অভিবাসী প্রবেশ বন্ধে ‘ডুবে মরা’ নীতি ইউরোপের
গত মাসে মাত্র ১০ দিনের মধ্যে প্রায় দেড় হাজার অভিবাসী ভূমধ্যসাগরে ডুবে মরেছে। এদের মধ্যে আছে সিরিয়া, ইরিত্রিয়া ও সোমালিয়া থেকে আসা মানুষ, যারা যুদ্ধের ভয়াবহতা ও অপশাসনের হাত থেকে বাঁচতে চেয়েছিল। তাঁদের এই মৃত্যু ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) মানবিক ও রাজনৈতিক ব্যর্থতা।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, ১০ লাখের বেশি অভিবাসী ভূমধ্যসাগরের দক্ষিণ তীরে অপেক্ষা করছে। ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে যাওয়ার লক্ষ্যে যেকোনো মুহূর্তে তারা নৌকায় উঠবে। তাদের সামনে সেখানকার চেয়ে নিরাপদ জীবনের হাতছানি। কারণ এক দশক ধরেই আরব বিশ্বে যুদ্ধ চলছে। যা এই অঞ্চলের শান্তি বিঘ্নিত করেছে আর এখানকার মানুষ নিরাপত্তাহীন জীবন থেকে বেরিয়ে আসতে চায়। তা ছাড়া আফ্রিকায় যুদ্ধ বিগ্রহ আর বিভিন্ন জাতিগত সহিংসতার পাশাপাশি আছে পরিবেশ বিপর্যয়।
অভিবাসী ডুবে মরা রুখতে কিছু করতে ইইউ নেতারা সম্মেলন আয়োজন করে। উদ্ধার অভিযান পরিচালনা, পাচারকারীদের রোখা ও অভিবাসীদের চাপ ভাগাভাগি করে নিতে তাঁদের সামনে ১০টি বিষয়ে পরিকল্পনা উপস্থাপন করা হয়। ইইউ নেতারা এই পরিকল্পনা মেনে নিলেও বাদ রয়ে যাবে বেশ কিছু বিষয়।
অভিবাসী সমস্যার মোকাবিলা কঠিন। কারণ যুদ্ধ, হত্যা ও অপশাসনের সঙ্গে এটি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে। এসব বন্ধ না হলে অভিবাসীদের জোয়ার কেউ থামিয়ে রাখতে পারবে না। ভূমধ্যসাগরের এই পারের পক্ষে লিবিয়া ও সিরিয়ার শান্তি ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। একইভাবে সম্ভব নয় ইরিত্রিয়া, সোমালিয়ায় সুশাসন প্রতিষ্ঠা। অন্যদিকে সব উদ্বাস্তুকেই ইউরোপে প্রবেশ করতে দেওয়া যায় না। ইউরোপের কোনো দেশই চায় না অভিবাসীরা ভাগ্য ফেরাতে তাদের সাধারণ জনগণের সঙ্গে মিশে যাক। ইউরোপের দেশগুলো নিজেরা অভিবাসী বেছে নিতে চায়, অভিবাসীদের মাধ্যমে বাছাই হতে চায় না। আবার সব অভিবাসী ফেরত পাঠানোও সম্ভব নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে একটি বিষয়ে ইউরোপে সচেতনতা তৈরি হয়েছে—সাধারণ মানুষকে যুদ্ধের শিকার হয়ে মৃত্যুর জন্য ফেলে রাখা যাবে না।
নৌযানের অভিবাসীদের নিরাপত্তায় ইউরোপের দেশগুলো ব্যর্থ। ইউরোপের জন্য এটি মূল্যবোধের অবক্ষয়। সমুদ্রে উদ্ধার অভিযানে গত বছরের তুলনায় তিনভাগের একভাগ অর্থ ও দশভাগের একভাগেরও কম জনশক্তি ব্যবহার করেছে। এর পক্ষে ব্রিটেনসহ ইউরোপের কয়েকটি দেশের যুক্তি হলো, ব্যাপক উদ্ধার অভিযান অবৈধ অভিবাসীদের উদ্বুদ্ধ করবে। এ জন্যই ইউরোপের প্রস্তাব হলো, অভিবাসীদের নৌযান থেকে দূরে থাকা এবং অনেক মানুষকে ডুবে মরতে দেওয়া, যেন অভিবাসী প্রবেশ বন্ধ হয়।
এই যুক্তি শুধু যে ভুল তাই নয়, নৈতিকভাবেও অপ্রীতিকর। আর গত বছরের ও চলতি বছরের বর্তমান সময় পর্যন্ত হাজারো মৃত্যু সত্ত্বেও অভিবাসীদের নৌযানে ঝুঁকি নিয়ে ইউরোপের যাওয়ার প্রবণতা বা সংখ্যা কমেনি।
ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে কিছুটা হলেও কষ্ট ভাগাভাগি করে নেওয়ার বিষয়টি দেখা যায়। জাতিসংঘের সনদ অনুযায়ী, উদ্বাস্তুরা কোনো দেশে গেলে, তাদের দায়িত্ব ওই দেশকেই নিতে হবে। তবে ইউরোপের দেশগুলো প্রায়ই এই দায়িত্ব ভাগ করে নেয়। ইইউয়ের সদস্য দেশগুলোর মধ্যে অভিবাসীদের আশ্রয় দেওয়ার নীতি নিয়ে আলোচনা হলেও জাতীয়তাবোধের শক্তি প্রতিটি দেশই নিজের কাছে রাখতে চায়। তবে এ কারণে যতটাসম্ভব অভিবাসী গ্রহণের মনোভাবে পরিবর্তন আসতে পারে। এ ছাড়া ইউরোপের প্রতিটি দেশেই অভিবাসন বিরোধী কিছু দল ও জনগোষ্ঠিীআছে। সম্প্রতি যুক্তরাজ্যে নির্বাচিত হয়েছে অবৈধ অভিবাসনের বিরোধী কনজারভেটিভরা।
গত বছর ছয় লাখ ২৬ হাজার মানুষ ইউরোপে আশ্রয়ের আবেদন করে। এর মধ্যে নৌযানে ভূমধ্যাসাগর পারি দিয়ে অবৈধভাবে আসা মানুষের সংখ্যা অত্যন্ত কম। আবেদনকারীদের মধ্যে অর্ধেককে ইউরোপে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে, যার মধ্যে ফ্রান্স ১৫ হাজার, ব্রিটেন ১১ হাজার, জার্মানি ৪১ হাজার, সুইডেন ৩১ হাজার অভিবাসীকে গ্রহণ করেছে। তবে বর্তমানে ইউরোপের প্রায় প্রতিটি দেশই অভিবাসী সমস্যা থেকে মুক্তি চায়।
ইউরোপের অনেক নীতি কিছু অনিচ্ছাকৃত পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। গ্রিস ও তুরস্কের সীমানায় বেড়া দেওয়ার ফলে স্থল সীমান্ত দিয়ে অবৈধ অভিবাসী কমেছে। তবে ঝুঁকিপূর্ণ জলসীমা দিয়ে অভিবাসী আসার হার বেড়েছে। আর বাণিজ্যিক জাহাজের সাহায্য নিতে চায়না অভিবাসী নৌযান ও মানব পাচারকারীরা। তাই অবৈধ অভিবাসীবাহী নৌযানগুলোর রেডিও বন্ধ রাখা হয়। এতে জাহাজ ও নৌযানের সংঘর্ষের ঝুঁকি বাড়ছে।
ইউরোপের অনেক দেশ আশ্রয়প্রার্থীদের দীর্ঘদিন আটকে রাখে এবং কোনো কাজ করতে দেয় না। এর লক্ষ্য হলো অবৈধ অভিবাসীদের জীবন এতটাই দুর্বিষহ করে তোলা যেন ইউরোপে আসতে ইচ্ছুক অপর ব্যক্তিদের শিক্ষা হয় এবং তারা অন্য কোথাও আশ্রয় নিতে ইচ্ছুক হয়। এই উদ্যোগ হলো পুরোপুরিই অর্থের অপচয় এবং নতুনদের সবার সঙ্গে মিশে যাওয়ার একটি প্রতিবন্ধকতা।
ইইউকে এই মূল্যবোধ রক্ষা করতে হলে, অবশ্যই কয়েকটি দিক থেকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। একই সঙ্গে সমুদ্রে মানুষের জীবন বাঁচাতে হবে আবার সমস্যায় থাকা দেশগুলোকেও সহায়তা করতে হবে। উদ্ধার অভিযান বিস্তৃত করায় ইইউ নেতাদের সিদ্ধান্ত ঠিক আছে। এখন থেকে সমুদ্রে উদ্ধার অভিযান গত বছরের চেয়েও বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে মানবপাচারকারীদেরও ধরতে হবে। তবে পাচারকারীরা সহজে ধরা দেবে না। কারণ এই ব্যবসা একই সঙ্গে লাভজনক এবং জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ইউরোপে যেতে ইচ্ছুক মানুষের সংখ্যা অনেক।
সমুদ্রের সমস্যা মীমাংসা হতে হবে ভূমিতেই। জাতিসংঘের সনদ অনুযায়ী আশ্রয় চাইতে হলে ইউরোপে উপস্থিত হতে হবে। এ জন্যই সমুদ্রপথে অভিবাসীদের প্রথম লক্ষ্য ইতালির লাম্পেদুসা দ্বীপ, যা তিউনিসিয়ার সমুদ্রতীর থেকে মাত্র ৭০ মাইল (১১৩ কিলোমিটার) দূরে। সমুদ্রে অভিবাসীদের যাত্রা বন্ধ করার সবচেয়ে ভালো উপায় হলো ভূমধ্যসাগরের অপর পারেই আশ্রয় চাওয়ার আবেদন করার ব্যবস্থা নেওয়া। এ ক্ষেত্রে অভিবাসীরা সেখানেই ঘাঁটিতে থাকবে, ডুবে মরার ঝুঁকি নেবে না। তবে এমন ব্যবস্থা করা মোটেই সহজ হবে না। উত্তর আফ্রিকার দেশগুলোকে এমন ব্যবস্থা নেওয়ার ব্যবস্থা নিতে ইউরোপকেই উদ্যোগী হতে হবে। আশ্রয়প্রার্থীদের আবেদন দ্রুত যাচাই-বাছাই করে ব্যবস্থা নিতে হবে। যাচাই ও নির্বাচন পক্রিয়া হতে হবে দুর্নীতিমুক্ত ও কার্যকর। আর অর্থনৈতিক কারণে ইউরোপে এসেছে এমন অভিবাসীদের দেশে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা নিতে হবে। ইইউয়ের সদস্য দেশগুলোকে ঠিক করে নিতে হবে ৫০ কোটি ধনী ইউরোপবাসীর মধ্যে কতজন অভিবাসী গ্রহণ করা যাবে।
ইউরোপের পক্ষে আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের সহিংসতা ও অপশাসন বন্ধ করা অসম্ভব। এগুলোও অভিবাসীদের ইউরোপমুখী হওয়ার অন্যতম কারণ। মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকায় পরিস্থিতির উন্নয়ন প্রকৃতপক্ষে ইউরোপের জন্যই স্বস্তির। লিবিয়ায় শান্তি নিশ্চিত করা সম্ভব হলে সেখানে অপরাধী সংগঠনগুলোর প্রভাব কমে যাবে। এর ফলে ইউরোপমুখী আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের অভিবাসীর সংখ্যা কমবে। লেবানের ১০ লাখ উদ্বাস্তুর প্রতি সহায়তা বাড়ালে প্যারিস বা বার্লিনের পথে অভিবাসীর সংখ্যা নাটকীয় হারে কমে আসবে বলে মনে করা হয়। ইউরোপ হলো ইইউর সদস্য রাষ্ট্রগুলো নিয়ে কীভাবে একটি সুন্দর পৃথিবী প্রতিষ্ঠা করা যায় তার কার্যকর মডেল। তবে এই মুহূর্তে নৌযানের অভিবাসীদের মৃত্যুই হলো ইউরোপের জন্য সবচেয়ে লজ্জার।
দি ইকোনমিস্টের প্রতিবেদন অবলম্বনে।