ইসরায়েলের সামরিক শক্তি কতটা, যুক্তরাষ্ট্র থেকে কত অর্থায়ন পায়?
অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় টানা পঞ্চম দিনেও বোমাবর্ষণ অব্যাহত রেখেছে ইসরায়েল। বুধবার (১১ অক্টোবর) দিনগত রাত ৯টা পর্যন্ত ইসরায়েলের হামলায় গাজায় এক হাজার ১০০ জন এবং পশ্চিম তীরে ২৮ জন নিহত হয়েছেন। এছাড়া গাজায় পাঁচ হাজার ৩৩৯ জন এবং পশ্চিম তীরে ১৫০ জন আহত হয়েছেন। ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এ তথ্য জানিয়েছে। অন্যদিকে, ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র সংগঠন হামাসের হামলায় কমপক্ষে এক হাজার ২০০ ইসরায়েলি নিহত হয়েছে। খবর আলজাজিরার।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন শিগগিরই ইসরায়েল সফর করবেন এবং ইসরায়েলকে ‘পূর্ণ সমর্থন’ দেবেন বলে জানিয়েছে ওয়াশিংটন। ইসরায়েলি বাহিনীর জন্য গাইডেড-মিসাইল (দূর নিয়ন্ত্রিত ক্ষেপণাস্ত্র) ক্যারিয়ার ও এফ-৩৫ যুদ্ধবিমানসহ সামরিক সরঞ্জাম পাঠিয়েছে দেশটি।
এছাড়াও মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন রোববার (৮ অক্টোবর) ঘোষণা করেন, ওয়াশিংটন এই অঞ্চলে তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র ইসরায়েলের পক্ষে শক্তি প্রদর্শনে একাধিক যুদ্ধজাহাজ এবং বিশ্বের বৃহত্তম বিমানবাহী রণতরী ইউএসএস জেরাল্ড আর ফোর্ড পাঠাবে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্য নীতির একটি মূল উপাদান হলো ইসরায়েলের আঞ্চলিক সামরিক আধিপত্য বজায় রাখা। মার্কিন তহবিল ও ইসরায়েলের সামরিক অস্ত্র ভান্ডার সমৃদ্ধির কারণে এটি সম্ভব হয়েছে।
ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর শক্তি এবং এতে অর্থায়ন সম্পর্কে যেসব বিষয় জানা প্রয়োজন, সেগুলো তুলে ধরা হলো-
এক নজরে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী
ইসরায়েলের সামরিক শক্তি ও সরঞ্জামের বিশাল ভান্ডার রয়েছে। ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ (আইআইএসএস) মিলিটারি ব্যালেন্স ২০২৩ অনুযায়ী, ইসরায়েলের সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও আধা সামরিক বাহিনীতে এক লাখ ৬৯ হাজার ৫০০ সক্রিয় সদস্য রয়েছে। এছাড়া দেশটির চার লাখ ৬৫ হাজার সদস্যের রিজার্ভ বাহিনী রয়েছে। এর মধ্যে আধাসামরিক বাহিনীর সদস্য আট হাজার।
একটি স্থল অভিযানের আশঙ্কার মধ্যে বুধবার (১১ অক্টোবর) ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর একজন মুখপাত্র বলেন, প্রায় তিন লাখ সৈন্য গাজা উপত্যকার কাছাকাছি অবস্থান করছে।
ইসরায়েলে ১৮ বছরের বেশি বয়সী নাগরিকদের জন্য সামরিক পরিষেবা দেওয়া বাধ্যতামূলক। সাধারণত সামরিক বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর পুরুষরা দুই বছর আট মাস এবং নারীরা দুই বছর কাজ করবেন বলে আশা করা হয়। উন্নত নজরদারি প্রযুক্তি এবং আধুনিক অস্ত্রসমৃদ্ধ বিশাল ভান্ডার থাকায় ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী মধ্যপ্রাচ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী।
সামরিক বাহিনীর সদস্য
* এক লাখ ৬৯ হাজার ৫০০ সক্রিয় সদস্য
* চার লাখ ৬৫ হাজার সদস্যের রিজার্ভ বাহিনী
স্থল অভিযানের সক্ষমতা
* দুই হাজার ২০০ ট্যাংক
* ৫৩০ আর্টিলারি বা কামান
বিমান হামলার সক্ষমতা
* যুদ্ধের উপযোগী ৩৩৯টি উড়োজাহাজ, এর মধ্যে ৩০৯টি গ্রাউন্ড অ্যাটাক যুদ্ধবিমান (১৯৬ এফ-১৬, ৮৩ এফ-১৫, ৩০ এফ-৩৫)।
* ১৪২টি হেলিকপ্টার, ৪৩টি অ্যাপাচি অ্যাটাক হেলিকপ্টার।
নৌ অভিযানের সক্ষমতা
* পাঁচটি সাবমেরিন এবং ৪৯টি টহল এবং উপকূলীয় যুদ্ধযান
আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা
ইসরায়েলের আয়রন ডোম সিস্টেম হলো একটি ভ্রাম্যমাণ আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, যা রাডার প্রযুক্তি ব্যবহার করে স্বল্প-পরিসরের রকেট ঠেকাতে ও ধ্বংস করতে সক্ষম। ২০০৬ সালে সশস্ত্র সংগঠন হিজবুল্লাহর সঙ্গে যুদ্ধের পরে ইসরায়েলে এটি তৈরির উদ্যোগ নেয়। এ যুদ্ধে ইসরায়েলের দিকে কয়েক হাজার রকেট নিক্ষেপ করা হয়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় আয়রন ডোম ২০১১ সালে থেকে ব্যবহার শুরু হয়। ২০২২ সালে ইসরায়েলের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষার জন্য দেড় বিলিয়নের ডলারের বেশি বরাদ্দসহ আয়রন ডোম সিস্টেমের যন্ত্রাংশও সরবরাহ করে দেশটি।
আইআইএসএসের তথ্যমতে, ইসরায়েলের আয়রন ডোম সিস্টেম ২০২১ সালে হামাস এবং অন্যান্য ফিলিস্তিনি সংগঠনের ছোড়া ৯০ শতাংশেরও বেশি রকেট আটকে দিয়েছে।
আইআইএসএসের মতে, ইসরায়েলের পারমাণবিক ক্ষমতাও রয়েছে বলে মনে করা হয়। দেশটির কাছে জেরিকো ক্ষেপণাস্ত্র এবং পারমাণবিক ওয়ারহেড বহনে সক্ষম বিমান রয়েছে।
সামরিক খাতে ইসরায়েল কত খরচ করে?
যুদ্ধ ও অস্ত্রের নিয়ে গবেষণা সংস্থা স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এসআইপিআরআই) তথ্য অনুসারে, ২০২২ সালে ইসরায়েল সামরিক খাতে ২৩ দশমিক ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় করেছে। ২০১৮-২০২২ মেয়াদে সামরিক খাতে দেশটির মাথাপিছু ব্যয় দুই হাজার ৫৩৫ মার্কিন ডলার, যা বিশ্বে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মাথাপিছু সামরিক ব্যয়। এ মেয়াদে বিশ্বে মাথাপিছু সামরিক ব্যয়ের শীর্ষে কাতার।
২০২২ সালে ইসরায়েল জিডিপির ৪ দশমিক ৫ শতাংশ সামরিক খাতে ব্যয় করেছে, যা বিশ্বে দশম।
ইসরায়েল থেকে সবচেয়ে বেশি অস্ত্র কেনে যেসব দেশ
ঐতিহাসিকভাবে ইসরায়েলের অস্ত্র আমদানি তাদের রপ্তানির চেয়ে অনেক বেশি। তবে এসআইপিআরআইয়ের তথ্য অনুসারে, গত দশকে দেশটির অস্ত্র রপ্তানি ধারাবাহিকভাবে আমদানিকে ছাড়িয়ে যেতে শুরু করেছে।
২০১৮ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে অন্তত ২৫টি দেশ ইসরায়েল থেকে মোট ৩ দশমিক ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের অস্ত্র আমদানি করেছে। এর মধ্যে ইসরায়েল থেকে সর্বোচ্চ ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র কিনেছে ভারতে, যা দেশটির অস্ত্র রপ্তানির প্রায় এক তৃতীয়াংশ। ২০১৪ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার পর থেকে ইসরায়েল ও ভারতের মধ্যে সম্পর্ক বিকশিত হয়েছে। ওই বছর ইসরায়েলি অস্ত্রের দ্বিতীয় বৃহত্তম ক্রেতা ছিল আজারবাইজান (২৯৫ মিলিয়ন ডলার), তারপরে ফিলিপাইন (২৭৫ মিলিয়ন ডলার), যুক্তরাষ্ট্র (২১৭ মিলিয়ন ডলার) ও ভিয়েতনাম (১৮০ মিলিয়ন ডলার)।
২০১৮ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে ইসরায়েল শুধু দুটি দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানি থেকে মোট ২ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র আমদানি করেছে। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ইসরায়েল ২ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র আমদানি করেছে, যা দেশটির সামরিক আমদানির তিন-চতুর্থাংশেরও বেশি। বাকি ৫৪৬ মিলিয়ন ডলারের অস্ত্র জার্মানি থেকে আমদানি করেছে দেশটি।
এছাড়া মার্কিন ও ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী যৌথ মহড়া, প্রযুক্তি উন্নয়ন কর্মসূচি ও প্রতিরক্ষা প্রকল্পে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে। মার্কিন সামরিক সহায়তার সর্বোচ্চ অংশ পায় ইসরায়েল।
ইসরায়েল যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে এ পর্যন্ত কী পরিমাণ সামরিক সহায়তা পেয়েছে?
যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বৈদেশিক সহায়তা পাওয়া ইসরায়েল ১৯৪৬ থেকে ২০২৩ সালের পর্যন্ত প্রায় ২৬৩ বিলিয়ন ডলার পেয়েছে। এটি যুক্তরাষ্ট্র থেকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সাহায্য পাওয়া মিসরের চেয়ে ১ দশমিক ৭ গুণ বেশি। মিসর গত ৭৭ বছরে ১৫১ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার পেয়েছে। ২০২৩ সালেও মার্কিন সামরিক তহবিল পাওয়ায় শীর্ষে ইসরায়েল, ৩ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার পেয়েছে দেশটি।
১৯৪৬ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ইসরাইলকে সামরিক ও প্রতিরক্ষা সহায়তা হিসেবে মোট ১২৪ বিলিয়ন ডলার দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এ বছর ইসরায়েলকে দেওয়া ৩ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলারের সামরিক সহায়তার মধ্যে অর্ধ বিলিয়ন ডলার দিয়েছে ইসরায়েলের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার জন্য। ওয়াশিংটন বলেছে, হামাসের বিরুদ্ধে সর্বশেষ যুদ্ধে ব্যবহৃত ইসরায়েলি অস্ত্রের ঘাটতি তারা পূরণ করে দেবে।