১৯৬৫ সালের পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধেও অংশগ্রহণ করেন পারভেজ। ১৯৬৬ থেকে ১৯৭২সাল পর্যন্ত এলিট স্পেশাল সার্ভিসেস গ্রুপে (এসএসজি) দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭১ সালের পর, তিনি বেশ কয়েকটি সামরিক কাজে দক্ষতা অর্জন করতে থাকেন এবং সেনাবাহিনীতে দ্রুত পদোন্নতি লাভ করেন।
১৯৯৮ সালের অক্টোবরে, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ তাকে সেনাপ্রধান নিযুক্ত করেন। এক বছর পরে, তিনি রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানের মাধ্যমে শরিফ সরকারকে উৎখাত করে দেশের প্রেসিডেন্ট হন।
১৯৯৯ সালের ১২ অক্টোবর সেনারা প্রধানমন্ত্রী ভবন দখল করে নেয় যখন শরিফ শ্রীলঙ্কা থেকে ফেরার পথে মোশাররফকে করাচি বিমানবন্দরে অবতরণ করতে বাধা দেন। পরে মোশাররফ জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন, সংবিধান স্থগিত করেন এবং প্রধান নির্বাহীর ভূমিকা গ্রহণ করেন।
পারভেজমোশাররফ প্রেসিডেন্ট হওয়ার মাত্র কয়েক মাস পরেই ৯/১১ হামলা হয়। পরবর্তীকালে তিনি ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে’ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনপুষ্ট ছিলেন।
২০০২ সালের অক্টোবরে সাধারণ নির্বাচন হয় দেশটিতে। সে সময় পারভেজ মোশাররফ পাকিস্তান মুসলিম লীগ-কায়েদ (পিএমএল-কিউ), মুত্তাহিদা কওমি মুভমেন্ট এবং মুত্তাহিদা মজলিস-ই-আমল নামে ছয়টি ধর্মীয় দলের জোটের সঙ্গে জোটবদ্ধ হন। এই নির্বাচনের মাধ্যমে, মোশাররফ ১৭তম সংশোধনী পাস করার জন্য প্রয়োজনীয় দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা সংগ্রহ করতে সক্ষম হন যা ১৯৯৯ সালের অভ্যুত্থান এবং তার দ্বারা গৃহীত অন্যান্য পদক্ষেপকে বৈধতা দিতে সাহায্য করেছিল।
২০০৪ সালের জানুয়ারিতে, মোশাররফ পার্লামেন্টের উভয়কক্ষ এবং চারটি প্রাদেশিক পরিষদে ৫৬ শতাংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় একটি আস্থা ভোট জিতে নেন।
২০০৬ সালে ‘ইন দ্য লাইন অব ফায়ার’ শিরোনামে মোশাররফের আত্মজীবনী প্রকাশিত হয়। ২০০৭ সালের মার্চ মাসে, মোশাররফ তৎকালীন প্রধান বিচারপতি ইফতিখার মুহাম্মদ চৌধুরীকে তার পদের অপব্যবহারের অভিযোগে পদত্যাগ করতে অস্বীকার করার পরে বরখাস্ত করেন। ঘটনাটি আইনজীবী ও সুশীল সমাজের কর্মীদের সহিংস প্রতিবাদের সূচনা করে। ২০০৭ সালের ২০ জুন সুপ্রিম কোর্ট প্রধান বিচারপতিকে পুনর্বহাল করেন এবং সাবেক বিচারপতি মোশাররফের বরখাস্তকে বাতিল ঘোষণা করেন।
২০০৭ সালের ৩ নভেম্বর, মোশাররফ দেশে জরুরি অবস্থা জারি করলে প্রধান বিচারপতিকে আবার পদচ্যুত করা হয়। জরুরি অবস্থা জারির ২৫ দিনের মধ্যে, জেনারেল আশফাক পারভেজ কায়ানির দায়িত্ব নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মোশাররফ সেনাপ্রধানের পদ থেকে পদত্যাগ করেন। মোশাররফ, যিনি তখনও প্রেসিরডেন্ট ছিলেন, অবশেষে ২০০৭ সালের ১৫ ডিসেম্বর জরুরি অবস্থা তুলে নেন।
মোশাররফকে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করার সুযোগ দেওয়ার পর পিপিপি নেতৃত্বাধীন জোট সরকার ২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনের পরে তাকে অভিশংসনের জন্য একটি সংসদীয় প্রক্রিয়া শুরু করে। পারভেজ মোশাররফ প্রথমে পদত্যাগ করতে অস্বীকার করেন এবং জোট তার ক্ষমতাচ্যুতির জন্য আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া শুরু করে। তবে অভিশংসন চূড়ান্ত হওয়ার আগেই তিনি স্বেচ্ছায় পদ ছেড়ে দেন।
বেনজির ভুট্টো হত্যাকাণ্ড, নবাব আকবর বুগতির হত্যাকাণ্ড এবং ২০০৭ সালের নভেম্বরে জরুরি অবস্থার পরে ৬২ জন বিচারকের 'অবৈধ বন্দী' সংক্রান্ত মামলায়ও মোশাররফের নাম ছিল। ২০১৩ সালের মার্চে, সিন্ধু হাইকোর্ট তিনটি মামলায় তাকে সুরক্ষামূলক জামিন দেন।
২০১০ সালে, মোশাররফ তার রাজনৈতিক দল অল পাকিস্তান মুসলিম লীগও (এপিএমএল) চালু করেছিলেন।
২০১৩ সালে তাকে বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল। তবে, সাবেক প্রেসিডেন্টের নাম স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয় এবং তিনি ২০১৬ সালে ১৭ মার্চ দুবাই চলে যান আর দেশে ফেরেননি।