রাইসির মৃত্যুতে যেভাবে অস্থির হয়ে উঠতে পারে ইরানের ভবিষ্যৎ
হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিহত হওয়ার পর দেশটির শাসন ব্যবস্থায় অভ্যন্তরীণ রদবদলের আভাস পাওয়া গেছে গতকাল সোমবারই। তবে সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতার মাধ্যমে দেশ পরিচালিত হয় বলে সরকারে বড় ধরনের পরিবর্তন দেখতে হবে না ইরানের নাগরিকদের।
আলোচনাটা সর্বোচ্চ নেতার পদটি নিয়েই। ৮৫ বছর বয়সী আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির পর ইরানের সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে রাইসিকেই দেখা হচ্ছিল। তবে তার মৃত্যুতে দেশ পরিচালনার গুরুভার কার ওপর বর্তাবে, তা নিয়ে এখন থেকেই শুরু হয়েছে মাথাব্যথা।
রাইসির মৃত্যুর পর খামেনির ছেলেই পরবর্তী সর্বোচ্চ নেতা হতে পারেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে ক্ষমতার বংশগত উত্তরাধিকার ইসলামি প্রজাতন্ত্রের দেশটির সংকট আরও বাড়াবে। কারণ রাজতন্ত্রের বিকল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলেও দেশটির নাগরিকদের অনেকে এই শাসন ব্যবস্থাকে দুর্নীতিগ্রস্ত ও স্বৈরাচারী শাসন হিসেবে দেখেন।
ইরানের শাসন ব্যবস্থা যেভাবে কাজ করে
রাষ্ট্রপতি ও সংসদ সদস্য নির্বাচনের জন্য ইরানে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তবে দেশের যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন সর্বোচ্চ নেতা। তিনিই সশস্ত্র বাহিনীর কমান্ডার-ইন-চিফ হিসেবে কাজ করেন এবং শক্তিশালী বিপ্লবী গার্ডকে (আইআরজিসি) নিয়ন্ত্রণ করেন।
১২ সদস্যবিশিষ্ট গার্ডিয়ান কাউন্সিলের অর্ধেক সদস্যও তার মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। দেশটির রাষ্ট্রপতি, সংসদ সদস্য, এমনকি সর্বোচ্চ নেতা নির্বাচনের দায়িত্বে থাকা বিশেষজ্ঞ পরিষদের প্রার্থীদেরও যাচাই করে এই গার্ডিয়ান কাউন্সিল।
কাগজে-কলমে, দেশে ইসলামি আইন বজায় রাখতে সার্বিক তত্ত্বাবধান করে থাকেন গার্ডিয়ান কাউন্সিলের সদস্যরা (ধর্মগুরু)। তবে বাস্তবতা হলো, সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা নিজ স্বার্থের ভারসাম্য বজায় রাখা ও তার নিজস্ব অগ্রাধিকারগুলোকে এগিয়ে নিতে কেউ যাতে চ্যালেঞ্জ না করতে পারে, তা নিশ্চিত করে সতর্কতার সঙ্গে শাসন ব্যবস্থা পরিচালনা করেন।
কট্টরপন্থী রাইসি ছিলেন খামেনির সমর্থক। ২০২১ সালের নির্বাচনে অন্য প্রতিদ্বন্দ্বীদের কার্যত নিষ্ক্রিয় করে রাইসিকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত করে বিশেষজ্ঞ পরিষদ। নির্বাচনে রুহানিকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতেও বাধা দেওয়া হয়। এর মাধ্যমে ৮ বছর ধরে প্রেসিডেন্টের পদ সামলানো হাসান রুহানির স্থলাভিষিক্ত হন রাইসি। ইরানের ইতিহাসে সবচেয়ে কম ভোট পড়ে সেবারের নির্বাচনে।
রাইসির মৃত্যুর পর দেশটির ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মোখবার অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। ইরানের সংবিধান অনুসারে ৫০ দিনের মধ্যে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করতে হবে। এক্ষেত্রে কাকে রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্বে আনা হবে, সে কাজটি সাবধানতার সঙ্গে করতে হবে খামেনিকে।
