অনিকেত শামীম : পঞ্চাশ বছর পর
‘মোদ্দাকথা, আমরা ভিন্নতর একটা ঝড় তুলতে চাই। এই ঝড়েই কবর রচিত হবে স্বৈরতন্ত্রের, ছিঁড়ে যাবে শোষণের জাল, ভেঙ্গে যাবে সাম্রাজ্যবাদের সুউচ্চ প্রাচীর। আসুন এ ঝড় তুলতে সবাই অঙ্গীকারবদ্ধ হই।’
—শামীমুল হক শামীম, ১ ফেব্রুয়ারী ১৯৮৮
এক্ষণে যাঁহাকে আমরা ‘অনিকেত শামীম’ নামে চিনিয়া থাকি একদা তাঁহার নাম ছিল শামীমুল হক শামীম। কোন নামটি অধিক আধুনিক তাহা কে বলিবে! তাঁহার জন্মভূমি জামালপুর। এখন ঠিকানা ঢাকা। তাঁহার নানা চেহারা। এক চেহারায় তিনি ‘লোক’ পত্রিকার সম্পাদক। অনেক দিন ধরিয়া কেবল একেক লোকের জন্মদিন পালন করিয়া বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করিতেছেন তিনি। একটা কারণে আমিও তাঁহার অধমর্ণ। আমাদের শিক্ষক আহমদ ছফা যখন পরলোকগমন করেন তখন তিনি অনেকের আগে তাঁহার সম্পাদিত ‘লোক’ পত্রিকার একটি আহমদ ছফা সংখ্যা বাহির করিয়াছিলেন।
তিনি যে একদা ‘বিপ্লবী’ ছিলেন তাহাও আমি অতি সম্প্রতি জানিতে পারিয়াছি। আমি সেই বিপ্লবীর উদ্দেশে আজিকার এই শ্রদ্ধা নিবেদন করিতেছি। শামীমুল হক শামীমের দস্তখতে একদা ‘আবার একটা ঝড় উঠুক’ নামধেয় একটি কবিতা সংকলন রাজশাহী হইতে প্রকাশিত হইয়াছিল। ইহা ১৯৮৮ সালের কথা। অনিকেত শামীম—দেখা যাইতেছে—সেই যুগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশেষ নিকেত অর্থাৎ প্রতিষ্ঠালব্ধই ছিলেন।
সেই গ্রন্থের একটা ভূমিকা— ‘ভূমিকার পরিবর্তে’ শিরোনামে—লিখিয়াছিলেন দেশবরেণ্য কবি নির্মলেন্দু গুণ। কে না জানে গুণের লেখার প্রধান দৌলত তাঁহার প্রসাদগুণ! তিনি স্বভাবসিদ্ধ ওজনে নির্দেশ করিয়াছিলেন ‘প্রাকৃতিকভাবে লব্ধ এবং সামাজিকভাবে সৃষ্ট সম্পত্তির বণ্টন প্রশ্নে রাষ্ট্র-ব্যবস্থায় যে প্রতারণাপূর্ণ ভণ্ডামি বিদ্যমান, তার স্বরূপ উন্মোচন করে, শোষক শ্রেণীর বিরুদ্ধে শোষিত শ্রেণীকে সচেতন করাই কবির বিপ্লবী কর্তব্য।’ গুণের মতে, ‘নানা প্রকারের সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বাংলার কবিকুল মূলতঃ বিপ্লবের সেই মর্মবাণীকেই তাঁদের কাব্যে প্রকাশ করে চলেছেন।’ অবশ্য সঙ্গে সঙ্গে আরেকটি সত্য স্বীকার করিতেও কুণ্ঠিত হন নাই নির্মলেন্দু গুণ। তিনি অকপটে বলিয়াছিলেন, ‘এতদসত্ত্বেও বাঙালি জাতির চরম দুর্ভাগ্য এই যে, তাদের কবিতার বিপ্লব বাস্তবের বিপ্লবে পরিণত হয়নি।’
গুণের কথায় দোষের কিছু দেখি না, তবে কিনা গুণ যদি কার্যকারণটা বিশ্লেষণ করিয়া আর সামান্য আগাইতেন তবে নিশ্চয় দিব্যচোখে দেখিতেন এই না হওয়ারও একটা বিশেষ কারণ থাকিতে পারে। দুঃখের মধ্যে, সেই কারণের সন্ধানটা তিনি কোনদিনই আর পান নাই। তাঁহার সত্যপ্রীতি অবশ্য অতুলনীয়। তিনি প্রশ্ন তুলিয়াছিলেন, ‘ফলে মাইকেল, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সুকান্ত যে জাতির প্রধান কবি; বিপ্লব তো দূরের কথা, মোটামুটিভাবে গ্রহণযোগ্য গণতন্ত্রের স্বাদও সে জাতির ভাগ্যে জোটেনি। তার মাথার উপর দোর্দণ্ড প্রতাপে বিরাজিত স্বৈরাচারের খড়গ কৃপাণ। কেন এই অবস্থা? কবে এবং কিভাবে তার অবসান হবে—এই প্রশ্ন আজ জাতির সামনে।’ আমরাও একমত কবির সহিত—কেন এই অবস্থা!
যখনই পিছনে ফিরিয়া দেখি শিহরিয়া উঠি। জীবন যৌবন ধনমান—সকলই ভাসিয়া যায় কালস্রোতে। শামীমুল হক শামীম সম্পাদিত ‘আবার একটা ঝড় উঠুক’ সংকলনটি প্রকাশিত হইয়াছিল ১৯৮৮ সালের ১ ফেব্রুয়ারি তারিখে। এই সংকলনে নতুন ও পুরাতন কিংবা দেশি ও বিদেশি মিলাইয়া প্রায় ৬০ জন কবির—শুমার করিয়া দেখি তো মোট ৫৯ জনের—কবিতা ছাপা হইয়াছিল। ‘সূচিপত্র’ শব্দটি সচরাচর যেখানে লেখা হয় সেখানে এই কথাগুলি স্বনামেই বসাইয়া দিয়াছিলেন সম্পাদক শামীমুল হক শামীম—‘দুঃশাসন, দুঃসময় এবং শোষণের বিরুদ্ধে যাঁরা ঝড় তুলতে অঙ্গীকারবদ্ধ হলেন’। এই কবিদের মধ্যে কবি আতাউর রহমান হইতে বিসমিল্লাহ করিয়া খোদ শামীমুল হক শামীমও দেখি দাঁড়াইয়া রহিয়াছেন। কবি আতাউর রহমান আজ আর বাঁচিয়া নাই। আমি তাঁহার অনেক প্রীতি ও ভালোবাসা পাইয়াছিলাম।
শামীমের বহি বাহির হইবার প্রায় তিন বছর পর জেনারেল এরশাদের পতন হইয়াছিল। কিন্তু তাহাতেও দেশে বিপ্লব হইয়াছে এমন অপবাদ আমাদের শুনিতে হয় নাই। অবশ্য এরশাদের অহমিকা দমনকে কেহ কেহ নাগরিক অভ্যুত্থান বলিয়া কদর করিয়াছিলেন বৈকি! উপরে ‘ভূমিকার পরিবর্তে’ নামক যে লেখাটার কথা পাড়িয়াছি তাহার এক জায়গায় কবি নির্মলেন্দু গুণ জানাইয়াছিলেন, শামীমুল হক শামীমের ‘এই কাব্য সংকলনটি “বিপ্লব” শব্দটির হৃত গৌরব পুনরুদ্ধারে কিছুটা সহায়ক হবে।’ এখানে নেপথ্যেই বলিতেছি, ছাপাখানার ভূত হস্তক্ষেপ করিয়া নির্মলেন্দু গুণের ‘গৌরব’ শব্দটির বানান ‘গৌবর’ করিয়া দিয়াছিল।
ইহাকেই কি বলে অজ্ঞানের সত্যপ্রীতি? সত্যমিথ্যা জানি না, শুদ্ধ জানি অজ্ঞান বড় রসিক পুরুষ। তিনি ঘটনার পর ঘটনা ঘটাইয়াই চলেন।
আমাদের দেশের ঘটনার শেষ সেখানেই হয় নাই কিন্তু। নির্মলেন্দু গুণ দেশবরেণ্য কবি। তিনি আশা প্রকাশ করিয়াছিলেন, ‘রাষ্ট্র যন্ত্রটিকে দখল করা আর বিপ্লব করা যে সমার্থক নয়—এ ভ্রান্তি কিছুটা হলেও দূর হবে।’ আহা! সেই ভ্রান্তি আজও দূর হইল না। কিন্তু শামীমের বয়স হইল। আজ তাঁহার বয়স পঞ্চাশ হইয়াছে। তিনি বড় হইয়াছেন। পরিবর্তনের মধ্যে, তাঁহার নামটা একটু ছোট হইয়াছে। তিরিশ বছর আগে তিনি যে বিপ্লবের স্বপ্ন দেখিতেছিলেন সেই স্বপ্ন এখন আর দেখা যাইতেছে না। পূবের আকাশেও দেখা যাইতেছে না। পশ্চিমের আকাশ তো ঘনান্ধকারে ছাইয়াই গিয়াছে। যদি কেহ জোর করিয়া এখনও স্বপ্ন দেখেন তবে তাহা—লোকে বলিবে—দিবাস্বপ্ন বৈ নহে! কেননা সকাল হইয়াছে, পাখিসব কলরব করিতেছে। বাজারে নতুন শসা উঠিয়াছে। কেজি তিরিশ টাকা।
এখনও যাঁহারা স্বপ্ন দেখিতেছেন তাহাদের দিব্য দিয়া বলিতেছি, শামীমুল হক শামীমের পরিচয় এখন অনিকেত শামীম দাঁড়াইয়াছে। ভগবান তাঁহাকে শতায়ু করুন। এই প্রার্থনা ছাড়া পঞ্চাশ বছরের প্রাক্তন বিপ্লবীকে আমার অভ্যর্থনা জানাইবার আর কি ভাষা আছে!
৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮
দোহাই
১. আবার একটা ঝড় উঠুক, শামীমুল হক শামীম সম্পাদিত (রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় : উত্তরণ প্রকাশন, ১৯৮৮)।