যেসব কারণে মস্কো অভিমুখে যাত্রা বন্ধ করল ওয়াগনার
রাশিয়ার বিদ্রোহী ভাড়াটে বাহিনী ওয়াগনারের প্রধান ইয়েভজেনি প্রিগোজিন তার সৈন্যদের মস্কোর দিকে অগ্রযাত্রা থামানোর নির্দেশ দিয়েছেন, যাতে রাশিয়ায় রক্তপাত এড়ানো যায়। একইসঙ্গে তিনি বেলারুশে নির্বাসিত জীবনযাপন করতে রাজি হয়েছেন। এভাবেই প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের কয়েক দশকের শাসনামলের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলোর একটির অবসান হলো।
প্রিগোজিন বলেন, শনিবার (২৪ জুন) যখন তার সৈন্যরা রাশিয়ার রাজধানী থেকে মাত্র ২০০ কিলোমিটার দূরে ছিল, তখন হত্যাকাণ্ড রোধে তাদের ফিরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
প্রিগোজিন এক অডিও বার্তায় বলেন, ‘তারা (রাশিয়া) ওয়াগনারের সামরিক ইউনিটগুলোকে ভেঙে দিতে চেয়েছিল। আমরা ২৩ জুন ন্যায়বিচারের জন্য (মস্কো অভিমুখে) যাত্রা শুরু করি। এখন (২৪ জুন) সেই মুহূর্ত এসেছে যখন রক্ত ঝরতে পারে।’
‘আমাদের দায়িত্বের জায়গা থেকে রাশিয়ার রক্ত ঝরার বিষয়টি অনুধাবন করতে পেরে, আমরা আমাদের বহর ঘুরিয়ে দিচ্ছি এবং পরিকল্পনা অনুযায়ী ফিল্ড ক্যাম্পে ফিরে যাচ্ছি’, যোগ করেন ওয়াগনার প্রধান।
মস্কো অবশ্য তাদের দক্ষিণ প্রান্তে সাঁজোয়াযান ও সৈন্য নিয়ে চেকপয়েন্ট তৈরি করে বিদ্রোহী ভাড়াটে বাহিনীর আগমনের জন্য প্রস্তুত ছিল। রেড স্কোয়ার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল এবং মেয়র গাড়িচালকদের কিছু রাস্তা দিয়ে না যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলেন।
প্রতিবেশী দেশ বেলারুশের প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কো পুতিনের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলার পরে ওয়াগনার বাহিনীর অগ্রসর হওয়া বন্ধ করতে তাদের প্রধান প্রিগোজিনের সঙ্গে আলোচনা করেন।
বেলারুশ প্রেসিডেন্টের অফিস জানায়, প্রিগোজিন ওয়াগনার গ্রুপের অগ্রসর হওয়া বন্ধ করার জন্য লুকাশেঙ্কোর প্রস্তাব গ্রহণ করেছেন এবং উত্তেজনা কমাতে আরও কিছু পদক্ষেপ নিয়েছেন।
রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রী সের্গেই শোইগুকে অপসারণের দাবিতে ক্রেমলিন সাড়া দিয়েছে কি না, তা বলেননি প্রিগোজিন।
শনিবার (২৪ জুন) ক্রেমলিন জানায়, ওয়াগনার প্রধান চুক্তির অংশ হিসাবে প্রতিবেশী বেলারুশে চলে যাবেন এবং তার বিরুদ্ধে বিচারিক প্রক্রিয়া বন্ধ করা হবে।
ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেন, ‘প্রিগোজিনের সৈন্যদের যারা বিদ্রোহে যোগ দিয়েছিল, তাদের বিচারের মুখোমুখি করা হবে না। আর যারা বিদ্রোহ করেনি তাদেরকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে চুক্তির প্রস্তাব দেওয়া হবে।’
পেসকভ বলেন, ‘লুকাশেঙ্কো পুতিনের সঙ্গে চুক্তির বিষয়ে মধ্যস্থতার প্রস্তাব দিয়েছিলেন, কারণ তিনি প্রায় ২০ বছর ধরে ব্যক্তিগতভাবে প্রিগোজিনকে চিনতেন। রক্তপাত, অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও অপ্রত্যাশিত ফলাফলসহ সংঘর্ষ এড়ানোই ছিল সর্বোচ্চ লক্ষ্য।’
এদিকে, রাশিয়ার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা ভাড়াটে বাহিনী ওয়াগনারের সৈন্যরা দেশটির রোস্তভ শহর ছেড়ে যেতে শুরু করেছে। রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বার্তা সংস্থা তাস এ তথ্য জানিয়েছে।
রাশিয়ার দক্ষিণাঞ্চলের শহরটি ওয়াগনারের বিদ্রোহের কেন্দ্রে ছিল। ওয়াগনার সৈন্যরা শনিবার (২৪ জুন) ভোরে শহরে প্রবেশ করে এবং আঞ্চলিক সামরিক কমান্ডের সদর দপ্তর দখল করে।
এরপর সারা দিন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিস্ফোরণ ও গোলাগুলি চালানোর নানা গুঞ্জনে মুখরিত ছিল। শহরের কেন্দ্রস্থলে ওয়াগনার সৈন্যদের অবস্থান নেওয়ার ভিডিও ছড়িয়েছিল। এছাড়া চেচেন সৈন্যরা তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য এগিয়ে আসছে বলেও শোনা যাচ্ছিল। পরে বেলারুশের প্রেসিডেন্টের আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কোর মধ্যস্থতায় রুশ বাহিনীর সঙ্গে চুক্তির পরিপ্রেক্ষিতে ওয়াগনার বাহিনী রোস্তভ ছেড়ে চলে যাচ্ছে বলে জানা গেছে।
ওয়াগনার যোদ্ধারা রোস্তভের সামরিক সদর দপ্তর ছেড়ে যাওয়ার সময় শহরের বাসিন্দারা ‘ওয়াগনার! ওয়াগনার!’ বলে স্লোগান দিতে দেখা গেছে। এটি ভাড়াটে সৈন্যদের প্রতি তাদের সমর্থন প্রকাশ করে। তবে ইউক্রেনে ওয়াগনার যোদ্ধাদের কর্মকাণ্ডের জন্য নাকি বিদ্রোহ বাতিল করার জন্য বাসিন্দারা তাদের প্রতি সমর্থন দেখাচ্ছে, তা পরিষ্কার নয়।
এদিকে, সংবাদমাধ্যমের ছবিতে ওয়াগনার প্রধান ইয়েভজেনি প্রিগোজিনকে রোস্তভ শহর ছেড়ে যেতে দেখা গেছে। শহরের আঞ্চলিক সামরিক সদর দপ্তর থেকে নিজেই গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি।
রোস্তভের আঞ্চলিক গভর্নর বলেন, শহর দখল করার ২৪ ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে ওয়াগনার যোদ্ধারা রোস্তভ ছেড়ে চলে গেছে এবং তাদের ফিল্ড ক্যাম্পে ফিরে গেছে।
রাশিয়ার বার্তা সংস্থা তাস জানায়, ওয়াগনার বাহিনীর পিছু হটার কারণে ফেডারেল রোড এজেন্সি দেশটির মোটরওয়েতে আগে দেওয়া সব নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছে। রোস্তভ, লিপেটস্ক, ভোরোনেজ ও তুলা অঞ্চলসহ গত ২৪ ঘণ্টা ধরে রাশিয়ার দক্ষিণাঞ্চল থেকে মস্কো যাওয়ার রাস্তাগুলো বন্ধ ছিল।
এদিকে, ২৪ ঘণ্টার এই অবিশ্বাস্য বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির পরে রাশিয়ার দিকে খুব গভীর মনোযোগ রাখছে ইইউ, যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের মিত্র দেশগুলো। এক বিবৃতিতে পেন্টাগন জানায়, মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড জে অস্টিন গত কয়েক ঘণ্টা ধরে কানাডা, ফ্রান্স, জার্মানি, পোল্যান্ড ও যুক্তরাজ্যের প্রতিরক্ষামন্ত্রীদের সঙ্গে পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেছেন। পরিস্থিতি ক্রমশ বদলাতে থাকায় মিত্র ও অংশীদার সঙ্গে বিষয়টি ঘনিষ্ঠভাবে সমন্বয় করবে যুক্তরাষ্ট্র। অস্টিন আরও বলেন, ইউক্রেনের প্রতি মার্কিন সমর্থন পরিবর্তন হবে না।
এছাড়া কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো শনিবার (২৪ জুন) রাশিয়ার উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করতে জ্যেষ্ঠ সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করেছেন বলে তার কার্যালয় জানিয়েছে।