এর অর্থ এই দাঁড়াচ্ছে যে, দেশটিতে কড়া ইসলামি শাসন আরোপ চলতে থাকবে এবং ভিন্নমতের বিরুদ্ধে দমন-পীড়ন চালিয়ে যাবে ইরান। এ ছাড়া দেশটির ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচি, মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে সমর্থন ও পশ্চিমাদের গভীর সন্দেহের চোখে দেখা চলমান থাকবে।
ক্ষমতার উত্তরাধিকারের বিষয়ে যা হবে
ইরানের ক্ষমতায় রাষ্ট্রপতি আসবেন, যাবেন। কেউকেউ কট্টরপন্থী, কেউবা মধ্যপন্থী হতে পারেন, তবে প্রত্যেককেই শাসন ব্যবস্থার প্রতি অনুগত হয়ে কাজ করতে হয়।
১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের পর দেশটির সর্বোচ্চ নেতা রয়েছেন খামেনি। ফলে তার মৃত্যুর পরই কেবল ইরানে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটতে পারে।
৮৮ জন বিশেষজ্ঞ নিয়ে গড়া পরিষদের মাধ্যমে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা নির্বাচন করা হয়। ওই পরিষদের সদস্যরা আবার ১২ সদস্যের গার্ডিয়ান কাউন্সিলের মাধ্যমে আট বছর পরপর নির্বাচিত হন।
খামেনির উত্তরাধিকারী কে হবেন—এ বিষয়ক আলোচনা বা যেকোনো কৌশল সাধারণ জনগণের অগোচরে হয়ে থাকে। ফলে দেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী কে হতে চলেছেন, সাধারণের পক্ষে তা আগে থেকে জানা সম্ভব হয়ে ওঠে না।
তবে বিশ্লেষকরা যে দুই ব্যক্তিকে খামেনির উত্তরসূরি হিসেবে দেখছিলেন, তাদের একজন রাইসি, অন্যজন খামেনির ছেলে মোজতবা। ৫৫ বছর বয়সী মোজতবা একজন শিয়া ধর্মগুরু। তবে সরকারি দায়িত্ব পালনের কোনো অভিজ্ঞতা নেই তার।
মোজতবা ইরানের সর্বোচ্চ পদে বসলে যা হতে পারে
বিপ্লবের মাধ্যমে ১৯৭৯ সালে ইসলামি প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর দেশটির নেতারা ইরানকে শুধু পশ্চিমা ক্ষয়িষ্ণু গণতন্ত্রের চেয়ে নয়, মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে বিরাজমান সামরিক একনায়কতন্ত্র ও রাজতন্ত্র থেকেও অনেক উচ্চতায় নিয়ে গেছে।
তবে খামেনির ছেলে সর্বোচ্চ নেতার আসনে বসলে ফের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব শুরু হতে পারে ইরানে। শুধু ইসলামি শাসনের সমালোচকদের কাছেই নয়, দেশের বর্তমান শাসন ব্যবস্থা যেসব ইরানি ‘অনৈসলামিক’ বলে বিবেচনা করে, তাদের মধ্যেও ক্ষোভের সঞ্চার করতে পারে ক্ষমতার এই উত্তরাধিকার।
পারমাণবিক কর্মসূচির কারণে ইরানের ওপর আরোপিত পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা দেশটির অর্থনীতিকে ধ্বংস করেছে। আর ইসলামি শাসন যা রাইসির আমলে আরও তীব্র আকার ধারণ করে, দেশের নারী ও যুবাদের আরও বিচ্ছিন্ন করেছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেশ কয়েকটি বড় বড় প্রতিবাদ ও বিক্ষোভের সম্মুখীন হয়েছে ইরান। ২০২২ সালে মাহসা আমিনি গ্রেপ্তারের পর দেশটি বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠা এর বড় উদাহরণ। চুল না ঢেকে রাস্তায় বের হওয়ার কারণে আমিনি গ্রেপ্তার হন। এর বিরুদ্ধে ইরানজুড়ে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। ওই বিক্ষোভ থেকে দেশজুড়ে পাঁচ শতাধিক মানুষ নিহত ও ২২ হাজারের বেশি নাগরিক আটক হন।
রাইসির মৃত্যুতে তাই নতুন সর্বোচ্চ নেতা বেছে নেওয়ার প্রক্রিয়াটি আরও জটিল হয়ে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে, যা দেশটিতে ফের অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে।