বাইডেন-সৌদি যুবরাজের বৈঠকে এসেছে খাসোগি হত্যা প্রসঙ্গ
সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে বৈঠকে সাংবাদিক জামাল খাসোগি হত্যার প্রসঙ্গটি তুলেছেন বলে জানিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। খবর বিবিসির।
বাইডেন স্পষ্ট জানিয়েছেন—২০১৮ সালের খাসোগি হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি নিজের ও যুক্তরাষ্ট্রের কাছে খুবই গুরুত্ববহ। তবে, বাইডেন বলেছেন—অন্য ইস্যুগুলোতে দুদেশ মতৈক্যে পৌঁছেছে।
সৌদি যুবরাজের সঙ্গে স্থানীয় সময় গতকাল শুক্রবারের বৈঠকের পর ব্রিফিংয়ে জো বাইডেন বলেন, ‘আমি বৈঠকে খাসোগি হত্যার প্রসঙ্গটি সর্বাধিক গুরুত্বসহ উত্থাপন করেছি। আমি স্পষ্ট জানিয়েছি—হত্যাকাণ্ডের সময় আমি কী ভেবেছি এবং এখন কী ভাবছি।’
বাইডেন আরও বলেন, ‘আমি কোনো রাখঢাক ছাড়াই বলেছি—মানবাধিকার প্রসঙ্গে একজন মার্কিন প্রেসিডেন্টের নিশ্চুপ থাকাটা আমরা কে এবং আমি কে—এর সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। আমি সব সময় আমাদের মূল্যবোধের ব্যাপারে সোচ্চার থাকব।’
এ ছাড়া জো বাইডেন বলেন, সৌদি যুবরাজ দাবি করেছেন—খাসোগি হত্যাকাণ্ডের জন্য তিনি (যুবরাজ) ব্যক্তিগতভাবে দায়ী নন। তবে, আমি ইঙ্গিত করেছিলাম—তাঁকে (যুবরাজ) আমি এর জন্য দায়ী ভেবেছিলাম।’
এদিকে, বৈঠকের আগে সৌদি যুবরাজের সঙ্গে জো বাইডেনকে ‘ফিস্ট-বাম্পিং’ (করোনাবিধি মেনে মুষ্টিবদ্ধ হাত ঠেকিয়ে অভ্যর্থনাপর্ব সেরে নেওয়া) করতে দেখা যায়। একে দুই দেশের মধ্যে উষ্ণ সম্পর্ক হিসেবে দেখা হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্র দশকের পর দশক ধরে প্রধানত জ্বালানি তেলের স্বার্থে মূল্যবোধ বিসর্জন দিয়ে সৌদি রাজপরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখেছে। কিন্তু, জো বাইডেন ক্ষমতায় এসে বলতে শুরু করেন—বাইরের যেকোনো দেশের সঙ্গে তাঁর সরকারের সম্পর্কের ভিত্তি হবে মানবাধিকার।
এরপর বাইডেন সৌদি যুবরাজ সালমানের সঙ্গে দেখা করতে বা কথা বলতে অস্বীকৃতি জানান। সৌদি যুবরাজ বাইডেনের সঙ্গে কথা বলতে কয়েক বার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। সৌদি আরবের কাছে নতুন অস্ত্র বিক্রিও স্থগিত করেন বাইডেন।
সৌদি আরবে সফরের খবর নিশ্চিত হওয়ার পরেও, অর্থাৎ গত মাসেও বাইডেন বলেছিলেনন—যুবরাজ সালমানের সঙ্গে তাঁর কোনো কথা হবে না। কিন্তু, পরে সৌদি সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয় দুজনের মধ্যে জেদ্দায় কথা হবে।
কেন সুর বদল, বাইডেনের সাফাই
আঠারো মাসের মাথায় এসে কেন উলটো পথে হাঁটতে শুরু করলেন জো বাইডেন?
