মিন্টু রায়ের ‘কাঁটাতারে কান্না’ : গল্পের শরীরময় জীবনের স্বাদ
কেউ জীবন অস্বীকার করতে পারে না, পারে না জীবননিষ্ঠ গল্পগুলো। গল্প তা সুখের হোক বা দুঃখের হোক অভিঘাত পড়ে অন্তঃমননে। জীবনকে নিবিড়ভাবে দেখতে পারা লেখকের এক বিশেষ সক্ষমতা। শুধু দেখতে পারলে হয় না তাকে বুনতে হয় খ্যাপলা জালের মতো পিঠাপিঠি গিট দিয়ে-অচ্ছেদ্যভাবে। কখনও বসাতে হয় জিয়নকাঠি।
লেখকের ভাষা ও ভাব একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আরও বড় বিষয় সমাজের প্রতি তাঁর দায়। আধুনিক চিন্তায় লেখকের দায়কে হালকা করে দেখা হয়। কিন্তু আমাদের বাস্তবতায় লেখকের দায় এখনও পানসে হয়ে যায়নি।
গল্পকার মিন্টু রায়ের কাঁটাতারের কান্না গল্পগ্রন্থে বহুমাত্রিক সামাজিক ও রাজনৈতিক ইস্যু উঠে এসেছে। তাঁর প্রতিটি গল্প স্বতন্ত্র। মাটিগন্ধী। সমাজের বুক চিরে তিনি গল্পগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বের করে এনেছেন। গল্পগুলো পড়লে প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থার প্রতি অশ্রদ্ধা তৈরি হয়, বিরক্ত লাগে, রাগ ওঠে। পাঠককে রাগাতে বা সংক্ষুব্ধ করতে পারা লেখকের বিশেষ নৈপুণ্য।
গল্পসমগ্রের প্রথম গল্প মানবতার দেয়াল-এ এক করুণ সামাজিক বাস্তবতা উঠে এসেছে। গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র রোহান- যখন তার বয়স যখন পাঁচ বছর তখন তার মা স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে কাঙালি ভোজ নিতে গিয়ে ফেরার পথে রেললাইনে কাঁটা পড়ে।... সেই থেকে ছেলেটির খাবারের প্রতি মোহ নেই।
মায়ের আর্থিক অনটন, সামাজিক অবস্থা এবং খাবারকেন্দ্রিক চলে যাওয়ায় যে গভীর ক্ষত রোহানের মনের ওপর পড়ে তা শক্ত হাতে গল্পে চড়িয়েছেন। শুধু তাই নয়, মায়ের অন্তিত চলে যাবার পর মা তাকে যে দুই নম্বর রেল স্টেশনে রেখে গিয়েছিল। রোহান সেই দুই নম্বর স্টেশন ছাড়া কোথাও থাকে না। গল্পে আসছে- প্রতি সন্ধ্যেবেলা তার মা যেখানে কাটা পড়েছিল সেখানে গিয়ে সে নির্বাক দাঁড়িয়ে থাকে।
মায়ের চলে যাওয়া রোহানের খাবারের স্বাদ নিয়ে গেল। আর তাকে আবদ্ধ করলো এক বিশেষ স্থানে-দুই নম্বর রেলস্টেশন এখন তার শেষ নিশানা। মায়ের প্রতি সন্তানের চিরায়ত আবেগ গল্পে উঠে এসেছে দারুণভাবে।
গল্পের কেন্দ্রীয়চরিত্র রোহানের নাম নির্বাচনেও লেখক বিশেষ উদারতার পরিচয় দিয়েছেন। রোহানদের যে আর্থ-সামাজিক অবস্থা সেখানে রোহান নামটি খুব বেশি চল মনে হয় না। এমনকি রোহানের বন্ধুদের নাম নির্বাচনের ক্ষেত্রেও লেখক প্রচলিত খোপের বাইরে এসেছেন। রোহানের বন্ধুদের নাম চূড়ান্ত হয়েছে রাফি, শায়ন, প্রত্যয় ও অর্ঘ হিসেবে।
