রম্যগল্প
বাঙালি দম্পতির নোবেল বিজয়
ছুটির দিন একটু আগেভাগেই উঠতে হয় মইন সাহেবকে। অফিস চলাকালীন দেরিতে উঠলেও চলে, কিন্তু ছুটির দিন? নো ওয়ে। ভোরে উঠেই নাশতা বানাতে হয়। ময়লা কাপড়গুলো আলাদা করতে হয়। কর্মতালিকার এই কাজটা সবচেয়ে কনফিউজিং মনে হয় তাঁর কাছে। একটা কাপড় তুলে ভালো করে দেখেন। নাহ, ময়লা একটু কম, আরেক সপ্তাহ চালিয়ে নেওয়া যাবে। আরেকটা তুলে ভালো করে দেখেন, গন্ধ শোঁকেন। আগেরটার চেয়ে গন্ধ অনেক কম। এক সপ্তাহ অনায়াসেই যাবে। আরেকটা তুলে নাকের কাছে ধরেন, নাহ ময়লা বেশি হলেও গন্ধ কম। আরেকটায় গন্ধ বেশি হলেও ময়লা কম। নো চিন্তা, বডি স্প্রে আছে না? বেশি করে স্প্রে মারলে আরেক সপ্তাহ শুধু চলবেই না, টাট্টু ঘোড়ার মতো দৌড়াবে।
নিজের কাপড় ধোয়া নিয়ে কোনো সমস্যা নেই লতিফ সাহেবের। ময়লা আর দুর্গন্ধ যত বেশি হয়, ততই সুবিধা। ফার্মগেট থেকে ঠেলেঠুলে বাসে উঠেছেন। মিরপুর-১৪ যাবেন। মিরপুর-১০-এর আগে সিট পাওয়ার কোনো সম্ভাবনাই নেই। অথচ তাঁকে দেখে অধিকাংশ সময় ডাবল সিট খালি হয়ে যায়। ওই যে পোশাকের পারফরম্যান্স! কার বাপের সাধ্য আছে তাঁর পাশে পাঁচ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকে?
নিজের কাপড় না ধুলেও বউয়ের কাপড় ঠিকই ধুয়ে দিতে হয় নিয়মিত। এটা তাঁদের শান্তিচুক্তির অংশ। অলিখিত এ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে বাসর রাতে। ১০ বছর ধরে সব শর্ত পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বাস্তবায়ন করে চলছেন তাঁরা।
বিয়ে পড়ানোর সময় কাজি মইন সাহেবের হাত ধরে বলেছিলেন, নারী অবলা। ডিমের খোসা যেমন কুসুমকে আগলে রাখে, স্বামীর কর্তব্য স্ত্রীকে বুকের মাঝে আগলে রাখা। স্ত্রীকে হুমকি-ধমকি দেওয়া যাবে না। স্ত্রী অবাধ্য হলে তাঁকে সুপথে ফিরিয়ে আনতে হবে বোঝানোর মাধ্যমে। স্ত্রীর নিরানব্বইটা অপরাধ ক্ষমা করে একশতম অপরাধে শাসন করতে হবে। তাও হালকা শাসন। তাহলেই সংসারে সুখ-শান্তি বিরাজ করবে। শাসনের কথা শুনে আনন্দে ঝিকিমিকি করে উঠেছিল লতিফ সাহেবের মুখ। মনে মনে বলেছেন, নিরানব্বইতম অপরাধ ক্ষমা করব ঠিক আছে, তয় শততম অপরাধে হালকার ওপর ঝাপসা এমন টাইট দেব ১০ বছর মনে থাকবে।