বিশ্লেষকেরা বলছেন—বাস্তবতার কাছে মাথা নত করছেন বা বাস্তবতা মেনে নিচ্ছেন ৭৯ বছর বয়সি এ মার্কিন প্রেসিডেন্ট। আর, এর পেছনে প্রধানত কাজ করছে ইউক্রেন যুদ্ধ।
কয়েক দিন ধরে নিজেই তাঁর মত বদলের পক্ষে যুক্তি তুল ধরার চেষ্টা করেছেন বাইডেন।
কদিন আগে দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকায় নিজের লেখা এক নিবন্ধে বাইডেন বলেছেন—সৌদি আরবকে ‘ব্ল্যাংক চেক’ দেওয়ার নীতি তিনি বদলে দিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু ইউরোপে যুদ্ধের কারণে মধ্যপ্রাচ্যের ও সৌদি আরবের গুরুত্ব তিনি অনুধাবন করছেন।
জো বাইডেন আরও লেখেন, ‘রাশিয়ার আগ্রাসনের পালটা ব্যবস্থা আমাদের নিতে হবে। চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় আমাদের শক্ত অবস্থান প্রয়োজন.... এ কারণে সেসব দেশের সঙ্গে আমাদের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করতে হবে, যারা আমাদের চেষ্টায় সাহায্য করতে পারে। সৌদি আরব তেমন একটি দেশ।’
জেরুজালেমে গত বৃহস্পতিবার ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী ইয়ার লাপিদের সঙ্গে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকেরা বাইডেনকে প্রশ্ন করেন—সৌদি যুবরাজের সঙ্গে বৈঠকে তিনি খাসোগি হত্যাকাণ্ডের কথা তুলবেন কি না। সে প্রশ্নের সরাসরি জবাব না দিয়ে বাইডেন আবারও যুক্তি তুলে ধরেন—কেন তিনি সৌদি আরব যাচ্ছেন।
বাইডেন বলেন, ‘অশান্ত মধ্যপাচ্যের’ স্থিতিশীলতার জন্য এবং এ অঞ্চল যেন ‘চীন ও রাশিয়ার প্রভাব বলয়ে ঢুকে না পড়ে’, সেজন্য সৌদি আরবের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।
বাইডেন বলেন, ‘খাসোগির ব্যাপারে আমার অবস্থান সুস্পষ্ট। আমি কখনোই মানবাধিকারের প্রশ্নে চুপ থাকব না। কিন্তু, আমি সৌদি আরব যাচ্ছি যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থে, মধ্যপ্রাচ্যে আমাদের প্রভাব সংহত করার এটি একটি সুযোগ।’
এ ছাড়া বাইডেন সরাসরি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র যখন বিশ্বে তাদের প্রভাব ধরে রাখতে চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে লড়াইয়ে লিপ্ত, সেখানে ‘সৌদিদের অবজ্ঞা করলে মার্কিন স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হবে।’
বাইডেন বলেন, ‘এর সঙ্গে এখন মার্কিন স্বার্থ জড়িত। এ অঞ্চলে মার্কিন নেতৃত্ব অক্ষত থাকুক, আমি তা নিশ্চিত করতে চাই। এমন কোনো শূন্যতা যেন এখানে তৈরি না হয়, যেখানে রাশিয়া ও চীন তা পূরণ করে ফেলে।’
এটা অনস্বীকার্য যে—১৮ মাস ধরে হোয়াইট হাউসের সঙ্গে সম্পর্ক শীতল হয়ে যাওয়ায় সৌদিরা চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক বাড়িয়েছে। চীনের সঙ্গে সৌদি আরবের ব্যবসা ক্রমেই বাড়ছে। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে যুবরাজ সালমানের সম্পর্ক বেশ উষ্ণ।
এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র অবজ্ঞা করলেও দেশের ভেতর ক্ষমতা সংহত করতে সৌদি যুবরাজকে তেমন কোনো বেগ পেতে হচ্ছে না, এবং যুক্তরাষ্ট্র চায় বা না চায়—তিনিই যে মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এ দেশের বাদশাহ হচ্ছেন, তা নিয়ে তেমন কোনো সন্দেহ আর নেই।
তেল ইস্যু
বাইডেন প্রশাসনের একাংশের মধ্যে বেশ কিছুদিন ধরেই যুবরাজ সালমান ও সৌদি আরব নিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্টের অবস্থানের পরিণতি নিয়ে অস্বস্তি তৈরি হচ্ছিল।
ইউক্রেন সংকটের পর যুক্তরাষ্ট্রের তেলের বাজারে অস্থিরতা দেখা দেওয়ায় সে অস্বস্তি বেড়ে যায়। বাইডেনও বুঝতে পারছেন বাড়তি সৌদি তেল এখন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য জরুরি।
ওয়াশিংটন-ভিত্তিক গবেষণা সংস্থা মিডল-ইস্ট ইন্সটিটিউটের ভাইস প্রেসিডেন্ট ব্রায়ান কাটুলিস দ্য ওয়াশিংটন পোস্টকে বলেন, ‘ছেলেমানুষি কাটিয়ে বাইডেন প্রশাসন অভিজ্ঞ হতে শুরু করেছে। বিষয়টা এমন নয় যে, আপনি এ ব্যক্তিকে (যুবরাজ সালমান) ক্ষমতা থেকে সরাতে পারবেন। ফলে, জটিল এ পরিস্থিতি যতটা সম্ভব সামাল দিয়ে নিজের স্বার্থ দেখা... মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের এমন নীতির ভুরিভুরি নজির রয়েছে।’ অর্থাৎ, সৌদি আরবের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের গতানুগতিক পররাষ্ট্র নীতির পথে ফিরে গেছেন প্রেসিডেন্ট বাইডেন।
কিন্তু, অনেক পর্যবেক্ষক মনে করছেন—এর রাজনৈতিক মূল্য দিতে হতে পারে বাইডেনকে।
রাজনৈতিক মূল্য
ডেমোক্রেটিক পার্টির একাংশ চায় জো বাইডেন যেন সৌদি আরবে বিরোধীদের মুক্তির জন্য চাপ দেন। খাসোগি হত্যাকাণ্ডের বিচারের কথা তোলেন। ইয়েমেন যুদ্ধ বন্ধের জন্য চাপ দেন। নতুন করে অস্ত্র বিক্রির কোনো প্রতিশ্রুতি যেন না দেন। এগুলো না করলে দলের ভেতর চাপে পড়বেন জো বাইডেন।
বাইডেনের সমালোচকেরা বলছেন—তিনি আবার প্রমাণ করছেন, যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতার রাজনীতির মূলে রয়েছে সম্পদ ও তেল। মানবাধিকারকে পররাষ্ট্র নীতির মূলে রাখার যে প্রতিশ্রুতি বাইডেন দিয়েছিলেন, তা মিথ্যা প্রমাণ করছেন। এরপর কীভাবে তিনি একনায়কদের সমালোচনা করবেন?
গত সপ্তাহে কংগ্রেসের সিনিয়র ডেমোক্র্যাট অ্যাডাম শিফ বলেন, বাইডেনের জায়গায় থাকলে তিনি সৌদি আরবে এ সফর করতেন না বা যুবরাজ সালমানের সঙ্গে দেখা করতেন না।
দ্য ওয়াশিংটন পোস্টের প্রকাশক ফ্রেড রায়ান এক নিবন্ধে লিখেছেন, বাইডেন এখন “জেদ্দায় হাঁটু গেড়ে ‘একঘরে’ মানুষটির রক্তে রঞ্জিত হাতে হাত মেলাবেন।”
একই পত্রিকায় খাসোগির বাগদত্তা হাতিস চেনগিজ একটি উপ-সম্পাদকীয়তে প্রেসিডেন্ট বাইডেনকে উদ্দেশ করে লিখেছেন : ‘আপনি বিরোধীদের নির্যাতন করার জন্য, ইউক্রেনে যুদ্ধাপরাধের জন্য রাশিয়ার নিন্দা করেন। সৌদি আরবও একই রকম ভয়ংকর মানবাধিকার লঙ্ঘন করে চলেছে। তাদের কেন আপনি ছাড় দিচ্ছেন? তেলের জন্য?’
সৌদি আরব কী চায়
দেড় বছর ধরে হোয়াইট হাউসের কাছ থেকে অবজ্ঞায় যথারীতি নাখোশ ক্ষমতাধর সৌদি যুবরাজ। সে কারণেই ইউক্রেন যুদ্ধের পর পুতিনকে একঘরে করার মার্কিন চেষ্টায় তেমন সাড়া দেয়নি সৌদি আরব। তেলের উৎপাদন কিছুটা বাড়িয়েছে, কিন্তু বলার মতো তেমন নয়।
এপ্রিলে গবেষণা-ধর্মী সাময়িকী দি আটলান্টিকের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বাইডেনের সঙ্গে তাঁর ঠান্ডা সম্পর্ক নিয়ে এক প্রশ্নে সৌদি যুবরাজের উত্তর ছিল, ‘আমার তাতে বিন্দুমাত্র কিছু আসে যায় না।’ তিনি বলেন, সৌদি আরবকে অবজ্ঞা করলে ‘যুক্তরাষ্ট্রের জন্য তা হবে দুর্ভাগ্য এবং চীনের জন্য সৌভাগ্য।’
গবেষণা সংস্থা ওয়াশিংটন ইন্সটিটিউট অব নিয়ার ইস্ট পলিসির ডেনিস রস ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকাকে বলেন, সৌদি আরবে ক্ষমতার বিভিন্ন স্তরে কথা বলে তাঁর মনে হয়েছে—তাদের রাগ যে ‘যুক্তরাষ্ট্র কিছু চাইলে সঙ্গে সঙ্গে তারা ফোন করে, আমরা কিছু চাইলে তারা ফোনই ধরে না।’
গবেষণা সংস্থা আটলান্টিক কাউন্সিলের গবেষক এবং সাবেক গোয়েন্দা জনাথন পানিকফ বিবিসিকে বলেন, সৌদি আরব বাইডেন প্রশাসনের কাছ থেকে তাদের অবস্থান সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা চায়। ‘১৮ মাস ধরে কেউই জানে না, এ সম্পর্ক কোন দিকে যাবে। এটা একেবারেই সৌদি আরব পছন্দ করছে না।’
ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীদের সঙ্গে শান্তি মীমাংসা শুরুতে সৌদি আরব রাজি হয়েছে। কিন্তু, এর বদলে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা থেকে বাঁচতে শক্তিধর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা চায়।
এবং বাইডেনের সফরের ঠিক আগের দিন ইসরায়েলি বাণিজ্যিক ফ্লাইটের জন্য তাদের আকাশপথ উন্মুক্ত করে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে সৌদি আরব। যার ফলে, বাইডেন হলেন প্রথম কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্ট, যিনি সরাসরি তেল আবিব থেকে সৌদি আরবে গেলেন। কিন্তু, সৌদি আরবের জন্য বাইডেনের এ সফরের গুরুত্ব প্রধানত রাজনৈতিক।
সফরে কী হয়, তার চেয়ে বড় কথা সৌদি আরবে এসে বাইডেন তাঁর সঙ্গে কথা বলছেন—এমন একটি ছবি যুবরাজ সালমানের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সৌদি আরবকে সম্পূর্ণ নিজের ইচ্ছামতো যেভাবে পরিবর্তন করতে চাইছেন তিনি, বাইডেনের সফরকে তার একটি স্বীকৃতি হিসেবে দেখছেন সৌদি যুবরাজ। এরপর তিনি নিশ্চিতভাবে ভাবতে শুরু করবেন তাঁকে এবং তাঁর দেশকে অবজ্ঞা করা যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষেও সম্ভব নয়।