বিশ্বের সবচেয়ে সুখী দেশগুলো কি সত্যিই সুখী?
এই পৃথিবীতে কারা সবচেয়ে সুখি মানুষ? বিশ্ব সুখ প্রতিবেদন অনুসারে ফিনল্যান্ড, ডেনমার্ক, আইসল্যান্ড, ইসরায়েল এবং নেদারল্যান্ডসের অধিবাসীরা বিশ্বের সবচেয়ে সুখী মানুষ। যদিও যুগের পর যুগ ইসরায়েলি সামরিক দখলদারিত্বের অধীনে থাকা ফিলিস্তিনিরা আছে এই তালিকার ৯৯তম অবস্থানে।
প্রতি বছর জাতিসংঘের পৃষ্ঠপোষকতায় ‘সুখের’ ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন দেশের তালিকা প্রকাশ করে একটি সংস্থা। গ্যালপ জরিপের ওপর নির্ভর করে প্রতিটি দেশের কয়েক হাজার অংশগ্রহণকারীকে তাদের জীবনমানকে শূন্য থেকে ১০ এর মধ্যে পরিমাপের জন্য ব্যক্তিগতভাবে প্রশ্ন রাখা হয় তালিকা প্রণয়নের প্রশ্নপত্রে। অন্য কথায় ‘জীবন মূল্যায়নকারী’ এসব প্রশ্নে কোনো ব্যক্তি একটি নির্দিষ্ট সময়ে তার জীবনকে কিভাবে উপভোগ করছে সেই অবস্থাকেই বোঝায়। সেই তথ্যকে অন্যান্য উপাত্তের সঙ্গে বাড়িয়ে তুলে তৈরি করা হয় ‘বিশ্ব সুখবিষয়ক প্রতিবেদন’ বা ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্ট।
তবে, সমালোচকরা প্রতিবেদনের বিষয়ে স্পষ্ট কিছু দ্বন্দ্ব, ফাঁক ও পক্ষপাতের বিষয় তুলে ধরেছেন। এসবের মধ্যে রয়েছে উত্তর গোলার্ধের দেশগুলোর প্রতি বিশেষ করে বিত্তশালী পশ্চিমা দেশগুলোর প্রতি পক্ষপাতীত্ব। মজার বিষয় হলো, এই দেশগুলো শত বছরের ঔপনিবেশিকতার মাধ্যমে তাদের সম্পদ বাড়ানোর বিষয়টিকে ক্রমাগতভাবে অবজ্ঞা করে আসছে। আলজাজিরার প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
বিষন্ন কিন্তু সুখী?
২০২৩ সালের সবচেয়ে সুখী দেশের তালিকায় ইউরোপের দেশের সংখ্যাই বেশি। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, গত ছয় বছর ধরে ফিনল্যান্ড বিশ্বের সবচেয়ে সুখী দেশ হিসেবে শীর্ষস্থানে অবস্থান করছে।
তবে, ফিনল্যান্ড হচ্ছে ইউরোপের বিষন্নতারোধী ওষুধ ব্যবহারের শীর্ষ তালিকার দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। একই কথা প্রযোজ্য সুইডেনের বেলাতেও যাদের অবস্থান ছয়ে, রয়েছে আইসল্যান্ডের নাম যারা রয়েছে সুখী দেশের তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে, পাশাপাশি তাদেরও রয়েছে ইউরোপে সবচেয়ে বেশি বিষন্নতারোধী ওষুধ ব্যবহারের রেকর্ড।
এদিকে, ভারতের অবস্থান রয়েছে সুখী দেশের তালিকার নিচের দিকে, ১২৬তম অবস্থানে। তবে, আলাদা জরিপে দেশটির অবস্থান অনেক ওপরে, যেখানে চলক হিসেবে কর্মজীবনের ভারসাম্যকে তুলে ধরা হয়েছে। অন্যদিকে, আরেকটি প্রতিযোগিতাপূর্ণ প্রতিবেদন গ্লোবাল হ্যাপিনেস রিপোর্টে চীনকে বিশ্বের সবচেয়ে সুখী দেশ হিসেবে দেখানো হয়েছে।
বিত্তশালী কিন্তু অসম?
যদিও একটিমাত্র প্রশ্নের জবাবের ওপর ভিত্তি করে সুখী দেশের র্যাঙ্কিং করা হয়, কিন্তু সত্যিকার ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্ট হলো অন্যান্য তথ্যউপাত্তের সাহায্যে বিষয়টির গভীর বিশ্লেষণ। আর এসব তথ্যউপাত্তের মধ্যে একটি হলো দেশটির নাগরিকদের মাথাপিছু আয়।
গবেষকরা এ ব্যাপারে পারস্পরিক সম্পর্কের একটি বিষয়ে দৃষ্টি দিয়েছেন, আর তা হলো সুখী দেশের তালিকায় শীর্ষ অবস্থানকারী দেশগুলোর বেশিরভাগেরই মাথাপিছু আয় অনেক বেশি। তালিকায় শীর্ষ ২০টি দেশের অধিকাংশই উচ্চ অর্থনৈতিক চলকের অধিকারী পশ্চিমা দেশ। আর এতেই অনেকে এই ধারণা পোষণ করেন, দেশের সার্বিক সুখ নির্ধারণে মাথাপিছু আয় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
তবে, মাথাপিছু আয়ের হিসাবে আয় বৈষম্যের বিষয়টি বিবেচনা করা হয় না। এটা কেবলমাত্র একটি দেশের সম্পদ ও সেবার মূল্যকে মোট জনসংখ্যা দিয়ে ভাগ করাকে বোঝায়। এতে বলা হয় না একটি দেশের কাদের হাতে বেশি সম্পদ রয়েছে বা কাদের হাতে নেই বা দেশের মুষ্টিমেয় লোকের হাতে কী পরিমাণ সম্পদ রয়েছে।
তালিকায় ১৫তম অবস্থানে থাকা যুক্তরাষ্ট্রে যে আয় বৈষম্য রয়েছে তা অনেক উন্নত দেশের তুলনায় বেশি। সরকারি হিসেবে সেখানে তিন কোটি ৮০ লাখ লোক গরীব আর ৬০ শতাংশ জনসংখ্যা তাদের জীবন চালাতে পে-চেকের উপর নির্ভর করে।
কার সুখ?
যে তথ্যউপাত্তের ওপর ভিত্তি করে গ্যালপ ওয়েবসাইট সুখী দেশের তালিকা তৈরি করে তার মূলে রয়েছে একটি দেশের সাধারণ নাগরিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর পূর্ণবয়স্ক জনসংখ্যার জরিপের ফলাফল। তবে, এই হিসাব থেকে বাদ দেওয়া হয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যেমন কারাগার, নার্সিং হোম এবং বয়স্ক সেবাকেন্দ্রগুলোকে। আর এসব জায়গার লোকজন নিজেদের কতটা নিরাপদ মনে করে সেটি নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রাজিলের উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে কেন না সেখানকার কারাগারগুলোতে কৃষ্ণাঙ্গের সংখ্যার অনুপাত বৈষম্যপূর্ণ।
এ ছাড়া সাংস্কৃতিক বিভেদও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কোনো নির্দিষ্ট দেশের মানুষ অন্য আরেকটি দেশের মানুষের তুলনায় কত ভালো রয়েছে, তা পরিমাপ করার কোনো সুনির্দিষ্ট মানদণ্ড নেই। তা ছাড়া মানুষের জীবনযাত্রার মান কত উন্নত তা দেশভেদে ভিন্নতা পায়।
কাউকে যদি প্রশ্ন করা হয় যে, আপনি আপনার জীবন নিয়ে কতটুকু সন্তুষ্ট? তাহলে উত্তরে ওই ব্যক্তির আন্তব্যক্তিক সম্পর্ক বা সামাজিক সৌহার্দ্যের বিষয়টি প্রকাশ পায় না। একটি জরিপে দেখা যায় সুখের পারস্পরিক নির্ভরশীলতা প্রভাব ফেলে কোনো ব্যক্তির নিজের পরিবার বা আশেপাশের মানুষের সঙ্গে তার সম্পর্ক কতটা গভীর তার ওপর।
চুরি করে নেওয়া সুখ?
সুখের প্রতিবেদনের আরেকটি ঘাটতি হলো একটি দলের সুখের অবস্থা অবিচ্ছিন্নভাবে আরেকজনের অসুখী জীবনযাপনের সঙ্গে সম্পর্কিত। তালিকায় যুক্তরাজ্য বিশ্বের ১৭তম সুখী দেশ হলেও দেশটির ঐশ্বর্য এসেছে আফ্রিকা মহাদেশ ও ক্যারিবিয় দেশগুলো থেকে চিনি বাণিজ্য বা ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে লুট করা সম্পদ নিয়ে।
সুখী দেশের তালিকায় ১৯তম অবস্থানে রয়েছে বেলজিয়াম কিন্তু তার এই সুখ এসেছে আফ্রিকার দেশ গণপ্রজাতন্ত্র কঙ্গোতে উপনিবেশ গড়ে তুলে ওই দেশের মানুষকে সীমাহীন দুর্দশায় রেখে সম্পদ শুষে নেওয়ার মাধ্যমে।
তবে, এই সুখী দেশের তালিকায় খুব নিচে অবস্থান করছে ভারত, ক্যারিবিয় দেশ ও আফ্রিকার দেশগুলো।
আবার তালিকায় চার নম্বরে অবস্থানকারী দেশ হলো ইসরায়েল, যদিও ৯৫তম অবস্থানে রয়েছে ফিলিস্তিন। কিন্তু, ১৯৪৮ সালের আগে থেকেই ফিলিস্তিনিরা তাদের জন্মভূমিতে ইসরায়েলের দখলদারিত্বের শিকার।
সুতরাং, ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্ট র্যাঙ্কিংয়ে আমাদের সত্যিকার অর্থে কী বলছে? এটা পশ্চিমা ভাবধারায় ‘সন্তুষ্টি’র বিষয়ে কিছুসংখ্যক লোকের তাদের জীবন নিয়ে খোলাখুলিভাবে সন্তোষ প্রকাশের অনুক্রম ছাড়া আর কিছু কি? এটাকে কি বলা যায় না উচ্চ মাথাপিছু আয়ের দেশের র্যাঙ্কিং? অথবা এটাকে কি বলা হবে বিশ্বের সম্পদশালী দেশের তালিকা যারা তাদের সম্পদ গড়ে তুলেছে অন্যদের শোষণের মাধ্যমে?