জাকির তালুকদারের গদ্য
লেখকের জীবন
লেখকের বেঁচে থাকার প্রথম শর্ত তাঁর পরিবারের স্বীকৃতি। এখানে স্বীকৃতির অর্থ হচ্ছে, লেখালেখি যে একটি কাজ, অন্য কাজের মতোই একটি কাজ এবং সে কাজের জন্য মনোযোগ, সময় ও শ্রম বিনিয়োগ করতে হয়—এই বোধ তৈরি হওয়া। লেখালেখিকে মহাগুরুত্বপূর্ণ কাজ হিসেবে নাই বা ধরা হলো। কিন্তু এটি যে একটি কাজ, এই স্বীকৃতিটা পরিবার থেকে আসা খুব প্রয়োজন। জীবন-মরণের সমান প্রয়োজন। আমাদের দেশের বেশির ভাগ প্রতিশ্রুতিবান লেখক শেষ পর্যন্ত যে লেখক হয়ে উঠতে পারেন না, লেখকজীবন যাপন করতে পারেন না, লেখালেখির জগৎ থেকে তাদের যে অকালে বিদায় নিতে হয়, তার সবচেয়ে বড় কারণ এটাই। পারিবারিকভাবে লেখালেখিকে একটি কাজ হিসেবে স্বীকৃতি না দেওয়া।
দেশের অন্য সব মানুষের মতোই বেশির ভাগ পরিবারে লেখালেখি নেহাত শখের একটি জিনিস। তারুণ্যে বা অঙ্কুরোদ্গমী যৌবনে যৌনতার চুলকানির মতো কবিতার চুলকানিও পেয়ে বসে আমাদের দেশের মানুষকে। তখন তাদের লেখাকে বাহবা দেয় বাড়ির ভাবিরা, কাকা-জ্যাঠারা, সহপাঠীরাও। কখনো কখনো, এমনকি মা-বাবারাও। তারা সকলেই অবচেতনে এবং নিজের অভিজ্ঞতা থেকে জানে যে, এই চুলকানি বেশিদিন থাকবে না। কিন্তু যার ক্ষেত্রে এটি থেকে যায়, অর্থাৎ যে বুঝে ফেলে যে লেখক হওয়াটাই তার ভবিতব্য, সমস্যা হয় তার ক্ষেত্রে। কেননা, সে যে অপরিবর্তনযোগ্য মানসিক গড়নটা ইতোমধ্যে পেয়ে গেছে, তা পরিবারের অন্য কারো কাছে বোধগম্য হয় না কিছুতেই। যেসব শখের ব্যাপারের সঙ্গে বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিচিত, যেমন—বাগান করা, ছুটির দিনে বড়শি নিয়ে মাছ ধরতে যাওয়া, সিনেমা-থিয়েটার দেখা, বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে মাঝেমধ্যে হৈ-হল্লা করা, কাছে-দূরে বেড়াতে যাওয়া, এমনকি একটু-আধটু নেশাভাঙ করা, মায় কালে-ভদ্রে *বাজি করা নিয়েও পরিবারের লোকজন তেমন বেশি চিন্তিত হয় না। লেখালেখিকেও পরিবারের মানুষরা সেই রকম একটি শখের ব্যাপার বলেই মনে করে।
লিখবে না কেন, লিখবে। তবে বাপু সব কাজ করার শেষে। মধ্যবিত্তকে যা যা করতে হয়, সেইসব গ্লানিময় দিনযাপনের সব শর্ত পূরণের পরে, বাড়ির বাজার-সওদা করে দেবার পরে, বিরক্তিকর সামাজিক অনুষ্ঠানগুলোতে অংশ নেবার পরে, দাম্পত্যসঙ্গীর সঙ্গে মৈথুন সমাপ্ত করার পর তুমি গিয়ে যদি লিখতে বসো, আর সেই লেখার সময় যদি অন্য কারো ঘুমের বা কাজের সামান্যতম ব্যাঘাত না ঘটে, তাহলে কারো কোনো আপত্তি নেই। যত দিন লেখালেখি সেই রকম শৌখিন শখের পর্যায়ে থাকে, তত দিন কারো কোনো সমস্যা নেই।
বলা বাহুল্য পরিবারের এই মানসিকতাও নির্ধারণ করে দিয়েছে সমাজ এবং রাষ্ট্র। আমার ছেলে শিক্ষক বা ডাক্তার, আমার মেয়ে ম্যাজিস্ট্রেট, আমার ছেলে পলিটিশিয়ান, আমার মেয়ে করপোরেট অফিসের চাকুরে, এমনকি আমার ছেলে পুলিশ বা ঠিকাদার বলতেও কোনো অসুবিধে নেই কারো। কিন্তু আমার ছেলে বা মেয়ে লেখক—এমন কথা কাউকে এ দেশে কোনোদিন বলতে শোনা যাবে বলে মনে হয় না। সমাজই নির্ধারণ করে দিয়েছে যে লেখকের পরিচয়টা হবে অন্য পরিচয়ের লেজ হিসেবে। শুধু লেখক হিসেবে নিজেকে চিহ্নিত করার কোনো সুযোগ এ সমাজ দিতে রাজি নয়। দলিল লেখক পরিচয়ও মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু লেখক পরিচয়? অসম্ভব!
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস বলছে, এ রকম পরিস্থিতিতেও আত্মসমর্পণ করেন না কেউ কেউ। করেন না বলেই বাংলাসাহিত্য টিকে রয়েছে। যতটুকু বিকশিত হওয়ার কথা, ততটুকু না হলেও বিকশিত হয়েছে এবং হচ্ছে। সেই কেউ কেউ-এর দলে একরোখা অশ্বের মতো যে টিকে যায়, সে যে জেদের বশে টিকে থাকছে, তা নয়। বরং সে সত্তার অপরিহার্য অংশ হিসেবে লেখালেখিকে গ্রহণ করেছে বলেই এই কাজটি ছেড়ে যেতে পারছে না। অথবা বলা যায়, এটিই তার সত্তার সর্বপ্রধান অংশ।
আবার পরিবারকেও সে ত্যাগ করছে না। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে সে নিজেই পরিবারের প্রধান উপার্জনকারী। কখনো কখনো একমাত্র উপার্জনকারীও বটে। এটি প্রায়ই দেখা যায়। পৃথিবীতে বোধ হয় বাংলাদেশই একমাত্র দেশ, যেখানে একটি পরিবারে একজনই শুধু উপার্জন করে, আর নয়-দশজন মানুষ তার ঘাড়ে বসে খায়। শুধু খায়-ই না, একটু এদিক-ওদিক হলেই যার ঘাড়ে বসে আছে তারই বুকে-পিঠে লাথি মেরে চলে। তো, এ অবস্থাতেও লেখক নিজের ওপর অর্পিত পারিবারিক-সাংসারিক দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে দাঁতে দাঁত চেপে। চাকরি করছে বা ব্যবসা করছে, বাবা-মাকে খাওয়াচ্ছে-পড়াচ্ছে-ডাক্তার দেখাচ্ছে-ওষুধ কিনে দিচ্ছে, ভাইবোনের পড়ার খরচ চালাচ্ছে, তাদের খাই-খরচা হাতখরচা দিচ্ছে, ছেলেমেয়েকে মধ্যবিত্ত জীবনের সকল অপরিহার্য এবং আবদেরে উপাদান জুগিয়ে চলেছে, স্ত্রীর সকল দাবি মেটাচ্ছে, সামাজিকতা করছে, অতিথি আপ্যায়ন করছে, পরিবারের সকলের ঈদ-পরব তো বটেই, ফেতরার টাকারও জোগান দিচ্ছে, পরিবারের সকলের জন্য মোবাইল হ্যান্ডসেট কিনে দিচ্ছে, তাদের কথা বলার খরচও জোগাচ্ছে, মাসে মাসে পানি-বিদ্যুৎ-গ্যাসের বিল মেটাচ্ছে, পৈতৃক ভিটার বাৎসরিক খাজনা শোধ করছে, টিনএজ ভাই মাঝেমধ্যে মাস্তানি করতে গিয়ে মামলায় জড়ালে থানা-পুলিশের খরচা দিচ্ছে। স্ত্রী হয়তো কোনো বেসরকারি স্কুলে বা কলেজে ঢুকেছে বিয়ের পাঁচ-সাত বছর পরে। প্রখর আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন লেখক কোনোদিন শুনতেও চায়নি তার স্ত্রীর বেতন কত। টাকা নেওয়া তো দূরের কথা। সবটুকুই তাই তার একার কাঁধেই বর্তেছে। এবং সেটা সে পালন করে চলেছে নির্বিবাদে, নি-প্রশ্নে। তার পরেও সবার মুখেও অসন্তোষের ছায়া। কেননা সে এরপরেও লেখা চালিয়ে যাচ্ছে।
সারা দিনের শারীরিক-মানসিক পরিশ্রমের পরেও নিজের বিশ্রামের সময়টুকু ঢেলে দিচ্ছে লেখালেখির পেছনে। নিজের জন্য আলাদা কোনো বিরাম-বিনোদনের জায়গা রাখেনি। নিজের জন্য খরচ বলতে রেখেছে হয়তো সিগারেটের বিল আর বই-পত্রিকা কেনার টাকা। এর পরেও সকলেই তার ওপর অসন্তুষ্ট। কেননা, তাদের ধারণা সে যদি লেখালেখি না করত, তাহলে উপার্জনে আরো বেশি সময় ব্যয় করতে পারত। তাদের জন্য আরো কিছু বাড়তি স্বাচ্ছন্দ্য ও বাড়তি বিলাসিতার আয়োজন করতে পারত। তার পোষিত রক্ত-আত্মীয়রা নিজেদের যোগ্যতার কথা ভাবে না, নিজেরা যোগ্যতা অর্জনের কথা চিন্তা করে না। তারা শুধু বলে, তোমার মতো একই পেশায় থেকে অমুক অমুক মানুষ এই এই সম্পদ গড়েছে, তাদের বিলাসিতার কোনো সীমা-পরিসীমা নাই। তাদের তুলনায় আমাদের অবস্থা পথের ভিখিরির মতো। তুমি লেখালেখি নামক এই অদ্ভুতুরে কাজে সময় নষ্ট না করলে তাদের মতো আমাদেরও সব হতো, অনেক বেশি বেশি হতো। তুমি আবার সততা ছাড়বে না। কারণ তুমি বিশ্বাস করো যে লেখকের অসততার ছায়া তার সৃষ্টির মধ্যে মুখ দেখিয়ে দেয়। তুমি বিশ্বাস করো যে অসৎ ব্যক্তি কোনো দিন বড় লেখক বা বড় শিল্পী হতে পারবে না। তাই সকল অসৎ পন্থা থেকে তুমি দূরে সরে শুধু থাকো তা-ই নয়, যারা অসততার বিরুদ্ধে ক্ষীণকণ্ঠে হলেও কথা বলে, তুমি নিজেও তাদের সুরে সুর মেলাও। ফলে তোমার উপার্জন কমে, এবং শত্রু বাড়ে।
আবার দ্যাখো, বিদেশে চাকরি বা নাগরিকত্বের সুযোগ পেলেও তুমি ডলার-পাউন্ড কামানোর জন্য দৌড়ে যাও না। কারণ হিসেবে বলো যে তুমি বাংলা ভাষার লেখক। বাংলাদেশের মাটিতে না থাকলে লেখকের অপমৃত্যু ঘটবে। বিদেশে গিয়ে, অন্য দেশে গিয়ে কেউ লিখতে পারে না। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর মতো শক্তিমান লেখক পারেননি। শহীদ কাদরীর মতো কবি নিঃশেষ হয়ে গিয়েছেন। আরো শত শত প্রতিশ্রুতিশীল লেখক ফুরিয়ে গেছে। আহা কী এমন লেখক তিনি হয়েছেন! হতো যদি হু-মি-আ-দের মতো কেউ, তাহলেও নাহয় বোঝা যেত।
তার আরো ধনী না হওয়ার জন্য দায়ী লেখালেখি। তার একগুঁয়ে সততার জন্য দায়ী তার লেখালেখি। তার তোষামোদ করার অক্ষমতার জন্য দায়ী তার লেখালেখি। মুখের ওপর সত্যি অপ্রিয় কথা বলে দেওয়ার অভ্যাস তৈরি হয়েছে এই লেখালেখি থেকেই। মন্ত্রী-এমপি-আমলা-বিগশট ব্যবসায়ীদের সে মানুষ বলেই গণ্য করে না। এই প্রবণতা তৈরির পেছনের বারণও সেই লেখালেখি। সবচেয়ে ভয়ংকর কথা—সে মানুষের ভেতরটা দেখে নিতে পারে। তার চোখের দিকে তাকিয়ে তাই বেশিক্ষণ কথা বলাও মুশকিল। এই সর্বনেশে ক্ষমতা অর্জনের পেছনের কারণও লেখালেখিতে মনপ্রাণ সঁপে দেওয়া।
অতএব, লেখকের চারপাশের দেয়াল প্রতিমুহূর্তে আরো বেশি করে চেপে আসতে চায়। তার শ্বাসরোধ করে তাকে বাধ্য-সুবোধ বানাতে চায় সকলেই। তার সংবেদনশীলতা এবং সবার জন্য বুকভরা ভালোবাসার সুযোগ নিয়ে তাকে সোশ্যাল এবং ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করতে চায় তারা।
এ রকম পরিস্থিতিতে মাঝেমধ্যে আত্মহত্যার কথা ভাবে লেখক। তখন তার জন্য বিশুদ্ধ বাতাস এবং অক্সিজেনের জোগান দিতে এগিয়ে আসে আরেকটি পরিবার। বছরের পর বছর মানসিক রক্তপাতের কারণে তার মনের সম্পূর্ণ ভূগোলজুড়ে যে পুষ্টিহীনতা তৈরি হয়, তা এক নিমেষে দূর করে দেয় তার আত্মার সঙ্গে সম্পৃক্ত পরিবারের পরিবারের সদস্যরা। সেই পরিবার হচ্ছে লেখক-পরিবার। এই পরিবারই তাকে আত্মহত্যার হাত থেকে রক্ষা করে। তার জন্য যুদ্ধের রসদ জোগায়। তার জন্য, এবং তার মতো অন্য আরো অনেকের জন্য, আয়োজন করে জীবনের উৎসবের। বুঝতে পারে, হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে পারে—সে একা নয়।