বোনের কঙ্কালের সঙ্গে এক বাড়িতে ছয় মাস
বোনের মৃত্যু হয়েছে প্রায় ছয় মাস আগে। কিন্তু সেই মৃতদেহের সৎকার করেননি ভাই। মৃতদেহের সঙ্গেই এক ছাদের তলায় দিন কাটাচ্ছিলেন তিনি। বোনের কঙ্কালকে নিয়ম করে খাবার দেওয়া হতো। খাওয়ার ব্যবস্থা ছিল বাড়িতে রাখা দুটি পোষা কুকুরের কঙ্কালের জন্যও।
এ ঘটনা সহ্য করতে না পেরে গতকাল বুধবার রাতে বাথরুমে ঢুকে গায়ে আগুন ধরিয়ে আত্মহত্যা করেন বৃদ্ধ বাবা। আর তারপরেই দেখতে পাওয়া চাঞ্চল্যকর এই ঘটনা জনসম্মুখে আসে। প্রাথমিক তদন্তের পর পুলিশ এ কথা জানিয়েছে।
পুলিশ ধারণা করছে, ঘটনায় অভিযুক্ত ভাই পার্থ দে মানসিক ভারসাম্যহীন। কলকাতার প্রায় কেন্দ্রে অবস্থিত শেকসপিয়র সরণির এ ঘটনা চাঞ্চল্য ছড়িয়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানায়, গতকাল বুধবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে শেকসপিয়র সরণির একটি বাড়ির দোতলা থেকে ধোঁয়া বেরোতে দেখেন এলাকার মানুষ। তাঁরাই খবর দেন ফায়ার সার্ভিসে। এরপর পুলিশ গিয়ে ওই বাসার ভেতর থেকে বন্ধ করা একটি বাথরুমের বাথটাব থেকে অরবিন্দ দে (৭৭) নামে এক বৃদ্ধের অগ্নিদগ্ধ মরদেহ উদ্ধার করে। মৃতদেহটি জামাকাপড়ে মোড়ানো ছিল। সেখানে বিভিন্ন দাহ্য পদার্থও পাওয়া গেছে। এ ছাড়া এ সময় বাড়িতে আর কেউ ছিলেন না। তাই প্রাথমিকভাবে পুলিশ ধারণা করে আত্মহত্যা করেছেন ওই বৃদ্ধ।
বৃদ্ধের দেহটি উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়ার পরে ওই বাড়ির সামনে দুজন পুলিশকে প্রহরায় রাখা হয়েছিল। রাত সাড়ে ১২টার দিকে পার্থ দে বাড়ি ফিরে এলে আত্মহত্যার এই ঘটনা অন্যদিকে মোড় নেয়। দুই পুলিশ সদস্যকে বাইরে বসে থাকতে দেখে পার্থ কিছুটা অস্বাভাবিক আচরণ শুরু করেন। পুলিশ জানিয়েছে, ঘরে ঢুকে পার্থ দেয়ালে ঘুষি মেরে, চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করেন। দুই কনস্টেবলকে মারতে গেলে পুলিশ তাঁকে ধরে থানায় নিয়ে যায়। এরপরই পার্থ পুলিশকে জানান, ওই বাড়িতে তিনটি কঙ্কাল রয়েছে। সেগুলোর একটি তাঁর বোন দেবযানী দের, বাকি দুটি বাড়ির কুকুরের। তিনি আরো জানান, পেশায় তাঁর বোন ছিলেন গানের শিক্ষিকা।
