হংকংয়ে কি চীনের কঠোর জিরো-কোভিড নীতি প্রয়োগ হবে?
নভেল করোনাভাইরাসের ঢেউ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে হংকং। আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে থাকায় রোগীদের জায়গা দিতে পারছে না স্থানীয় হাসপাতালগুলো। হাসপাতালের বাইরেও শয্যা পেতে অনেককে চিকিৎসা দিতে হচ্ছে। বলা হচ্ছে, কোভিড-১৯ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে হংকংয়ের ‘অক্ষমতা’ নিয়ে হতাশ চীন। দ্য হংকং পোস্ট এ খবর জানিয়েছে।
প্রশ্ন উঠছে—যদি পরিস্থিতির উন্নতি না হয়, তাহলে কি দ্বীপরাষ্ট্রটিতে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির কঠোর জিরো-কোভিড নীতি প্রয়োগ করা হবে?
হংকংয়ের কোভিড-১৯ পর্যবেক্ষকেরা উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন—সামনের সপ্তাহে যদি করোনার সংক্রমণ কমে না আসে, তাহলে দ্বীপরাষ্ট্রটিকে ‘কোভিড লয়ালটি’ টেস্ট পাস করতে বলা হতে পারে। যেটি হিতে বিপরীত হতে পারে।
হংকং পোস্টের খবরে বলা হয়, নতুন করে ২২ জানুয়ারির পরে হঠাৎ করেই করোনা বাড়তে শুরু করেছে। বলা হচ্ছে—আক্রান্তের সংখ্যা প্রতিদিন যা দেখানো হচ্ছে, প্রকৃত সংখ্যা তার চেয়ে অনেক বেশি। পরীক্ষার সীমাবদ্ধতার কারণে সেটি সামনে আসছে না।
চীনের মূল ভূখণ্ড ও হংকংয়ের মধ্যে বৈসাদৃশ্য প্রথম দর্শনেই স্পষ্ট। সংবাদমাধ্যমের খবরে উঠে এসেছে—কীভাবে চিয়ানের শহরগুলো রাতারাতি ভূতুড়ে শহরে পরিণত হয়েছে। কারণ, পার্টির কর্মকর্তারা ও স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ, নিরাপত্তা বাহিনী নাগরিকদের কঠোর কোয়ারেন্টিনে বাধ্য করেছিল। লোকজন দুধ ও রুটির মতো মৌলিক বিষয়গুলো নিয়েও চিন্তিত ছিল। লাখ লাখ লোককে বারবার পরীক্ষা করতে বলা হয়েছিল এবং নেগেটিভ না হওয়া পর্যন্ত কোয়ারেন্টিন তুলে নেওয়ার কোনো প্রশ্নই ছিল না।
বিপরীতে, হংকং এখনও একটি ব্যস্ত মহানগর। দ্বীপরাষ্ট্রটিকে আর্থিক ও বাণিজ্যের কেন্দ্র হিসেবে মর্যাদা দিতে নগর সরকার কঠোর লকডাউনের বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। লকডাউন হংকংয়ের অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দিতে পারে এবং সে দেশের বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা নিশ্চিহ্ন করে দেবে।
হংকংয়ের হাসপাতালগুলোতে এখন নজিরবিহীন অবস্থা চলছে। হাসপাতালে ভর্তি হতে আসা কোভিডে আক্রান্তদের সামাল দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। তাদের সেবা দিতে গিয়ে ভারাক্রান্ত হচ্ছেন স্বাস্থ্যকর্মীরাও। লোকজনকে করোনা পরীক্ষার জন্য দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। কর্তৃপক্ষ সাধারণ লকডাউন, ছোট পরিসরে লকডাউন, স্ট্রিট বা ভবন লকডাউন দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। কিন্তু কোনো কিছুতেই কাজ হচ্ছে না। জনগণ কোভিড-১৯ পরীক্ষা করানো এবং হাসপাতালে ভর্তি হওয়া নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়েছে।
গবেষকেরা সতর্ক করেছেন যে, গ্রীষ্মের মধ্যে করোনার সর্বশেষ ঢেউয়ে প্রায় এক হাজার মানুষের মৃত্যু হতে পারে, যা গত দুই বছরে হংকংয়ে কোভিডে মারা যাওয়া সংখ্যার চার গুণেরও বেশি।
গণমাধ্যম প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে যে, হংকং কর্তৃপক্ষের দুর্বল প্রতিক্রিয়া করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সক্ষমতার একটি গুরুত্বপূর্ণ দুর্বলতা প্রকাশ করেছে। যেখানে অন্যান্য দেশ ওমিক্রনের ঢেউ মোকাবিলা করছে, সেখানে একটি আধা-স্বায়ত্তশাসিত চীনা শহর হিসেবে হংকং করোনাভাইরাসের সঙ্গে বসবাস করতে পারে না। বেইজিং বরাবরই স্থানীয়ভাবে করোনা নির্মূলের কথা বলে আসছে। তবে শহরটি, যা মূল ভূখণ্ডে কিছু স্বাধীনতা ভোগ করে, বেইজিংয়ের সম্পূর্ণ কর্তৃত্ববাদী টুল কিট বা প্রায় সীমাহীন জনবল যেকোনো মূল্যে সংক্রমণ বন্ধ করতে পারে না।
হংকংয়ের চীনপন্থি নেতা ক্যারি লামও জিরো-কোভিড নীতি বাস্তবায়নের জন্য মূল ভূখণ্ড থেকে ক্রমবর্ধমান চাপে রয়েছেন। কিন্তু, তিনি যা খোলাখুলি বলছেন না, তা হলো—মূল ভূখণ্ড ভাইরাস থেকে পরিত্রাণ পেতে শহর প্রশাসনকে কঠোর কমিউনিস্ট মডেল বাস্তবায়ন করতে বাধ্য করছে।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞেরা উদ্বেগের সঙ্গে বলছেন—শহরব্যাপী বাধ্যতামূলক পরীক্ষার মতো ব্যবস্থা চালু হলে তা হংকংয়ে কাজ করবে না এবং সরকারের প্রতি এরই মধ্যে গভীর অবিশ্বাসী জনসাধারণের মধ্যে ব্যাপারটি নতুন করে ক্ষোভের সঞ্চার করতে পারে।
গণমাধ্যম বিশ্লেষকেরা বলছেন—বেইজিং জাতীয় নিরাপত্তা আইন দিয়ে ব্যাপক দমন-পীড়নের মাধ্যমে হংকংজুড়ে ভিন্নমতের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখে।
এদিকে, হংকং কর্তৃপক্ষের একটি অংশের ‘কঠোর বিধিনিষেধ গ্রহণ’ করার আগ্রহকে ‘বেইজিংয়ের প্রতি (তাদের) আনুগত্যের মহড়া’ হিসেবে দেখা হচ্ছে। বেইজিংয়ের বেইহাং ইউনিভার্সিটির আইনের অধ্যাপক তিয়ান ফেইলং হংকংয়ে অধ্যয়ন করছেন। তিনি বলেছেন, “হংকংয়ের অ্যান্টিভাইরাস কৌশলের ফাঁকফোকরে প্রকাশ পাচ্ছে যে, কিছু কর্মকর্তা ‘দৃঢ় দেশপ্রেম’ দেখাচ্ছেন না।”
অধ্যাপক তিয়ান ফেইলং বলেন, হংকংয়ের প্রায় ১৫ হাজার লোক করোনা পরীক্ষায় পজিটিভ হয়েছে। তারা হাসপাতালে ভর্তি বা পাবলিক আইসোলেশন ইউনিটের জন্য দৌড়াচ্ছে। পরিস্থিতি উদ্বেগজনক হয়ে উঠেছে। কারণ, পাঁচ মাসের ব্যবধানে কোনো মৃত্যুর খবর না থাকার পরে, হঠাৎ করে দ্বীপ-শহরটি এক সপ্তাহের মধ্যে কয়েক ডজন মৃত্যুর সাক্ষী হয়েছে।