ট্রাম্প বনাম কমলা : গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলোতে কার কী অবস্থান?
ডেমোক্র্যাটিক ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস ও রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যে যেকোনো একজনকে পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হিসেবে বেছে নিতে আগামী ৫ নভেম্বর ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে যাচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ। মুদ্রাস্ফীতি, শুল্ক, গর্ভপাত, অভিবাসন, পররাষ্ট্র নীতি, বাণিজ্য, জলবায়ু, স্বাস্থ্যসেবা, আইন-শৃঙ্খলা, গাঁজা ও বন্দুক ব্যবহারের মতো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলোতে এই দুই প্রার্থীর নীতি কী, চলুন তা জেনে নেওয়া যাক।
মুদ্রাস্ফীতি
কমলা হ্যারিস বলেছেন, তার প্রথম অগ্রাধিকার কর্মজীবী পরিবারের জন্য খাদ্য ও আবাসন খরচ কমানোর চেষ্টা করা। তিনি নিত্যপণ্যের দামবৃদ্ধি বন্ধের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। একইসঙ্গে প্রথমবার বাড়ি কিনতে যাওয়া মানুষকে সহায়তা এবং আবাসন অবকাঠামো বাড়াতে প্রণোদনা দেবেন।
পশ্চিমা অন্যান্য দেশের মতো বাইডেন প্রশাসনের অধীনে যুক্তরাষ্ট্রেও মুদ্রাস্ফীতি বেড়েছে। কোভিড-পরবর্তী সরবরাহ সংকট ও ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে এমনটি ঘটে।
ট্রাম্প মুদ্রাস্ফীতি সংকটের অবসান এবং যুক্তরাষ্ট্রে জীবনযাত্রাকে আবারও সহজসাধ্য করার প্রতিশ্রুতি দেন। তিনি বলেছেন, তেলের উৎপাদন বাড়িয়ে জ্বালানি খরচ কমিয়ে আনা যাবে। তিনি সুদের হার কম করারও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, যা প্রেসিডেন্ট নিয়ন্ত্রণ করেন না। তিনি বলেন, নথিভুক্ত নয় এমন অভিবাসীদের বিতাড়িত করলে আবাসন খাতে চাপ কমে আসবে। তবে অর্থনীতিবিদরা সতর্ক করেছেন, আমদানির ওপর উচ্চ শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্তে দ্রব্যমূল্য আরও বাড়াতে পারে।
ট্যাক্স বা শুল্ক
কমলা হ্যারিস বড় ব্যবসা এবং যে মার্কিনি বছরে চার লাখ ডলার উপার্জন করেন, তার ওপর কর বাড়াতে চান। তবে তিনি বেশ কয়েকটি উদ্যোগের কথাও জানিয়েছেন, যা পরিবারের ওপর করের বোঝা কমিয়ে দেবে, যেমন চাইল্ড ট্যাক্স ক্রেডিট বৃদ্ধি।
কমলা মূলধন লাভের ওপর করের বিষয়ে বাইডেনের সঙ্গে মতভেদ করেন। তিনি এই কর তার ৪৪ দশমিক ৬ শতাংশের তুলনায় ২৩ দশমিক ৬ শতাংশ থেকে সহনীয় মাত্রায় ২৮ শতাংশে বৃদ্ধিকে সমর্থন করেন।
অন্যাদিকে, ট্রাম্প ট্রিলিয়ন ডলার পরিমাণ কর কমানোর প্রস্তাব করেছেন। ২০১৭ সালে তার নির্ধারিত কর বহির্ভূত ক্ষেত্রগুলোর পাশাপাশি এবার তা আরও বাড়াতে চান। তার এ ধরনের সিদ্ধান্ত বেশিরভাগ ধনীকে সহায়তা করেছে। ট্রাম্প বলেছেন, তিনি উচ্চ প্রবৃদ্ধির মাধ্যমে তাদের জন্য অর্থ দেবেন এবং আমদানি শুল্ক বাড়াবেন। বিশ্লেষকরা বলছেন, উভয় কর পরিকল্পনাই সরকারের ঋণ আরও বাড়াবে।
গর্ভপাত
কমলা হ্যারিস গর্ভপাতের অধিকারকে তার প্রচারাভিযানের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেছেন এবং তিনি এ নিয়ে আইন প্রণয়নের পক্ষে যুক্তি দিয়ে চলেছেন, যা দেশব্যাপী প্রজনন অধিকার নিশ্চিত করবে।
অন্যাদিকে, ট্রাম্প গর্ভপাতের বিষয়ে একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ বার্তা খুঁজে পেতে সংগ্রাম করেছেন। প্রেসিডেন্ট থাকাকালে তিনি যে তিনজন বিচারপতিকে সুপ্রিম কোর্টে নিয়োগ করেছিলেন, তারা গর্ভপাতের সাংবিধানিক অধিকারকে বাতিল করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
অভিবাসন
কমলা হ্যারিসকে দক্ষিণাঞ্চলীয় সীমান্ত সংকটের মূল সংকটগুলো মোকাবিলার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। তিনি যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী আগমন বন্ধের লক্ষ্যে আঞ্চলিক বিনিয়োগের জন্য বিলিয়ন ডলার ব্যক্তিগত অর্থ সংগ্রহে সহায়তা করেছিলেন।
২০২৩ সালের শেষের দিকে মেক্সিকো থেকে রেকর্ড সংখ্যক লোক যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি দিয়েছে, তবে সংখ্যাটি চার বছরের সর্বনিম্নে নেমে এসেছে। নির্বাচনি প্রচারাভিযানে কমলা হ্যারিস এ নিয়ে কঠোর অবস্থান ব্যক্ত করেছেন। একইসঙ্গে তিনি মানব পাচারকারীদের বিরুদ্ধে ক্যালিফোর্নিয়ায় একজন আইনজীবী হিসেবে তার অভিজ্ঞতার কথা জোর দিয়ে উল্লেখ করেছেন।
ট্রাম্প প্রাচীর নির্মাণের কাজ শেষ করে সীমান্ত সিল করার অঙ্গীকার করেছেন। তবে তিনি রিপাবলিকানদেরকে হ্যারিস সমর্থিত একটি কট্টরপন্থি ক্রস-পার্টি অভিবাসন বিল বর্জনের আহ্বান জানিয়েছেন। তবে কমলা বলেছেন, নির্বাচিত হলে তিনি সেই বিল পুনরুজ্জীবিত করবেন।
অন্যদিকে, ট্রাম্প নথিভুক্ত নয় এমন অভিবাসীদের বিতাড়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
পররাষ্ট্র নীতি
কমলা হ্যারিস ইউক্রেনকে ‘যতদিন লাগে’ সমর্থন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, নির্বাচিত হলে একবিংশ শতাব্দীর প্রতিযোগিতায় চীন নয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জয়ী, তা নিশ্চিত করবেন। তিনি দীর্ঘদিন ধরে ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে দ্বি-রাষ্ট্র সমাধানের পক্ষে ছিলেন এবং গাজা যুদ্ধ বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছেন।
ট্রাম্পের অবশ্য একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী পররাষ্ট্রনীতি রয়েছে এবং তিনি চান, বিশ্বের অন্য যেকোনো জায়গার দ্বন্দ্ব থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দূরে থাকুক। তিনি বলেছেন, রাশিয়ার সঙ্গে সমঝোতার মাধ্যমে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ইউক্রেনের যুদ্ধ শেষ করবেন। কিন্তু, এমন পদক্ষেপ ভ্লাদিমির পুতিনকে উত্সাহিত করবে বলে মনে করেন ডেমোক্র্যাটরা।
ট্রাম্প নিজেকে ইসরায়েলের কট্টর সমর্থক হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তবে তিনি কীভাবে গাজা যুদ্ধ শেষ করবেন, সে সম্পর্কে খুব কমই বলেছেন।
বাণিজ্য
কমলা হ্যারিস আমদানির ওপর নতুন করে শুল্ক আরোপ নিয়ে ট্রাম্পের ব্যাপক পরিকল্পনার সমালোচনা করেছেন। এটিকে কর্মজীবী পরিবারের ওপর চাপিয়ে দেওয়া জাতীয় কর বলে অভিহিত করেছেন। এর ফলে প্রতিটি পরিবারের বছরে চার হাজার ডলার খরচ হবে।
কমলা হ্যারিস আমদানি কর আরোপের জন্য আরও সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নির্ধারণের চিন্তা করছেন। পাশাপাশি তিনি চীন থেকে আমদানি করা বৈদ্যুতিক গাড়ির মতো কিছু পণ্যে বর্তমান (বাইডেন-কমলা) প্রশাসনের আরোপ করা শুল্ক বজায় রাখবেন।
