সাহিত্যে নোবেল
শরণার্থীজীবনের কথক আবদুলরাজাক গুরনাহ
সুইডিশ একাডেমি গেল কয়েক বছর এমন সাহিত্যিকদের নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করছেন, যাঁদের নিয়ে কারও কোনও ভবিষ্যদ্বাণীই খাটে না। এবারও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। সাহিত্যে এবার নোবেল বিজয়ী তানজানিয়ার ঔপন্যাসিক আবদুলরাজাক গুরনাহ। আফ্রিকান বংশোদ্ভূত সাহিত্যিকদের মধ্যে পঞ্চম বিজয়ী হওয়ার গৌরব অর্জন করলেন তিনি। সম্মানজনক পুরস্কারটি লেখক তাঁর ভক্ত ও অনুরাগী পাঠকদের প্রতি উৎসর্গ করেছেন।
ঔপনিবেশিকতার তীব্র সমালোচনা ও শরণার্থীদের জীবনগাথা নিয়ে লিখে ২০২১ সালে সাহিত্যে নোবেল জিতলেন তানজানিয়ান এই লেখক। এই সাহিত্যিক বালকবেলাতেই শরণার্থী হিসেবে তানজানিয়া থেকে ব্রিটেনে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন।
বিস্ময়কর হলো মিস্টার গুমরাহ ঔপনিবেশিকতার বড় সমালোচক হয়েও লিখেছেন শ্রেষ্ঠতম ঔপনিবেশিক ভাষায় এবং জীবনও কাটাচ্ছেন কলোনিয়ালিজমের ধারক ও বাহকদের ছত্রছায়ায়। আশাব্যঞ্জক ব্যাপার হলো, কলোনিয়ালিজমের প্রবক্তারা এই সময়ে এসে মুক্তমতের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে বদ্ধপরিকর। এই সুযোগটা পেয়েই মিস্টার গুরনাহ সুসাহিত্যিক হয়ে উঠতে পেরেছেন।
গেল বৃহস্পতিবার রয়েল সুইডিশ একাডেমির নোবেল কমিটি ফর লিটারেচার তাঁর নাম ঘোষণা করে। সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী ১১৮তম লেখক হিসেবে আবদুলরাজাক গুরনাহ সম্মাননা, মেডেল ও প্রশংসাপত্রসহ এক কোটি সুইডিশ ক্রোনার পাবেন।
পুরস্কার ঘোষণার পর গুরনাহ তাঁর প্রতিক্রিয়ায় বলেন, নোবেল জয়ের খবর আমার বিশ্বাসই হচ্ছিল না। ‘আমি শুধু ভাবছিলাম এটা কোনও ঠাট্টা হবে হয়তো। কিন্তু পরে দেখলাম আমিই সেটা পেয়েছি।’
কমিটি ফর লিটারেচার তাদের বিবৃতিতে বলেছে, আবদুলরাজাক গুরনাহর উপন্যাস গৎবাঁধা বর্ণনার বাইরে। উপন্যাসে তিনি পূর্ব আফ্রিকার সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য বিশ্বের অন্যান্য অংশের মানুষের কাছে সুনিপুণভাবে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন।
বিবিসির খবরে বলা হয়েছে, পূর্ব আফ্রিকার দেশ তানজানিয়ার ভারত মহাসাগরঘেঁষা দ্বীপ জানজিবারের এক সাধারণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করা আবদুলরাজাক গুরনাহর লেখায় নিপুণতার সাথে ফুটে উঠেছে ঔপনিবেশিকতার দুর্দশা আর শরণার্থীদের কষ্টের গল্প। আফ্রিকান অঞ্চলের রাজনীতির টানাপোড়েনও তাঁর গল্পের অন্যতম উপজীব্য। ৭৩ বছর বয়সী গুরনাহর মোট ১০টি উপন্যাস ও একটি ছোট গল্পের সংকলন রয়েছে।
উপন্যাসের মধ্যে ‘প্যারাডাইস’ ও ‘ডিসারশন’ অন্যতম। ১৯৯৪ সালে প্রকাশিত ‘প্যারাডাইস’ উপন্যাসে ২০ শতাব্দীর গোড়ার দিকে তানজানিয়ায় এক কিশোরের বেড়ে ওঠার গল্প বর্ণনা করা হয়েছে মহত্তম ভাষায়। ধারণা করা হয়, উপন্যাসটিতে লেখক তাঁর কারুণ্যেভরা নিজের জীবনই বিবৃত করবার প্রয়াস পেয়েছেন। পরে এটি সাহিত্যের অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ বুকার পুরস্কার জেতে।
১৯৪৮ সালে জন্ম নেওয়া গুরনাহ ১৯৬০ সালের শেষ দিকে শরণার্থী হিসেবে যুক্তরাজ্যে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। সর্বশেষ কেন্ট ইউনিভার্সিটির ইংরেজি সাহিত্য এবং পোস্ট-কলোনিয়াল স্টাডিজের অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত ছিলেন গুরনাহ। বর্তমানে তিনি অবসর জীবন যাপন করছেন।
বাংলা ভাষায় এই লেখকের খুব বেশি সাহিত্যকর্ম অনূদিত হয়নি। এ কারণে বাঙালি পাঠকের সাথেও এই লেখক তেমন পরিচিত নন। কিন্তু বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে তাঁর সাহিত্যসম্ভার মহত্তম অভিধায় অভিষিক্ত।
শরণার্থী দুঃখগাথার অনন্য রূপকার ও ঔপনিবেশিক দুর্দশায় নিপতিতদের শ্রেষ্ঠতম মুখপাত্র এবং শিকড়হীন প্রান্তিক মানুষের প্রতি সহানুভূতিশীল ও সংবেদনশীল মিস্টার আবদুলরাজাক গুরনাহকে আমরা হার্দিক অভিবাদন জানাই।
লেখক : সাংবাদিক