মিনায় বিলাসী কক্ষ, সৌদি সরকারের নিষেধাজ্ঞা
প্রতি বছর নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে সৌদি আরবে হজ করতে যান বিশ্বের লাখো মুসল্লি। হজের আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে থাকে মিনায় অবস্থান। শুরু থেকেই মিনায় তাঁবুতে বাস করে আসছিলেন মুসল্লিরা। সেখানে হজযাত্রীদের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ করা হতো না। তবে এবার কিছুটা ভিন্নতা এসেছে। এবার উচ্চবিত্ত হজযাত্রীদের জন্য কিছুটা বিলাসী আবাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছিলে। রাতপ্রতি এর জন্য গুনতে হয় সাত হাজার ডলার (প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা)!
তবে এতেও আপত্তি ছিল না অনেক হজযাত্রীর। কিন্তু বাঁধ সেধেছে সৌদি আরবের সরকার। সরকার বলছে, মিনায় এসে এভাবে বিলাসী জীবন যাপন করাটা হজের উদ্দেশ্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তাই ব্যক্তিগত মালিকানায় গড়ে ওঠা বিভিন্ন ভিআইপি ক্যাম্প নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
যে আবাসনকে বিলাসী বলা হচ্ছে সেটি কেমন? এটি আসলে দুই মিটার দৈর্ঘ্য আর দুই মিটার প্রস্থের ছোট একটা ছিমছাম বহনযোগ্য কক্ষ। যেটাকে টেনে এনে বালির মধ্যে বসিয়ে দেওয়া যায়। এর ভেতরে আছে দুটি বিছানা আর ছোট্ট একটা কেবিনেট।
গতকাল হজের প্রথম দিনে মিনায় হাজারো মানুষ তাবুর নিচে থাকতে শুরু করেছেন। তাই এ সময় মিনাকে বলা হয় বিশ্বের সবচেয়ে বড় তাবুর নগরী। হজের সময় ছাড়া সারা বছর মিনার মরুভূমি ও ময়দানগুলো খালি পড়ে থাকে। তবে হজের অংশ হিসেবে এই সময় বিশ্বের লাখ লাখ মুসলমান এই ময়দানে অবস্থান করেন।
মিনায় এসে সবাইকে মুসাফিরের মতো থাকতে হয়। বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে আসা বিভিন্ন শ্রেণি পেশার হজযাত্রীরা এখানে এসে একাকার হয়ে যান। নাগরিক জীবনের সব সুযোগ সুবিধা ছেড়ে এসে শ্রেণি বিভেদ ভুলে সবাই একই রকমভাবে নির্ধারিত সময় পর্যন্ত বাস করেন।
হজযাত্রীদের বেশির ভাগই তাঁবুতে বাস করেন। মিনার মরু উপত্যকায় এক লাখেরও বেশি সাদা তাঁবু সারিবদ্ধভাবে সাজানো থাকে। এসব তাঁবুর বেশিরভাগেই ধারণ ক্ষমতা ৫০ জন। আর এই তাঁবুতে রাত কাটাতে প্রতি হজযাত্রীকে গুনতে হয় গড়ে ৫০০ ডলার।
তবে এ বছর কিছুটা ব্যতিক্রম ঘটেছে। মিনার তাঁবুর শিবিরে যোগ হয়েছে সাত হাজার ডলার মূল্যের ভিআইপি কক্ষ। ২৪ ঘণ্টা বুফে খাওয়া আর লন্ড্রি সার্ভিসসহ এই একটি কক্ষের খরচ পড়বে প্রায় ১০ হাজার ডলার। সৌদি আরবের ব্যবসায়ী সাদ কুরাইশি এই কক্ষের ব্যবস্থা করেছেন। এর মধ্যে একটি আবার জর্ডানের এক মন্ত্রীর জন্য সংরক্ষিতও রাখা হয়েছে। যদিও সাদা বিবর্ণ রঙের দেয়াল আর ছোট্ট শৌচাগারসহ উচ্চমূল্যের এই কক্ষ কোনোদিক থেকেই পাঁচ তারকা হোটেলের মতো নয়।
এর আগে কখনই হজে এই রকম বিলাসী কক্ষ স্থাপন করা হয়নি। তবে সৌদি আরবের হজ মন্ত্রণালয় এই বিলাসবহুল ভিআইপি স্থাপনা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। মন্ত্রণালয় বলছে, এই ধরনের ক্যাম্প বা স্থাপনা হজের উদ্দেশ্যর সঙ্গে সাংঘর্ষিক। যা আসলে হওয়া উচিত আল্লাহর প্রতি আনুগত্য দেখানো ও সহনশীল আচরণ করা।
ভিআইপি এই ক্যাম্পটি সাধারণ ক্যাম্পের তুলনায় জায়গাও বেশি নিচ্ছিল। তবে এই ভিআইপি ক্যাম্প স্থাপনের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার ব্যাপারে চেষ্টা করে যাচ্ছেন কিছু ব্যবসায়ী। এমনকি নিজেদের ক্যাম্পের চারদিকে অস্থায়ী দেয়াল তুলে তাদের গ্রাহকদের গোপনীয়তা ও অনন্যতা দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছেন তাঁরা।
মিনার একটি হজ ক্যাম্পের কর্মী আল জাজিরাকে বলেন, ‘এটা খুবই ভয়ানক ও সৌদি আরবের সাধারণ আইনের পরিপন্থী। কারণ ধরুন হঠাৎ করে আগুন লেগে গেলে এসব ভিআইপি ক্যাম্পের দেয়ালের কারণে পানি ছিটানোর কাজ বাধাগ্রস্ত হবে।’
১৯৯৭ সালে হজের সময় মিনায় তাঁবুতে হঠাৎ আগুন লেগে গেলে সে সময় শতাধিক মানুষ মারা যান। এই বিষয়টি এখনো সৌদি আরবের কর্তৃপক্ষকে ভাবায়। এরপর থেকে পুরনো তাঁবুর বদলে ফাইবার গ্লাস দিয়ে মোড়ানো এবং তাপ সহনশীল পদার্থ দিয়ে তাঁবু তৈরি করা হয়। আর এসব তাঁবুতেই মিনায় রাত কাটান হজযাত্রীরা।
এদিকে মিনার তাঁবু ও পাথুরে পাহাড়ের মাঝে দেশটির সরকারের পক্ষ থেকে ছয়টি একই রকমের টাওয়ার তৈরি করা হয়েছে। এতে বেশি সংখ্যক হজযাত্রীর স্থান সংকুলান হচ্ছে। সৌদি আরবের সরকার সবসময়ই মিনার পরিবেশ ও প্রকৃতি আগের মতই রাখতে চায়। কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এটা করা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। সে জন্যই এই টাওয়ার নির্মাণ করা হয়েছে। এই টাওয়ারের প্রতিটিতে দেড় হাজার হজযাত্রী থাকতে পারেন। আর প্রতিটি কক্ষের জন্য ভাড়া গুনতে হবে তিন হাজার ডলার।