মনের কথা মনেই চেপে রাখতে হয়েছে মইন খানকে। বাসরঘরে বিলাই মারার প্রস্তুতি নিয়ে গিয়ে দেখেন, বউ বাঘ মেরে বসে আছে। নাটক-সিনেমায় দেখেছেন, নতুন বউ আড়াই হাত ঘোমটা টেনে বসে থাকে। আজ বুঝলেন, নাটক-সিনেমায় যা দেখায় সব বোগাস। ঘোমটার কাপড়টুকু আড়াই প্যাঁচে বউয়ের কোমরে বান্ধা। বুকের ভেতরটা শুকিয়ে সাহারা হয়ে গিয়েছিল। নায়িকা সাহারা না, মরুভূমি সাহারা। সংসারজীবনের ইশতেহার পেশ করল বউ। সঙ্গে শান্তিচুক্তির শর্ত ও রূপরেখা। এতে করে কাপড় ধোয়া, বাসন মাজা, আন্ডা-বাচ্চা হলে তার ন্যাপি বদলানো, মশারি টাঙানো, বাজার করা, রান্নাসহ কর্মমুখর সব শর্ত মইন সাহেবের ভাগে। তাই বলে ভাবছেন বউ কিছুই করবেন? না, তা কিন্তু না। শপিং করা, পার্লারে যাওয়া, টিভির রিমোট দেখেশুনে রাখার মতো কাজগুলো বউ করবে। যাক, সব কাজ তো আর মইনকে করতে হলো না, এটাই বা কম কিসে?
কিন্তু এভাবে কত দিন? তাঁর মধ্যে বিপ্লবী চেতনা মাথা চারা দিয়ে উঠতে শুরু করেছে। তিনি যে বিপ্লবের পথে আগাচ্ছেন, সেটা বোঝাতে বিশ্বের নামকরা সব বিপ্লবীর ছবি টাঙালেন ঘরে। চে, স্টালিন, মার্কসদের বই পড়া শুরু করলেন স্ত্রীকে দেখিয়ে। ততদিনে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ‘আরব বসন্ত’ নামে একের পর এক বিপ্লবে স্বৈরশাসকদের পতন শুরু হয়েছে। মইন সাহেব টিভিতে এসব খবর দেখেন আর বিজয়ের উল্লাস করেন।
কিছুটা নমনীয় হয়ে স্ত্রী আলোচনার টেবিলে ডাক দিলেন। মইন সাহেব মহাখুশি। জালিম শাসকের টনক নড়েছে। আলোচনায় শর্ত দিলেন। মেয়েলি কাজগুলো সে করতে পারবে না, বিশেষ করে রান্না। স্ত্রী জানালেন, সে সারা দিন পার্লার, সমাজসেবামূলক সেমিনার, শপিং নিয়ে বিজি থাকে। এবং এসব কাজে বাইরে গেলে খাবারের ব্যবস্থা হয়ে যায়। সো, বাসায় রান্না না হলেও তাঁর সমস্যা নেই। মইন সাহেব নড়েচড়ে বসলেন। রান্নার ব্যাপারটা তোলা তাঁর বড্ড ভুল হয়ে গেছে। আসলেই বাসায় রান্না না হলে বউয়ের কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু বাপ-দাদার পৈতৃক সূত্রে পাওয়া আলসার ও গ্যাস্ট্রিকের দরুন বাইরের খাবার একদিন খেলে তিন দিন ঊর্ধ্বচাপে ভুগতে হয়। আবার কিছুদিন হলো শুরু হওয়া ডিসেন্ট্রি ভয়াবহ নিম্নচাপ সৃষ্টি করছে। দ্বিমুখী চাপের হাত থেকে বাঁচতে হলে রান্না তাঁকেই করতে হবে। স্ত্রীকে বিপদে ফেলতে গিয়ে নিজেই ফলোঅনে পড়ে গেলেন? বাকি থাকে কাপড় কাচা। কাপড় না কাচলে বিপদ স্ত্রীর বেশি। ‘যার কাপড় তার কাচা’ বলে বেঁকে বসলেন মইন সাহেব। নাও, বল অন দ্য স্ত্রীর নেটে। বউ শান্ত ভঙ্গিমায় মইন সাহেবের কাঁধে হাত রাখলেন, ‘এ সংসারটা তো আমাদের দুজনেরই! যা কিছু করার মিলেমিশে করতে হবে না? ঠিক আছে, তোমার রান্নাবান্নায় আমি সাহায্য করব, আমার কাপড় কাচায় তুমি সাহায্য করবে।’
বউয়ের মুখে সন্ধির সুর আনতে পারাটাই মইন খানের জন্য বিরাট নৈতিক বিজয়। তিনি ভি-চিহ্ন দেখাতে গিয়েও দেখালেন না। বিজয় উল্লাস করে পরাজিতের মনে আঘাত দেওয়ার মতো পাত্র তিনি নন।
আনন্দের ঘটনা চেপে যাওয়া মুশকিলের কাজ। মইন সাহেবও পারলেন না। দীর্ঘদিনের বন্ধু আসিফকে সব হরহর করে বলে দিলেন পরের দিনই। বন্ধুর বিজয়ে মহাখুশি আসিফ সাহেব সুযোগ বুঝে ট্রিট আদায় করে নিয়ে হাসতে হাসতে কেটে পড়লেন।
এর মাসখানেক পর, প্লাস-মাইনাসসহ অনেক ডিজিটের নম্বর থেকে কল এলো মইন সাহেবের নম্বরে। তিনি বুঝলেন, নিশ্চয়ই বিদেশ থেকে কেউ ফোন করেছে। ‘ইংলিশ ফর টুডে’ বইটা সামনে নিয়ে ফোন রিসিভ করলেন। কথা বললেন। কলটা এসেছে নরওয়ে থেকে। ছোটবেলা থেকে টুকটাক লেখার অভ্যাস ছিল মইন সাহেবের, তা ছাড়া অফিসে তাঁকে নিয়মিত হিসাব-নিকাশও করতে হয়। ক্লাস নাইনে একবার জীববিজ্ঞান ক্লাসে কেঁচোর ব্যবচ্ছেদ করেছিলেন। নোবেল কমিটি যেহেতু ফোন দিয়েছে, তিনি নিশ্চিত এবার নোবেলপ্রাপ্তদের মধ্যে তাঁর নাম আছেই। কিন্তু কনফিউশনে পড়ে গেলেন মইন সাহেব। সাহিত্য, অর্থনীতি নাকি চিকিৎসা—কোন শাস্ত্রে তাঁকে নোবেল দেওয়া হচ্ছে? কমিটি থেকে জানানো হলো, শান্তিতে তিনি নোবেল পাচ্ছেন। তাঁর সঙ্গে যৌথভাবে তাঁর স্ত্রীও পাচ্ছেন। বউয়ের কাপড় কাচায় সাহায্য করায় তাঁকে এবং তাঁর রান্নায় সাহায্য করায় বউকে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। তাঁদের শান্তিচুক্তির ব্যাপারটা নোবেল কমিটির কানে দেন বন্ধু আসিফ।
বি.দ্র. : শেষমেশ নোবেল নেওয়া হয় নাই মইন দম্পতির। পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে গিয়ে কে আগে পুরস্কার আনতে যাবে, এটা নিয়ে ঝগড়া বেঁধে যায় দুজনার মাঝে। কারণ, শান্তিচুক্তির কোনো ধারায় নোবেল পেলে কে সেটা আগে গ্রহণ করবে, এ বিষয়টি উল্লেখ ছিল না। সেই দ্বন্দ্ব থামাতে পুলিশ এসে নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব বাধিয়ে দেয়। একদল পুলিশ মইন খানের পক্ষ নেয়, আরেক দল পুলিশ নেয় স্ত্রীর পক্ষ। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত নরওয়ের পুলিশ বিভাগ দুই ভাগে ভাগ হয়ে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এ অবস্থা দেখে নোবেল কমিটি বাঙালি জাতিকে ‘বিভাজন প্রিয় জাতি’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে।