১৫ মাসের যুদ্ধে যেভাবে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে গাজা
দীর্ঘ ১৫ মাসেরও বেশি সময় ধরে চলা গজা-ইসরায়েল সংঘাত অবশেষে যুদ্ধবিরতিতে রূপ নিয়েছে। এতে বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছে ফিলিস্তিনি নাগরিকরা। তবে যুদ্ধবিরতি হলেও ইসরায়েলি বাহিনীর বর্বর ও নির্বিচার হামলায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে গাজা উপত্যকা, বাস্তুচ্যুত হয়েছে ফিলিস্তিনের লাখ লাখ বাসিন্দা, ধ্বংস করা হয়েছে মসজিদ, বিদ্যালয়, হাসপাতাল, আবাসিক ভবন, এমনকি শরণার্থী শিবিরও। ইসরায়েলি নজিরবিহীন বর্বর এ হামলার ক্ষয়-ক্ষতির বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে যুক্তরাজ্য ভিত্তিক সংবাদমাধ্যম বিবিসির প্রতিবেদনে।
গাজা-ইসরায়েল সংঘাতের শুরু যেভাবে
২০২৩ সালের ৭ই অক্টোবর ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র সংগঠন হামাস ইসরায়েল আক্রমণ করে। হামাসের ওই হামলায় প্রায় ১২০০ মানুষ নিহত হয় এবং ২৫১ জনকে জিম্মি করা হয়। এরপর থেকেই সংঘাতের শুরু। হামাসের এ হামলার প্রতিশোধ নিতে গাজায় ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায় ইসরায়েল। দেখা দেয় মানবিক সংকট। যা ধীরে ধীরে প্রকট আকার ধারণ করেছ।
যুদ্ধ বিরতি চুক্তি কার্যকর হওয়ার আগ পর্যন্ত ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর হামলায় প্রায় ৪৭ হাজার ফিলিস্তিনি নাগরিক নিহত হয়েছেন। এছাড়া আহত হয়েছেন আরও প্রায় লক্ষাধিক মানুষ। ধ্বংস করা হয়েছে গাজার অধিকাংশ অবকাঠামো।
নিহত ও আহতের পরিসংখ্যান
ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, তারা হাসপাতাল এবং নিহতদের পরিবারের সদস্যদের থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ৪৬ হাজার ৯১৩ জনের মৃত্যুর হিসাব পেয়েছেন। পাশাপাশি গাজা-ইসরায়েল সংঘাতে এক লাখ ১০ হাজার ৭৫০ জন ফিলিস্তিনি আহত হয়েছেন বলে জানানো হয়েছে।
ল্যানসেট মেডিকেল জার্নালের বরাত দিয়ে বিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিহতের সংখ্যা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবের চাইতেও উল্লেখযোগ্য হারে বেশি হতে পারে।
২০২৪ সালের ৭ অক্টোবর পর্যন্ত (সংঘাতের এক বছরে) প্রাপ্ত পরিসংখ্যানে দেখা গেছে নিহতদের মধ্যে ৫৯ শতাংশ ছিল নারী, শিশু ও বৃদ্ধ। তবে গত বছরের নভেম্বরে জাতিসংঘের দেওয়া এক পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, নিহতের মধ্যে নারী এবং শিশুর সংখ্যা ৭০ শতাংশ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা চলতি বছরে ১৩ জানুয়ারি এক প্রতিবেদনে জানায়, ২৫ শতাংশ মানুষ এতোটাই গুরুতর আঘাত পেয়ে আহত হয়েছেন যে, তাঁরা আর তাঁদের জীবনের আগের অবস্থায় ফিরবেন না।
এদিকে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) জানিয়েছে, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তারা ১৭ হাজার হামাস যোদ্ধাকে হত্যা করেছে। তবে কীভাবে এই সংখ্যা নির্ধারণ করেছে তা তারা প্রকাশ করেনি।
হাসপাতাল ও অবকাঠামোগত ক্ষয়-ক্ষতির চিত্র
গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় অবকাঠামোগত যে ক্ষতির চিত্র তুলে ধরা হয়েছে তা অতীতের যেকোনো সংঘাতের ঘটনাকে হার মানায়।
সিএনওয়াই গ্র্যাজুয়েট সেন্টারের অধ্যাপক কোরি শের এবং ওরেগন স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক জামন ভ্যান ডেন হোক স্যাটেলাইট চিত্রের মাধ্যমে গাজার ক্ষয়ক্ষতির পরিসর যাচাই করেছেন।
কোরি শের এবং জামন ভ্যান ডেন হোক জানান, তাঁরা ১১ জানুয়ারি পর্যন্ত ক্ষয়ক্ষতি বিশ্লেষণ করে অনুমান করেছেন সংঘাত শুরুর পর থেকে গাজার ৫৯ দশমিক আট শতাংশ ভবন ক্ষতিগ্রস্ত বা পুরোপুরি ধ্বংস হয়েছে। তাঁরা বলছেন, ইসরায়েল বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শহুরে এলাকায় হামলা চালিয়েছে, কিছু অবকাঠামোয় একাধিকবার বোমা হামলা করেছে।
জাতিসংঘের স্যাটেলাইট সেন্টারের (ইউএনওস্যাট) পরিসংখ্যান বলছে, অনেক হাসপাতাল এবং এর আশেপাশের এলাকা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গাজার ৫০ শতাংশ হাসপাতাল একেবারেই বন্ধ গেছে। বাকি হাসপাতালগুলোতেও আংশিকভাবে কাজ চলছে। এছাড়া ৬৯ শতাংশ ভবন ও স্থাপনা পুরোপুরি ধ্বংস হয়েছে। সেইসাথে গাজার রাস্তাঘাটের ৬৮ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
জাতিসংঘের তথ্যে বলা হয়েছে, হাসপাতালগুলো খোলা থাকলেও দীর্ঘস্থায়ী রোগ এবং জটিল আঘাতের কোনো চিকিৎসা দিতে পারছে না। অনেক বিশেষায়িত চিকিৎসা সেবা এখন দক্ষকর্মী এবং প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ছাড়া চলছে।
জাতিসংঘের দেওয়া তথ্য বলছে, গাজা-ইসরায়েল সংঘাতে অন্তত এক হাজার ৬০ জন চিকিৎসাকর্মী নিহত হয়েছেন।
সেভ দ্য চিলড্রেন বিবিসি জানিয়েছে, গাজার ছয়টি পাবলিক কমিউনিটি মানসিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র এবং একমাত্র ইনপেশেন্ট সাইকিয়াট্রিক হাসপাতাল বন্ধ হয়েছে গেছে। ফলে প্রায় দশ লাখ শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা মোকাবিলা করা এক বিশাল চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাস্তুচ্যুতির পরিসংখ্যান
জাতিসংঘের বরাত দিয়ে বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গাজায় অন্তত ১৯ লাখ মানুষ অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন, যা গাজার মোট জনসংখ্যার ৯০ শতাংশ। এই মানুষেরা তাদের বাড়ি ছেড়ে অন্য জায়গায় যেতে বাধ্য হয়েছেন। কেউ কেউ একাধিকবার এক স্থান থেকে অন্য স্থানে আশ্রয় নিয়েছেন।
ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য যেসব মানবিক অঞ্চলে (হিউম্যানিটেরিয়ান জোন) যেতে বলেছিল, সেখানেও তারা বহু বিমান চালিয়েছে।
শিক্ষার ক্ষয়ক্ষতির চিত্র
ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী জানায়, তারা হামাস যোদ্ধাদের লক্ষ্য করে ৪৯টি গাজার স্কুল ভবনে হামলা চালিয়েছে। ডিসেম্বরের শুরু থেকে ১৩টি স্থানে এ ধরনের হামলার যাচাইকৃত ফুটেজ বিশ্লেষণ করে বিবিসি জানায়, স্থানগুলোতে তখন আর স্কুল হিসেবে চালু ছিল না। সেগুলোতে বাস্তুচ্যুত মানুষের আশ্রয়স্থল হিসেবে তৈরি করা হয়েছিল।তবে এসব স্কুল ভবনে হামলায় যে ক্ষতি হয়েছে তা গাজায় শিক্ষা স্বাভাবিক করতে চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করবে।
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসরায়েল শত শত পানির লাইন এবং স্যানিটেশন সুবিধা ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস করে দিয়েছে। মানুষের বাড়িঘর থেকে শুরু করে জনসেবা কেন্দ্র পুনরায় নির্মাণ করাই হবে সামনের বছরগুলোতে বড় চ্যালেঞ্জ।
জাতিসংঘ গত বছরের মে মাসে অনুমান করেছিলো গাজা পুনর্গঠনে খরচ হতে পারে ৪০ বিলিয়ন বা চার হাজার কোটি ডলার।
ত্রাণের সংকট
গাজায় গত কয়েক মাসে ত্রাণ সহায়তার পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হরে কমে গেছে। ত্রাণ ঢুকলেও অনেক সময় তা সঠিক জায়গায় পৌঁছাতে পারে না। গাজায় নিয়োজিত ত্রাণকর্মীরা জানিয়েছেন, আইনশৃঙ্খলা কাঠামো ভেঙে পড়ার কারণে অপরাধী চক্রগুলো ত্রাণ সহায়তা পৌঁছানোর সময় তা আটকে জিনিসপত্র লুট করে ফেলতো।
জাতিসংঘ জানিয়েছে, গাজার ৯১ শতাংশ মানুষ তীব্র খাদ্য সংকটে রয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে গাজায় সাম্প্রতিক যুদ্ধবিরতির পর সেখানে দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। কেননা প্রায় ১৯ লাখ মানুষের জরুরি আশ্রয় এবং প্রয়োজনীয় গৃহস্থালি সামগ্রী প্রয়োজন।
জাতিসংঘের সংস্থাগুলো জানিয়েছে যে, গাজার ৬৭ দশমিক ছয় শতাংশ কৃষিজমি গোলাবর্ষণ, যানবাহনের চলাচল ও অন্যান্য সংঘর্ষজনিত কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গাজা পুনর্গঠনে ১০ বছরেরও বেশি সময় লাগতে পারে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ।