তুরস্কে সেনা অভ্যুত্থানচেষ্টা ব্যর্থ
তুরস্কের সেনাবাহিনীর একাংশের অভ্যুত্থানের চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। দেশটির প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের আহ্বানে রাস্তায় নেমে অভ্যুত্থান চেষ্টাকারী সেনাদের রুখে দিয়েছেন তাঁর সমর্থকরা। আংকারা, ইস্তাম্বুলসহ বিভিন্ন শহরে আত্মসমর্পণ করছেন অভ্যুত্থানে জড়িত সেনারা।
সর্বশেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত অভ্যুত্থানচেষ্টার ঘটনায় ৯০ জন নিহত এবং এক হাজার ১৫৪ জন আহত হয়েছেন। আর অভ্যুত্থানে জড়িত সন্দেহে আটক হয়েছেন এক হাজার ৫৬৩ সেনা।
স্থানীয় সময় গতকাল শুক্রবার রাতে তুরস্কে সেনাবাহিনীর একটি অংশের অভ্যুত্থান চেষ্টা শুরু হয়। তুরস্কে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল এনটিভিকে অভ্যুত্থানচেষ্টার কথা প্রথম জানান দেশটির প্রধানমন্ত্রী বিনাইল ইলদিরিম। ওই সময় তিনি বলেন, ‘শৃঙ্খলা ভেঙে কিছু লোক অবৈধ পদক্ষেপ নিয়েছে। যারা অভ্যুত্থানের চেষ্টা করেছে তাদের চড়া মূল্য দিতে হবে।’
শুক্রবার রাতে তুরস্কের টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর খবরে জানা যায়, ইস্তাম্বুলের বসফরাস সেতুতে যান চলাচল বন্ধ করে দেন অভ্যুত্থান চেষ্টাকারী সেনারা। রাজধানী আংকারা এবং বড় শহর ইস্তাম্বুলসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ অনেক স্থানে ট্যাংক মোতায়েন করা হয়। আংকারার আকাশে যুদ্ধবিমান ও হেলিকপ্টার উড়তে দেখা যায়।
তুরস্কের একটি টেলিভিশন চ্যানেলে অভ্যুত্থান চেষ্টাকারী সেনাদের বিবৃতি সম্প্রচার করা হয়। এতে বলা হয়, দেশের পুরো ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হয়েছে। তবে সেনাদের এই অংশের নেতৃত্বে কে বা কারা রয়েছে তা অজানাই রয়ে যায়।
শুক্রবার রাতে বিবিসি জানায়, ইস্তাম্বুলে পুলিশ সদর দপ্তরের বাইরে গুলির শব্দ শোনা গেছে এবং ইস্তাম্বুল বিমানবন্দরের বাইরে ট্যাংক মোতায়েন করা হয়েছে। বিমানবন্দরের সব ফ্লাইট বন্ধ রাখা হয়েছে। ওই সময় সংবাদমাধ্যম সিএনএন তুর্ক জানায়, প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান নিরাপদে আছেন।
তুরস্কে অভ্যুত্থানের খবরের কিছুক্ষণের মধ্যেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক, টুইটার ও ইউটিউবের ওপর কড়াকড়ি আরোপ করা হয়।
অভ্যুত্থানচেষ্টার কয়েক ঘণ্টা পর উপকূলীয় শহর মারমারিস থেকে ইস্তাম্বুল বিমানবন্দরে অবতরণ করেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট। সেনাবাহিনীর একাংশের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানচেষ্টার অভিযোগ এনে তিনি জনগণকে রাস্তায় নেমে সেনাদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভের আহ্বান জানান।
সংবাদমাধ্যম সিএনএন টার্ককে মুঠোফোনে এরদোয়ান বলেন, সেনা অভ্যুত্থান করে ক্ষমতা নেওয়ার প্রতিবাদে জনগণকে উন্মুক্ত জায়গায় নামতে হবে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট আরো বলেন, খুব শিগগির অভ্যুত্থানচেষ্টার অবসান হবে। এর সঙ্গে জড়িতদের চড়া মূল্য দিতে হবে।
ওই সময় এরদোয়ান অভিযোগ করেন, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আলেম ফেতুল্লাহ গুলেনের অনুসারীরা এ অভ্যুত্থানচেষ্টা করছে। গুলেনের বিরুদ্ধে বিচার বিভাগ ও সেনাবাহিনীতে অভ্যুত্থানের প্ররোচনা দেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে।
তবে পরবর্তীকালে ফেতুল্লাহ গুলেন সেনা অভ্যুত্থানের নিন্দা করে বিবৃতি দেন এবং এতে কোনোভাবে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেন।
অভ্যুত্থানের চেষ্টাকারী তুরস্কের সেনাবাহিনীর একাংশ মার্শাল ল (সেনাশাসন) ঘোষণা দিয়ে সারা দেশে কারফিউ জারি করে। তবে এরদোয়ানের আহ্বানে সেনা কারফিউ ভেঙে অভ্যুত্থানচেষ্টাকারীদের বিরুদ্ধে রাস্তায় নামেন তাঁর সমর্থকরা। কয়েক হাজার তুর্কি ইস্তাম্বুলের ঐতিহাসিক সব স্থাপনার সামনে জড়ো হন। ইস্তাম্বুলের তাকসিম স্কয়ারে অনেক তুর্কি জড়ো হন, যাঁদের হাতে ছিল জাতীয় পতাকা।
রাস্তায় নামা তুর্কিরা সেনাবিরোধী স্লোগান দেন। অনেকেই ট্যাংকের ওপর উঠে বিক্ষোভ করেন। ইস্তাম্বুল ছাড়াও রাজধানী আংকারাসহ অন্যান্য শহরে বিক্ষোভের খবর পাওয়া যায়। তুরস্কের টেলিভিশনের এক ভিডিওতে দেখা যায়, বসফরাস ব্রিজের ওপর থাকা জনগণ গুলি থেকে বাঁচতে রাস্তায় শুয়ে পড়ে। এ সময় জোরে গুলির শব্দ শোনা যায়।
তুরস্কের গণতান্ত্রিক সরকারের প্রতি সমর্থন জানিয়ে দেশটির সব দলের প্রতি আহ্বান জানায় যুক্তরাষ্ট্র। একই সঙ্গে সব ধরনের সহিংসতা বন্ধের আহ্বান জানানো হয়। যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি সামরিক জোট ন্যাটো এবং অপর বিশ্বনেতারা তুরস্কের গণতান্ত্রিক সরকারের প্রতি সমর্থন জানান।
তুরস্কে অভ্যুত্থানের চেষ্টাকারী সেনাদের একটি অংশ আজ শনিবার ইস্তাম্বুলের বসফরাস সেতুতে আত্মসমর্পণ করেন। শুক্রবার দিবাগত রাতে অভ্যুত্থানের চেষ্টার পর থেকেই রাতভর সেতুটিতে অবস্থান করছিলেন ওই সেনারা।
তুরস্কের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের ছবিতে দেখা যায়, প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের সমর্থকরা সেনাদের ফেলে যাওয়া একটি ট্যাংকের ওপর উঠে উল্লাস করছে। এ সময় ওই সমর্থকরা তুরস্কের পতাকা ওড়ায় এবং বিজয় চিহ্ন দেখায়। অনেকে আবার ব্রিজের এদিক-ওদিকে ছুটে উল্লাস প্রকাশ করে।
তুরস্কের টেলিভিশন চ্যানেল এনটিভি জানিয়েছে, আংকারার প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের কাছে শনিবার সকালে অভ্যুত্থানের চেষ্টাকারী সেনাদের লক্ষ্য করে বিমান থেকে গুলিবর্ষণ করা হয়েছে। ওই এলাকায় থেকে ধোঁয়া উঠতে দেখা যায়।
সেনাবাহিনীর একাংশের অভ্যুত্থানচেষ্টার পর থেকেই ভারপ্রাপ্ত সেনাপ্রধান নিয়োগ করেছে তুরস্ক। স্থলবাহিনীর একটি অংশ ফার্স্ট আর্মির প্রধান উমিত দুন্দারকে ভারপ্রাপ্ত সেনাপ্রধান নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ওই সময় বর্তমান সেনাপ্রধানের হুলুসি আকারের কোনো খবর পাওয়া যাচ্ছিল না। কিছু গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়, স্থানীয় সময় শুক্রবার রাতে সেনা অভ্যুত্থানের শুরুর দিকে হুলুসিকে জিম্মি করা হয়।
শনিবার সকালে তুরস্কের রাজধানী আংকারার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় আকিনসি বিমানঘাঁটি থেকে দেশটির সেনাপ্রধান জেনারেল হুলুসি আকারকে উদ্ধার করা হয়েছে।
শনিবার সকাল থেকেই তুরস্কে সেনাদের বিভিন্ন স্থানে আত্মসমর্পণ এবং আটকের খবর আসতে থাকে। অভ্যুত্থানচেষ্টায় জড়িত থাকার অভিযোগে এক হাজার ৫৬৩ সেনাকে আটক করা হয়েছে। তুর্কি এক কর্মকর্তার বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা এএফপি আরো জানায়, দেশটির ২৯ কর্নেল এবং পাঁচ জেনারেলকে পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
শনিবার সকালে তুরস্কের বিভিন্ন স্থানে সেনাবাহিনীর ট্যাংকের ওপর সাধারণ মানুষের দখল দেখা গেছে। এ ছাড়া ইস্তাম্বুলের সড়কে ছড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে সেনাসদস্যদের পোশাক, হেলমেটসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক দ্রব্য। কোথাও কোথাও সেনাদের পিটিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের সমর্থকরা।
সেনা অভ্যুত্থানের পর তুরস্কের পার্লামেন্টে বিশেষ অধিবেশনের ঘোষণা দিয়েছে তুরস্ক সরকার। তুরস্কের গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে বিশেষ বাহিনীর সদস্য মোতায়েন আছে।