বাংলাদেশের সাহিত্যিক বিভাজন
আমাদের দেশের সাহিত্যিক সমাজ কোনো অবিভাজ্য সত্তা নয়। রচনার ক্ষেত্রে যেকোনো লেখক অন্য আরেকজন লেখকের চাইতে ভিন্ন হবেন, এটাই স্বাভাবিক। আবার সমমনা কয়েকজন লেখক-কবি একত্র হবেন জাতীয় কোনো উদ্দেশ্য বা কর্মসূচি সামনে রেখে, এটি খুবই কাম্য। কিন্তু যখন এই একত্র হওয়ার পেছনে থাকে ব্যক্তিস্বার্থ এবং সমাজকে পেছনে ঠেলে নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্য, তখন তাদের চিহ্নিত করা অবশ্যপ্রয়োজন হয়ে দাঁড়ায়।
মনে রাখা দরকার, আমাদের দেশের এই সাহিত্যিক-বিভাজন এখন প্রায় অমোচনীয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই কারণে এখন চিহ্নিতকরণও সহজতর হয়ে উঠেছে। এমনকি এখন বিভিন্ন গ্রুপের পাণ্ডাদের নাম ধরে ধরেও চিনিয়ে দেওয়া সম্ভব। তবে নাম-উল্লেখ করা হচ্ছে না এই কারণে যে তাতে এই লেখার বিস্তৃতি অনেক বেড়ে যাবে। সেইসঙ্গে গ্রুপের কারো নাম বাদ পড়ে গেলে তিনি আবার আরো বেশি গোস্বা করে ফেলতে পারেন। পাঠকরা বরং নিজের নিজের মতো করে সাহিত্যিকদের নাম যোগ করে নিতে পারেন এই শূন্যস্থানগুলোতে।
১.
একটা গ্রুপ আছে, যার সদস্যরা নিজেদের অভিজাত লেখক-কবি মনে করেন। এবং আকারে-ইঙ্গিতে, কখনো কখনো সরাসরিও সে কথা প্রচার করতে দ্বিধাবোধ করেন না। তো কোন কোন বৈশিষ্ট্যের কারণে এরা নিজেদের অভিজাত বলে দাবি করেন? এরা আলিয়ঁস ফ্রাঁসেজে আসা-যাওয়া করেন। নিজেরা আড্ডা দিতে বসেন ধানমণ্ডি-উত্তরা-গুলশানের ব্যয়বহুল কফিহাউসগুলোতে। সন্ধ্যে কাটান কোনো বারে বা কারো বাসায় ভদকা-হুইস্কি সহযোগে। তা পয়সা থাকলে এটা যেকোনো লোকের জন্য খুবই সম্ভব। কিন্তু এরা নিজেদের মনে করেন দেশের একমাত্র ইন্টেলেকচুয়াল সাহিত্যিক গ্রুপ। তার ভিত্তি কী? প্রধান ভিত্তি হচ্ছে মার্কসবাদকে ঘৃণা করা। ব্যাকডেটেড এবং বাতিল বলে ঘোষণা করা। যদিও এরা মার্কস পাঠ করেছেন খুব অল্প। বেশি পড়েছেন মার্কসবাদের সমালোচনা। ফুকো-দেরিদা-সাঈদ কপচান কথায় কথায়। তবে সেগুলোও নিতান্তই ভাসা ভাসা। ভাবেন যে তারা ইংরেজি বই অনেক পড়েন। রবীন্দ্রনাথ পাঠযোগ্য নয়। পাঠের দরকার নেই। ফুয়েন্তেস পড়লেই চলবে। খুঁজে খুঁজে বিদেশের অখ্যাত কোনো লেখক-কবির নাম বলে বেড়ান কিছুদিন। ফেসবুক ফাটান তাদের নাম দিয়ে। দেশের কোনো ভালো লেখক-কবি সম্পর্কে তাদের উন্নাসিকতা দেখার মতো। এদের কথা শুনলে মনে পড়ে যায় তারাশঙ্কর সম্পর্কিত আবু সয়ীদ আয়ুবের উক্তি : ‘ও তো একটা গেঁয়ো!’ মনে পড়ে যায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাসের আলোচনা লিখতে গিয়ে ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের তাচ্ছিল্য। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে কখনো লিখছেন তিনি ‘মানিকচন্দ্র’, কখনো ‘মানিকলাল’। সুধীন দত্ত যেমন কবি মনে করতেন না জীবনানন্দ দাশকে, অথবা যথেষ্ট অভিজাত মনে করতেন না বুদ্ধদেব বসুকে। অভিজাত লেখকরা নজরুলকে যেমন কবি হিসেবে গ্রহণ করেননি। পরে সাহিত্য নির্ধারণ করে দিয়েছে যারা তাচ্ছিল্য করেছেন আর যাদের তাচ্ছিল্য করা হয়েছে, তাদের অবস্থান কার কোথায়। উপরোক্ত সেইকালের অভিজাতরা তো সাহিত্যে নিজেদের মতো করে কিছু অবদান রেখে গেছেন। আমাদের এই অভিজাতদের সেই পেয়ালা ঠনঠনে। পূর্বোক্তদের সঙ্গে এদের মিল কেবলমাত্র এক জায়গাতে। তা হচ্ছে এরা লেখার ক্ষেত্রে খুবই কোষ্ঠকাঠিন্যে ভোগেন। আর নিজেরা যা-ই লেখেন সেটাকে নিজে এবং সঙ্গীরা মিলে মহান রচনা বলে ঢোল বাজিয়ে চলেন। কেউ যদি সেই রচনার ঊনতার কথা উল্লেখ করে, তাকে এরা দলবেঁধে মূর্খ বলে প্রচার করতে থাকেন।
এরা আবার উত্তরআধুনিকও। শাহবাগের ধর্মনিরপেক্ষতার আন্দোলনের চাইতে হেফাজত ইসলামের শাপলা চত্বরের তাণ্ডব এদের কাছে বেশি প্রগতিশীল। আল মাহমুদ এদের কাছে শামসুর রাহমান, রফিক আজাদ, শিকদার আমিনুল হকের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। দেশের সব সাহিত্যমহলেই আল মাহমুদ গুরুত্বপূর্ণ কবি হিসেবে স্বীকৃত। কিন্তু এদের কাছে আল মাহমুদের এই গুরুত্ব নির্ণয় কিন্তু কবিতার গুণবিচারে নয়, বরং তার জামায়াতপন্থি এবং প্রগতিবিরোধী অবস্থানের কারণে। যেকোনো প্রসঙ্গে সুযোগ পেলেই তাদের আধ্যাত্মিক গুরুর নাম উল্লেখ করেন। এরা নানা তত্ত্বের আড়ালে মৌলবাদের জন্য বেশ কিছুটা জমি তৈরি করে দিতে সাহায্য করেন।
যখন বড় পত্রিকা এবং মিডিয়া তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করে, তখন এরা তা সর্বান্তঃকরণে হাত পেতে নেন। কিন্তু কোনো কারণে পৃষ্ঠপোষকতা থেকে বঞ্চিত হলে বলতে থাকেন যে, ওই সব পত্রিকার মান খুব পড়ে গেছে। সেখানে লেখা দেওয়া আর ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়া একই কথা।
নতুন লিখতে আসছে এমন সুন্দরী মেয়েদের তারা খুব পৃষ্ঠপোষকতা করেন। নতুন লিখতে আসা ছেলেদের সহজে কাছে ভিড়তে দেন না। তবে তাদের লেখার প্রশংসা করলে সঙ্গে সঙ্গে বুকে টেনে নেন।
নিজেদের অভিজাত এবং নাগরিক মানসিকতার বলে প্রচার করলেও এরা আসলে নিতান্তই গেঁয়ো এবং চূড়ান্ত মফস্বলি মানসিকতার ধারক।
২.
এই ধরনের সাহিত্যিকদের প্রধান বৈশিষ্ট্য ব্যক্তিত্বহীনতা। তার কারণ, এরা সরকারি দলের সঙ্গে থাকেন। এরশাদের সরকার, বিএনপি সরকার, আওয়ামী লীগ সরকার। সরকার পাল্টালে সরকারসম্পৃক্ত সেট পাল্টে যায়। তবু যেহেতু মূল বৈশিষ্ট্যগুলি একই রকম, তাই ইনাদের এক ক্যাটাগরিতেই ফেলা যায়। ইনাদের মধ্যে অনেকেই কিন্তু শক্তিশালী সাহিত্যিক ছিলেন। প্রবন্ধে, গবেষণায়, কাব্য-উপন্যাসে উল্লেখযোগ্য কাজ করেছেন অনেকেই। এখনো করছেন কেউ কেউ। কিন্তু সরকারের বিরাগভাজন হতে চান না বলে তারা জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ অনেক বিষয়ে মৌনব্রত পালন করেন। কখনো কখনো নির্লজ্জ মিথ্যাচারের সঙ্গে গলা মেলান। সরকার এবং তার সহযোগীদের অসংখ্য অন্যায়-অবিচারকে তারা সমর্থন জানান মৌনতা দিয়ে। প্রধান কারণ পদ-পদবি। সরকারের আনুগত্যের হিসেবে তারা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সভাপতি হন, মহাপরিচালক হন, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হন, অনেক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের উপদেষ্টা হন, বিদেশ ভ্রমণ করেন যথেচ্ছা, নানা ধরনের জানা-অজানা আর্থিক প্রণোদনা লাভ করেন।
এইসব পদে থাকার কারণে ডাক পান সভা-সেমিনারে, সম্মেলনে, মিডিয়াতে। নিজেদের মুখ বন্ধ রাখতে তারা বাধ্য। এই কারণে তাদের কোনো সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা থাকে না। পদে থাকাকালীন নানা ধরনের তোষামোদকারী তাদের ঘিরে থাকে। পদ থেকে সরে গেলেই কেউ তাদের চেনে না। এই ট্র্যাজেডি মেনে নিয়েই তারা বর্তমান অবস্থানকে উপভোগ করে থাকেন। আর সেইসঙ্গে গড়ে তোলার চেষ্টা করেন নিজেদের একটি চামচা লেখক-গোষ্ঠী। খুদ-কুড়োর লোভে জুটেও যায় ‘চামচারও চামচা’। গুণের দিকে না তাকিয়ে তারা সংখ্যাগত বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়ে সরকারকে দেখাতে চান যে তাদের সহযোগী এবং অনুগামীর সংখ্যা অনেক। সত্যিই, তাদের অনুষ্ঠানে রঙ-বেরঙের পাঞ্জাবিশোভিত পুরুষ, আর মেড ইন বিউটি পার্লার সুন্দরী নারী লেখকের সংখ্যা অগণ্য। লিখতে জানুক আর না জানুক, যেখানেই অনুষ্ঠান সেখানেই এরা ঝাঁক ধরে উপস্থিত।
ইনাদের পেটে বোমা মারলেও সরকারের প্রেসক্রিপশনের বাইরে একটা শব্দও উচ্চারণ করবেন না কেউ। চোখের সামনে অন্যায় হতে দেখলেও প্রতিকারের জন্য হাত বাড়াবেন না কিছুতেই। জাতীয় সম্পদ বিদেশীদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে দেখেও এরা নিশ্চুপ। ব্যাংক-বিমা লোপাট হয়ে যাবে, বন-জঙ্গল-নদী বেদখল হয়ে যাবে, সুশাসন পরিণত হবে অভিধানের শব্দে, শিক্ষা ব্যবস্থা হয়ে যাবে ধ্বংস— তবু এরা সেসব নিয়ে ভাবতে পর্যন্ত রাজি নন।
ইনারা সবচাইতে ক্ষতি করেন নিজেদেরই। ধীরে ধীরে লোভের কাছে, পেয়ে আবার হারানোর ভয়ের কাছে আত্মসমর্পণের মাধ্যমে হত্যা করেন নিজেরই লেখকসত্তাকে।
৩.
আরেকটি গ্রুপ আছেন যারা একাডেমিক কারণে এবং চাকরিসূত্রে সাহিত্যিক। চাকরি করেন মিডিয়াতে, সংবাদপত্রে, সাহিত্য পত্রিকায়, বাংলা একাডেমিতে, শিশু একাডেমিতে, বিশ্ববিদ্যালয়ে। ফলে তারা অটোমেটিক সাহিত্যিক তকমা পেয়ে যান। লেখা ছাপার সুবিধা তাদের চাকরিসূত্রে প্রাপ্ত। এদের মধ্যে যারা প্রকৃত সাহিত্যিক আছেন, তারা অবশ্য সহকর্মীদের নিয়ে অস্বস্তি বোধ করেন। কিন্তু সিংহভাগই চাকরির সুযোগটা গ্রহণ করেন পুরোপুরি। পারস্পরিক লেনদেনের মতো করে তারা একে অন্যের লেখা ছাপান, বাহবা দেন, ফেসবুকে নানা ধরনের অনুষ্ঠানের ছবি-খবর শেয়ার করেন। আগের গ্রুপের মতো অতটা খাতির না পেলেও এরাও চেয়ারের বদৌলতে দেশে-বিদেশে বাংলাদেশের সাহিত্যের প্রতিনিধি হিসেবে যোগদানের সুযোগ পান। ইনাদের বলা যায়—পেটি প্রভাবশালী। গতানুগতিক লেখা চালিয়ে যান বছরের পর বছর। কিন্তু প্রত্যাশা করেন, অন্যেরা যেন তাদেরকে মহান কবি কিংবা মহান কথাশিল্পী হিসেবে বিবেচনা করেন। মাঝেমধ্যে এরা দলবেঁধে উপরঅলাদের কানভাঙানি দিয়ে কোনো কোনো লেখককে শিক্ষা দিতে চান। যাতে অন্যেরা তাদের ভয় পায়। যেহেতু তারা কিছুটা ক্ষমতার সঙ্গে সম্পৃক্ত, তাই কিছু উমেদার-তোষামোদকারীও তাদের জোটে।
৪.
আছে ধর্মীয় সাহিত্যিক গ্রুপ। সব ধর্মেরই আছে। তবে যেহেতু বাংলাদেশ মুসলমান প্রধান, তাই ইসলামী সাহিত্য নামে একধরনের সাহিত্য সৃষ্টিতে আগ্রহীদেরই বেশি চোখে পড়ে। এদের মধ্যে একটি অংশ আছেন, যারা সরাসরি মৌলবাদের প্রসারে কাজ করেন। অন্যেরা ইসলামের সেবা করছেন ভেবে সাহিত্যচর্চা করেন। তবে শিল্পবোধ-নান্দনিকতাবোধের অভাব, চিন্তার অগভীরতা, দেশ ও সমাজকে না চেনার কারণে এদের রচনা সাহিত্য পদবাচ্য হয়ে ওঠে না। কেউ তেমন পড়ে না তাদের লেখা। সাহিত্যিক-সমাজে এদের কোনো প্রভাব নেই।
৫.
দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা লেখকদের অসংগঠিত একটি দল আছে, যাদের জীবনের মূলকাজ হচ্ছে সাহিত্য। তাদের চিন্তায় সার্বক্ষণিক বিরাজমান বিষয়— সাহিত্য। এরা সত্যিকারের ধর্মনিরপেক্ষতা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, উদারনীতি নিয়ে লেখালেখি করেন। কোনো গডফাদার বা সিঁড়ি খোঁজেন না। কারণ তারা জানেন যে, সাহিত্যিক জীবনের উদ্দেশ্য হচ্ছে আরো ভালো লেখা, আরো ভালো লেখা... যে ভালোর কোনো শেষ নেই। কলাকৈবল্যবাদ বা অন্য কোনো মতবাদ এদের দ্বিধাগ্রস্ত করতে পারে না। কারণ তারা জানেন যে শিল্প একই সঙ্গে শিল্পের জন্য এবং মানুষের জন্য। সমাজ নিংড়ে মানুষকে তুলে আনলেই সেটা সাহিত্য পদবাচ্য হবে না, যদি তার শিল্পগুণ না থাকে। আবার শিল্পের নামে কেবল শব্দ ও কব্জির কেরামতিটাও সাহিত্য নয়।
এরা সাহিত্যিক দায়বোধ থেকেই যুক্ত হন দেশ ও মানুষের জন্য সকল সংগ্রামে। এরাই মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেন, সামাজিক অবিচারের বিরুদ্ধে সরব থাকেন, দেশের স্বার্থবিরোধী যেকোনো পদক্ষেপের কারণে সরকারকে তীব্র সমালোচনা করেন, প্রতিবাদে রাজপথে দাঁড়ান, লংমার্চ করেন। এদের কেউ কেউ রাজনৈতিক দলের সদস্য হলেও সেই দলের সিদ্ধান্তকে প্রয়োজনে অমান্য করার সাহস রাখেন। এরা সাহিত্য এবং সামাজিক দায়বোধের কারণে নিজেদের জীবন ও জীবিকার ঝুঁকি নিতে দ্বিধা করেন না। এই দেশে লেখালেখির উপার্জন দিয়ে জীবিকা নির্বাহ সম্ভব নয়। তাই এদের কোনো-না-কোনো পেশা আছে। কিন্তু পেশা এদের খেয়ে ফেলতে পারে না।
এরাই আমাদের দেশের সাহিত্যের মূলধারাটিকে বয়ে নিয়ে চলেন। পুরস্কার-পদ-পদবি-বিদেশভ্রমণ এবং কখনো কখনো নির্যাতনও এদের ভোলাতে পারে না যে— শিল্পই সত্য, আর সত্যই শিল্প।