পুলিশ জানায়, দেবযানীর কঙ্কালটি একটি খাটের ওপরে সাদা কাঁথা দিয়ে মোড়ানো ছিল। ওই ঘরের তাপমাত্রা ছিল স্বাভাবিকের চেয়ে নিচে। সেই ঘরে থাকতেন পার্থও। খাটের নিচে পাওয়া গেছে খাবারের স্তূপ। ভাত, স্যুপ থেকে শুরু করে কেএফসির পিৎজা সবই আনা হয়েছিল মৃত বোনের জন্য। আর দুটি কুকুরের মরদেহ পাওয়া গেছে পাশের আরেকটি ঘরে। সেখানেও নিয়ম করে খাবার দিয়েছেন পার্থ।
পুলিশ জানিয়েছে, মাস ছয়েক আগে পার্থ একটি বহুজাতিক তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থায় কাজ করতেন। তবে প্রতিবেশীদের বরাতে পুলিশ জানিয়েছে, বেশ কিছু দিন ধরে তিনি আর অফিসে যেতেন না। বাড়িতেই থাকতেন।
পুলিশ সূত্রে খবর, জেরায় পার্থ জানিয়েছেন, তাঁর দিদি যে মারা গিয়েছেন তা তিনি মানেন না। সেই কারণেই তিনি তাঁর দিদির মৃত্যুর পর দেহটি কাপড় দিয়ে জড়িয়ে খাটে শুইয়ে রেখেছিলেন। আর সেই মৃতদেহকে খাওয়ানোর জন্য রোজ খাবার দিতেন।
জিজ্ঞাসাবাদ থেকে পাওয়া তথ্যের বরাতে পুলিশ আরো জানিয়েছে, ২০১৪ সালের আগস্ট মাসে কিছুদিনের ব্যবধানে ওই বাড়ির দুটি কুকুরের মৃত্যু হয়। কুকুর দুটি বড় আদরের ছিল বাড়ির সদস্যদের কাছে। এই ঘটনার মাস কয়েক পরেই মৃত্যু হয় দেবযানীর। তিনি অপুষ্টিতে ভুগছিলেন। উপবাসেই তাঁর মৃত্যু হয়েছে বলে পুলিশকে পার্থ জানান।
পুলিশ আরো জানায়, মৃত বোনকে কেবল খাওয়াতেনই না পার্থ, বাড়িতে তাঁর উপস্থিতি যাতে উপলব্ধি করা যায় সেই কারণে পেন ড্রাইভের মাধ্যমে দেবযানীর বিভিন্ন কণ্ঠস্বর স্টোর করে রেখেছিলেন। তদন্তে গিয়ে পুলিশ শুনতে পায়, কোনোটায় দেবযানী পার্থকে খেতে ডাকছে, কোনোটায় ঘুম থেকে ওঠাচ্ছে, কোনোটায় আবার ঝগড়া করছে। এই সাউন্ডক্লিপগুলো বাড়ির বিভিন্ন জায়গায় থাকা ‘সাউন্ড সিস্টেমে’ সেট করে নিয়েছিলেন, পেশায় কম্পিউটার বিশেষজ্ঞ পার্থ। যাতে তিনি অনুভব করতে পারেন যে বাড়িতে তাঁর দিদি রয়েছেন।
প্রাথমিক তদন্তের পর পুলিশের অনুমান, মানসিকভাবে সুস্থ নন পার্থ দে। সেই কারণেই বেসরকারি সংস্থার চাকরি ছাড়তে হয়েছিল তাঁকে। এদিকে গোটা ঘটনার তদন্ত শুরু করেছে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের হোমিসাইড বিভাগ। হোমিসাইড বিভাগের এক কর্মকর্তা এনডিটিভিকে জানিয়েছেন, তিনটি কঙ্কালের এবং বৃদ্ধের ফরেনসিক ও ময়নাতদন্ত হবে। তখনই বোঝা যাবে কখন কার মৃত্যু হয়েছে এবং মৃত্যুর কারণ কী? পাশাপাশি, পার্থ কীভাবে মৃতদেহগুলোর সঙ্গে থাকতেন সে ব্যাপারেও জানতে পুলিশ অপরাধবিজ্ঞানী ও চিকিৎসকদের শরণাপন্ন হয়েছে।