যাহোক, হঠাৎ একদিন রঙিন দেয়ালে ওপর ‘মানবতার দেয়াল’লেখাটি রোহানের চোখে লাগে। মানবতা সম্পর্কে তার পরিষ্কার ধারণা না থাকলেও মনে প্রশ্ন জাগে- আচ্ছা, মায়ের ভালোবাসা কি এখানে পাওয়া যাবে? আমার তো মায়ের ভালোবাসা খুব প্রয়োজন। এ হলো মায়ের জন্য রোহানের নিরন্তর হাহাকার।
একই গল্পে বৈপরীত্য ধরা পড়েছে। একদিকে মায়ের প্রতি ছেলের ভালোবাসা আর অন্যদিকে প্রবাসী ছেলের বাবার প্রতি উদাসীনতা ও অনীহা যুগপৎভাবে তুলে ধরতে লেখক মুনশিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। রোহানকে দিয়ে সেই গল্পের মোড় ঘুরিয়েছেন।
রোহানের ভাষায়- সোবহান চাচা ছেলে শান্তকে নিদারুণ কষ্ট করে বিদেশে পড়ালেখা করতে পাঠিয়েছিলেন। চাচা প্ল্যাস্টিক কারখানায় কঙ্কাল বানানোর চাকরি করতেন। শান্ত ভাইয়ার ম্যালা টাকা লাগবে-এমন প্রয়োজনে এবং মেডিকেলের ছাত্রদের অনুরোধে এবং দশ গুণ টাকার লোভে সোবহান চাচা মরা মানুষের আসল কঙ্কাল চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়েন। অপমানিত হন। হাজত খাটেন। চাকরিচ্যুত হন। রোহানের ভাষায়- সেই পোলায় এখন চাচারে ভুইলা গ্যালো।
মায়ের অনুপস্থিতি ছেলেরা যেমন সারাজীবন বুকে আগলে রাখেন। অন্যদিকে অনেক ছেলে বাবা-মার প্রতি সেই অনুরাগ ধরে রাখতে পারে না। জীবনে প্রতিষ্ঠার পর বাবা-মাকে অস্বীকার করেন, ভুলে যান।
এমন নানামাত্রিক গল্পের ঝাঁপি হলো মিন্টু রায়ের কাঁটাতারের কান্না গ্রন্থটি। কাঁটাতারের কান্না মোছা গল্পে উঠে এসেছে দেশভাগের করুণ উপাখ্যান এবং অসহায় চোখ গল্পে ছেলেকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করতে একজন বাবার পেরেশানির গল্প।
অন্য গল্পগুলো ভিন্ন ভিন্ন। প্রতিটি গল্পের ভেতরে রয়েছে আলাদা সুগন্ধি। গল্পের কেন্দ্রে রয়েছে মানুষ ও তাঁর সংগ্রাম, জয় ও পরাজয়ের উপাখ্যান। ভাষা প্রয়োগে লেখক অনেকক্ষেত্রে কথ্যভাষার আশ্রয় নিয়েছেন, যা গল্পের পাঠগম্যতা বাড়িয়ে দিয়েছে অনেকগুণ।
বইটি পড়তে পড়তে দুঃখবোধ জাগে। এ দুঃখবোধ একধরনের স্বাদ। মহৎ লেখকেরা যেমনটি বলেন-গভীর দুঃখবোধের ভেতর রয়েছে একধরনের সুখ। পাঠক যখন মিন্টু রায়ের গল্পগুলো পড়বেন তখন একধরনের বিশেষ সুখ পাবেন। গল্পগুলো পাঠে পাঠক সমৃদ্ধ হবেন নিশ্চিত। ১৪টি গল্প নিয়ে বইটি প্রকাশ করেছে শিলালিপি প্রকাশনী। অমর একুশে বইমেলার ৫৫৫ নম্বর স্টলে বইটি পাওয়া যাচ্ছে।