রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে হংকংয়ের গণতন্ত্রপন্থি কর্মীর ৪০ মাসের জেল
হংকং-এর গণতন্ত্রপন্থি কর্মী ‘ফাস্ট বিট’ নামে পরিচিত ট্যাম টাক চি-কে জনসাধারণের সামনে রাষ্ট্রদ্রোহী শব্দ ব্যবহার এবং উচ্ছৃঙ্খল আচরণের জন্য ৪০ মাসের জন্য জেল এবং পাঁচ হাজার হংকং ডলার জরিমানা করা হয়েছে।
পঞ্চাশ বছর বয়সি এ কর্মী ১৪টি অভিযোগের মুখোমুখি হয়েছেন, যার মধ্যে ঔপনিবেশিক যুগের রাষ্ট্রদ্রোহ আইনের অধীনে সাতটি অভিযোগ রয়েছে।
অভিযোগগুলোর মধ্যে রয়েছে রাষ্ট্রদ্রোহী শব্দ উচ্চারণ করার, অননুমোদিত সমাবেশ আহ্বান, জেনেশুনে একটি অননুমোদিত সমাবেশে অংশ নিতে প্ররোচনা দেওয়া এবং একজন সরকারি কর্মকর্তার দেওয়া আদেশ মানতে অস্বীকার করা। তিনি হংকং পুলিশের বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন অভিযোগ করা এবং তাদের ‘অভিশপ্ত পুলিশ’ হিসেবে বর্ণনা করে তাদের অপমান করার জন্যও অভিযুক্ত করা হয়েছিলেন বলে জানিয়েছে হংকং মিডিয়া।
গত মাসে তাঁর রায় দেওয়ার পর ট্যাম বলেছিলেন যে, কমিউনিস্ট পার্টি, কেন্দ্রীয় সরকার বা হংকং সরকারের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। ডিজে ও পিপল পাওয়ারের সাবেক এ ভাইস-চেয়ারকে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে গ্রেপ্তার করার পর থেকে তাঁকে পুলিশের হেফাজতে রাখা হয়েছিল। প্রাথমিকভাবে ৩১ মার্চ তাঁর রায় ঘোষণার কথা থাকলেও, কোভিড-১৯-এর পঞ্চম ঢেউয়ের কারণে বিচার বিভাগ ৭ মার্চ থেকে ১১ এপ্রিল পর্যন্ত মুলতবি ঘোষণা করা হয়েছল।
রায় ঘোষণার পর চ্যান বলেছিলেন, ‘আমরা সবাই জানি চীনা সংবিধানে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সাংবিধানিক অবস্থা। এমনকি কমিউনিস্ট পার্টি সম্পর্কিত শব্দগুলো মুছে ফেলার পরেও, আমি মনে করি যে, এখনও তাদের এসএআর সরকারকে দুর্বল করার লক্ষ্যে রাষ্ট্রদ্রোহী উদ্দেশ্য রয়েছে।’
এদিকে, হংকং ফ্রি প্রেসের প্রতিবেদন অনুসারে, চ্যান আদালতকে হংকংয়ের ‘সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’ বিবেচনা করতে বলেছিলেন। যদিও প্রতিপক্ষ বলেছিল, ট্যামের একটি ‘অকৃত্রিম আদর্শ’ ছিল এবং ধর্মতত্ত্বে তাঁর পটভূমি উদ্ধৃত করে প্রসিকিউশন চ্যানের বক্তৃতার অংশগুলো পড়ে শোনান এবং বলেন যে, তিনি ‘তাঁর তথাকথিত আদর্শের অন্তর্ভুক্তি কোথায় তা দেখতে পাননি।’
তবে চ্যান বলেছিলেন যে, অ্যাক্টিভিস্টের কথাগুলো ‘একজন ৫০ বছরের বৃদ্ধের সীমাহীন অপব্যবহারের’ মত শোনাচ্ছে। যদিও বিচারক বলেছিলেন যে, অপরাধটি সংঘটিত হওয়ার সময়টি বিবেচনা করতে হবে, কারণ সাতটি রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগের মধ্যে চারটি জাতীয় নিরাপত্তা আইন বাস্তবায়নের পরে হয়েছিল।
প্রসঙ্গত, তিব্বত, জিনজিয়াং এবং হংকং-এ যাঁরা এর মানবাধিকার রেকর্ড এবং এর দমন-পীড়নের সমালোচনা করেন, তাঁদের ভয় দেখানো, হুমকি দেওয়া এবং তাড়ানোর জন্য চীনা কমিউনিস্ট পার্টির বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়ে তাঁদের অবস্থান অনেক আগেই শক্ত করেছেন।
২০২০ সালের আইন পরিষদ নির্বাচনের জন্য একটি প্রাথমিক নির্বাচনে ভূমিকার জন্য জাতীয় নিরাপত্তা আইনের অধীনে বিচারের অপেক্ষায় থাকা ৪৭ জন গণতন্ত্রপন্থি ব্যক্তিত্বের মধ্যে ট্যাম একজন। ট্যামের সাবেক ডিজে অংশীদার, প্রাক্তন আইনপ্রণেতা রেমন্ড চ্যান পাবলিক গ্যালারিতে বসে থাকা ব্যক্তিদের মধ্যে ছিলেন। ট্যাম যখন ডকে পা রাখেন, তখন গ্যালারির সবাই উঠে দাঁড়ান এবং ট্যামের দিকে হাত নাড়ান।
এদিকে, একটি অননুমোদিত সমাবেশে অংশ নিতে উসকানি দেওয়ায় দুই বছর, রাষ্ট্রদ্রোহী শব্দ উচ্চারণের জন্য ২১ মাসের মধ্যে ১২টি, ১৮ মাসের মধ্যে তিনটি সহ, চ্যানের রায়ের পর ট্যামের মোট জেলের মেয়াদ ৪০ মাসে দাঁড়িয়েছে। অননুমোদিত সমাবেশ অনুষ্ঠিত করার জন্য, এবং একটি পাবলিক স্থানে উচ্ছৃঙ্খল আচরণের জন্য যোগ হয়েছে আরও এক মাস। অন্যদিকে, আদালতের অধিবেশন শেষ হওয়ার পরে ট্যাম চিৎকার করে তাঁর মাকে আরও বেশি দিন বেঁচে থাকার এবং নিজের যত্ন নিতে অনুরোধ করেছিলেন।
নিজের পক্ষে যুক্তি দেওয়ার আগে, চ্যান প্রসিকিউশনকে পাবলিক গ্যালারির মুখোমুখি ক্যাম রেকর্ডার প্রস্তুত করতে বলেছিলেন, কারণ তিনি ধারণা করছিলেন, সেখানে কোনো উচ্ছৃঙ্খল আচরণ ঘটার সম্ভাবনা থাকতে পারে।
ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত হওয়ার পর ট্যাম ঔপনিবেশিক যুগের রাষ্ট্রদ্রোহ আইনের অধীনে বিচারের মুখোমুখি হওয়া প্রথম ব্যক্তি। এ আইনটি ১৯৭০-এর দশকে সর্বশেষ সংশোধন করা হয়েছিল, হংকং তখনও ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে ছিল। রাষ্ট্রদ্রোহ আইনটি অপরাধ অধ্যাদেশের অধীনে পড়ে। এ আইনে প্রশাসনের বিরুদ্ধে সহিংসতা, অসন্তোষ এবং অন্যান্য অপরাধের জন্য উসকানিকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়। এ ছাড়া এ আইনে ২০২০ সালের জুনে প্রণীত জাতীয় নিরাপত্তা আইন, বিদ্রোহ, বিচ্ছিন্নতা, বিদেশি বাহিনীর সঙ্গে যোগসাজশ ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
জাতীয় নিরাপত্তা আইনের প্রণয়ন হওয়ার পর পুলিশ নতুন ক্ষমতা পেয়েছে। তবে, ডেমোক্র্যাট, সুশীল সমাজ গোষ্ঠী এবং বাণিজ্য অংশীদারদের জন্য এটি উদ্বেগজনক, কারণ এ ধরনের আইন চীনে ভিন্নমতাবলম্বীদের শাস্তি দেওয়ার জন্য ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে। তবে, কর্তৃপক্ষ বলছে এটি শহরে স্থিতিশীলতা ও শান্তি ফিরিয়ে এনেছে।
এদিকে, এনজিও হিউম্যান রাইটস ওয়াচের জ্যেষ্ঠ চীনা গবেষক মায়া ওয়াং, ট্যামের সাজার পর বলেছেন, এ সাজাটি হংকংয়ের স্বাধীনতাকে যে ক্ষীণ গতিতে ক্ষুণ্ন করা হচ্ছে, তা প্রকাশ করেছে। একসময় এশিয়ার প্রতিবাদের রাজধানী হিসেবে পরিচিত হংকং এখন শুধু স্লোগান দেওয়ার জন্য মানুষকে বছরের পর বছর কারাগারে সাজা দিচ্ছে—এমন মন্তব্যও করেছেন তিনি।