কারাগারে থেকেই যে পাঁচজন শান্তিতে নোবেল পেয়েছেন
চলতি বছরে শান্তিতে নোবেল পেয়েছেন ইরানের অধিকার কর্মী নার্গিস মোহাম্মদি। বর্তমানে এই নোবেলজয়ী কারাগারেই রয়েছেন। এমনকি, সবশেষ দুই দশকের বেশি সময় কারাগারেই কেটেছে এই অধিকার কর্মীর। তবে নার্গিসই প্রথম নোবেলজয়ী নন যারা কিনা কারাগারে থেকেই শান্তিতে এই পুরস্কার পেয়েছেন। খবর এএফপির।
প্রতিবেদনে ফরাসি সংবাদ সংস্থাটি জানায়, ইরানে নারীদের নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ভূমিকা রাখায় আজ শুক্রবার (৬ অক্টোবর) ৫১ বছর বয়সী নার্গিসকে সর্বোচ্চ সম্মানে ভূষিত করা হয়। সাংবাদিকতার পাশাপাশি এই অধিকার কর্মী মানবাধিকার সমুন্নত রাখা ও সবার অধিকার নিশ্চিত করতে বিভিন্ন প্রচারণা চালান। এ ছাড়া ইরানি নারীদের বাধ্যতামূলক হিজাব ও মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে আন্দোলনেও অংশ নেন তিনি।
ইরানের মানবাধিকার আইনজীবী শিরিন এবাদি প্রতিষ্ঠিত ডিফেন্ডারস অফ হিউম্যান রাউটস সেন্টারের ভাইস প্রেসিডেন্ট নার্গিস। ২০০৩ সালে শান্তিতে নোবেল পেয়েছিলেন এবাদি।
কারাগারে থেকেই শান্তিতে নোবেল জিতেছিল যারা
কার্ল ভন ওসিয়েজকি
১৯৩৫ সালে শান্তিতে নোবেল পেয়েছিলেন জার্মান সাংবাদিক ও শান্তিবাদী কার্ল ভন ওসিয়েজকি। ওই সময় নাৎসিদের একটি বন্দি শিবিরে আটক ছিলেন এই নোবেলজয়ী। এমনকি, নোবেল পুরস্কার নিতে অসলোতেও যেতে পারেননি তিনি।
রাইখস্ট্যাগ অগ্নিকাণ্ডের পর আডলফ হিটলারের বিরোধী খ্যাতি পাওয়া ওসিয়েজকিকে গ্রেপ্তার করা হয়। এমনটি হয়েছিল নোবেল পাওয়ার তিন বছর আগে। ওসিয়েজকি ছিলেন প্রথম শাসন সমালোচক যিনি কিনা মর্যাদাপূর্ণ এই পুরস্কার পেয়েছিলেন।
নরওয়ের নোবেল কমিটির এমন সিদ্ধান্তে বেশ রেগে গিয়েছিলেন তৎকালীন জার্মান শাসক আডলফ হিটলার। জার্মানির সব নাগরিককে যেকোনো বিভাগে নোবেল পুরস্কার গ্রহণ না করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি।
ওসিয়েজকির হয়ে ওই সময় একজন জার্মান আইনজীবী নোবেল পুরস্কার গ্রহণ করেন। ১৯৩৮ সালে বন্দী অবস্থায় মারা যান এই নোবেল জয়ী।
অং সান সু চি
মিয়ানমারের ক্ষমতাচ্যুত নেতা অং সান সু চি ১৯৯১ সালে শান্তিতে নোবেল জিতেছিলেন। তিনি এমন এক সময় নোবেল জিতেছিলেন যখন কিনা গৃহবন্দী অবস্থায় ছিলেন। গণতন্ত্রকামী এই নেতার প্রধান বিরোধী ছিল জান্তা সরকার, যারা কিনা ওই সময় মিয়ানমারের ক্ষমতায় ছিলেন।
গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের জন্য অহিংস আন্দোলনের জন্যই মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কারটি পেয়েছিলেন সু চি। নোবেলের পুরস্কার নিতে অসলোতে যেতে পারেননি তিনি। জান্তা সরকারের ভয় ছিল, অসলো গেলে হয়তো আর ফিরবেন না তিনি। সে জন্যই তাকে যেতে দেওয়া হয়নি।
সু চির পরিবর্তে নোবেল পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে ছিলেন তার দুই ছেলে ও স্বামী। মিয়ানমারের এই নেতার পক্ষে তারাই পুরস্কারটি গ্রহণ করেন। পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানের মঞ্চে সু চির স্মরণে একটি চেয়ার ফাঁকা রাখা হয়েছিল।
২০১০ সালে বন্দি অবস্থা থেকে মুক্তি পান সু চি। এরপরেই মিয়ানমারের নেতৃত্ব দেন তিনি। আর ২০১২ সালে নোবেল পুরস্কারটি সু চির হাতে দেওয়া হয়।
২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে নোবেলজয়ী নেতা অং সান সু চির নেতৃত্বাধীন গণতান্ত্রিক সরকারকে উৎখাত করে ফের মিয়ানমারের ক্ষমতা দখল করে দেশটির সেনাবাহিনী। এরপর থেকেই তিনি গৃহবন্দি রয়েছেন। ২০২২ সালে তাকে বিভিন্ন মামলায় মোট ৩৩ বছরের জেল দেওয়া হয়।
লিউ জিয়াওবো
জেলে বন্দি থাকা অবস্থায় ২০১০ সালে শান্তিতে নোবেল জিতেছিলেন চীনের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অন্যতম যোদ্ধা লিউ জিয়াওবো। ওই সময় বিদ্রোহের দায়ে ১১ বছরের কারাদণ্ড ভোগ করছিলেন তিনি।
চীনে মৌলিক মানবাধিকারের জন্য দীর্ঘদিন ধরে লড়াই ও অহিংস আন্দোলনের জন্য নোবেল পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে লিউয়ের জন্য প্রতীকীভাবে একটি চেয়ার ফাঁকা রাখা হয়েছিল। এমনকি, কারও হাতে চীনের এই নাগরিকের পুরস্কার দেওয়া হয়নি। কারণ, তার কোনো স্বজন পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে যেতে পারেনি।
লিউয়ের নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির খবরের পরেই তার স্ত্রী ও তিন ভাইকে গৃহবন্দি করা হয়। তারা যেন চীন থেকে বের হতে না পারে সেজন্যই এমনটি করা হয়েছিল।
২০১৭ সালে লিভার ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে চীনের একটি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ৬১ বছর বয়সী লিউ। তবে, ওই সময়ও তিনি মুক্তি পাননি। লিউ দ্বিতীয় নোবেলজয়ী যারা কি-না বন্দি অবস্থায় মারা গেছেন।
অ্যালেস বিয়ালিয়াৎস্কি
২০২১ সালের জুলাই থেকে কারাগারে ছিলেন বেলারুশের অধিকার কর্মী অ্যালেস বিয়ালিয়াৎস্কি। আর ২০২২ সালেই শান্তিতে নোবেল পান তিনি।
বেলারুশে ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ব্যাপক বিক্ষোভের জের ধরে পরের বছর অ্যালেস ও তার কয়েকজন সহকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়। দেশটির অন্যতম অধিকার গোষ্ঠী ভিয়াসনার সঙ্গে কাজ করতেন অ্যালেস।
নোবেল বিতরণ অনুষ্ঠানে অ্যালেসের হয়ে যোগ দেন তার স্ত্রী নাতালিয়া পিনচুক। তিনিই পুরস্কারটি গ্রহণ করেন।
চলতি বছরের মার্চে অ্যালেসকে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেয় বেলারুশের একটি আদালত। সরকারবিরোধী বিক্ষোভে অর্থায়ন ও অর্থ পাচারের অভিযোগে তাকে এই সাজা দেওয়া হয়।