ট্রাম্প শুল্ককে একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হিসেবে প্রচারণা চালাচ্ছেন। তিনি বেশিরভাগ বিদেশি পণ্যে নতুন করে ১০-২০ শতাংশ শুল্ক আরোপের প্রস্তাব করেছেন এবং চীন থেকে আসা পণ্যগুলোতে হবে এর চাইতেও বেশি। তিনি কর্পোরেট ট্যাক্স কমিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পণ্য উৎপাদনে কোম্পানিগুলোকে প্রলুব্ধ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
জলবায়ু
কমলা হ্যারিস ভাইস-প্রেসিডেন্ট হিসেবে মুদ্রাস্ফীতি হ্রাস আইন পাস করতে সাহায্য করেছিলেন, যা নবায়নযোগ্য শক্তি, বৈদ্যুতিক গাড়ির ট্যাক্স ক্রেডিট ও রিবেট প্রোগ্রামে শত শত বিলিয়ন ডলারের প্রবাহ ঘটেছে।
গ্যাস ও তেল সংগ্রহে ফ্র্যাকিং কৌশলের বিরুদ্ধে বিরোধিতা করা থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন কমলা। পরিবেশবাদীরা দীর্ঘ দিন এ পদ্ধতির বিরোধিতা করে আসছেন।
অপরদিকে, ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে থাকাকালে পরিবেশগত সুরক্ষার অনেকগুলো বিষয়গুলো পাল্টে দিয়েছিলেন, যার মধ্যে বিদ্যুৎকেন্দ্র ও যানবাহন থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণের সীমাও রয়েছে। এবারের প্রচারাভিযানে তিনি আর্কটিক ড্রিলিং সম্প্রসারণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন এবং বৈদ্যুতিক গাড়ির বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন।
আইন-শৃঙ্খলা
কমলা হ্যারিস একজন আইনজীবী হিসেবে তার অভিজ্ঞতাকে অপরাধের দায়ে দোষী সাব্যস্ত ট্রাম্পের সঙ্গে বিপরীত বলে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন।
অপরদিকে, ট্রাম্প মাদকের কার্টেল ধ্বংস, গ্যাং সহিংসতা দমন করার পাশাপাশি অপরাধে আচ্ছন্ন শহরগুলোকে গণতান্ত্রিকভাবে পরিচালিত করতে পুনর্গঠনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
ট্রাম্প বলেছেন, তিনি বিরোধীদের মোকাবেলা করতে সামরিক বা ন্যাশনাল গার্ড, রিজার্ভ ফোর্স ব্যবহার করবেন, যদি তারা নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করে। তাদেরকে তিনি ‘অভ্যন্তরীণ শত্রু’ এবং ‘উগ্র বামপন্থি পাগল’ হিসেবে অভিহিত করেন।
বন্দুক
কমলা হ্যারিস বন্দুক সহিংসতা প্রতিরোধকে অন্যতম অঙ্গীকার হিসেবে তুলে ধরছেন এবং প্রায়শই কঠোর আইনের পক্ষে কথা বলেছেন। যদিও তিনি ও তার রানিংমেট টিম ওয়ালজ উভয়েরই বন্দুক আছে।
ট্রাম্প নিজেকে অস্ত্র বহনের সাংবিধানিক অধিকারের কট্টর রক্ষক হিসাবে বর্ণনা করেছেন। মে মাসে জাতীয় রাইফেল অ্যাসোসিয়েশনের সমাবেশে ট্রাম্প বলেছিলেন, তিনি তাদের সেরা বন্ধু।
গাঁজা
কমলা হ্যারিস বিনোদনের উদ্দেশ্যে ব্যবহারের জন্য গাঁজাকে অপরাধ তালিকার বাইরে রাখার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, গাঁজা বহনের জন্য অনেক লোককে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। এদের মধ্যে কৃষ্ণাঙ্গ ও ল্যাটিনদের সংখ্যা অসামঞ্জস্যপূর্ণ।
ট্রাম্প তার সুর নরম করে বলেছেন, ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য অল্প পরিমাণ গাঁজা ব্যবহারের জন্য প্রাপ্তবয়স্কদের অপ্রয়োজনীয় গ্রেপ্তার ও কারাগারে প্রেরণ বন্ধ করার সময় এসেছে।