উপন্যাস পর্ব ৩
বাবা আছে বাবা নেই
কাল রাতের বৃষ্টিতেই উঠানে জল জমে গেছে। পায়ের গোড়ালি ছেড়ে কিছুটা ওপর পর্যন্ত ডুবে যাচ্ছে। শিমু কল থেকে জল আনছে। কোমরে কলসি নিয়ে ওকে বেশ সুন্দর দেখাচ্ছে।
মৌলানা শরাফত খান সকালে গরম ভাত খেয়ে মাদ্রাসায় যান। আজও সে অপেক্ষায় আছেন।
দাওয়ার কাছে গিয়ে বললাম, ভাত রান্না হয়নি।
মার ভীষণ জ্বর।
মাইয়া মানুষের ক্ষণে ক্ষণে অসুখ ভালো লাগে না। আরো কী গজগজ করে তিনি বেরিয়ে গেলেন। এটুকু বুঝলাম, রাবেয়া ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাস। কোনো উত্তর দিলাম না। মাকে তো আমি ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব।
জুতো জোড়া বগলদাবা করে ছাতা মাথায় তিনি হাঁটা ধরলেন।
ভাত রান্না করে মাকে খাওয়ালাম। শিমু আর আমিও খেলাম। শিমু স্কুলে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে। বাড়ির সামনের রাস্তাটাও ডুবে আছে। ঘাসে লুকিয়ে থাকা চিকনা জোঁক পানিতে ভাসছে। জোঁকে আমাদের কারো ভয় নেই। পা কামড়ে ধরলেই এক চিমটা দিয়ে ফেলে দিই। দু-এক ফোঁটা রক্ত যায়। তাতে কিছু আসে-যায় না। বাঙালি জোঁক না হয় দুই ফোঁটা রক্ত চুষে নিল। তার পরও তো রাজাকারের হিংস্র থাবা থেকে রক্ষা পেলাম।
শিমু কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে স্কুলে গেল। আমি মাকে নিয়ে বিজয় ডাক্তারের চেম্বারের উদ্দেশে রওনা দিয়েছি। গাছের লাঠির লম্বা ছাতাটা হাতে নিয়েছে মা। আমার আর মার স্যান্ডেল আমার হাতে। কাদায় এমনিতেই পা পিছলে যাচ্ছে। স্যান্ডেল পরা থাকলে তো আর কথা নেই। এতক্ষণে দু-চারটা আলুর দম খাওয়া হয়ে যেত। দুজনে দুজনার হাত শক্ত করে ধরে হাঁটছি। একজন পা পিছলালে যেন অন্যজন টেনে ধরতে পারে।
ডাক্তারের ঘরের কাছে এসে নলকূপে পা ধুয়ে স্যান্ডেল পরলাম। আমরা আগেই ঠিক করে নিয়েছিলাম। মা ডাক্তার দেখিয়ে ব্যবস্থাপত্র আর ওষুধ নেবে। আমি সঙ্গে থাকব না। আমাকে বিজয় ডাক্তার চিনে ফেলবে। মা বেরোলে আমি একাই ঢুকব।
যে ভাবা সে কাজ। মা ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধ নিলেন। বেরোলেন। পরক্ষণে আমি ঢুকলাম। বিজয় ডাক্তার হঠাৎ আমাকে দেখে ভ্যাবাচেকা খেলেন। উঠে দাঁড়াতে গিয়েও দাঁড়ালেন না। কপাল কুঁচকালেন।
তুমি! বিজয় ডাক্তার চোখ কপালে তুলে বললেন।
জি, আমি।
কী চাই?
রোগীরা ডাক্তারের কাছে যা চায়।
বিজয় ডাক্তার মাথা নিচু করলেন। চুপ করে থাকলেন বেশ কিছুক্ষণ।
ডাক্তার কাকা। ডাকলাম আমি।
সম্বিত ফিরে পেলেন বিজয় ডাক্তার।
হুঁ। দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
আমি রোগী হিসেবে আপনার কাছে আসিনি।
তাহলে?
মৌলানা শরাফত খানের পক্ষে ক্ষমা চাইতেও আসিনি।
তাহলে?
আমি ঘৃণা জানাতে এসেছি। ঘৃণা।
কাকে?
আমার জন্মদাতা মৌলানা শরাফত খানকে? তাকে আমি বাবা বলতে ঘৃণা বোধ করি।
রাবেয়া। বিজয় ডাক্তার অবাক হয়ে ডাকলেন।
আপনি আমার নাম মনে রেখেছেন?
হ্যাঁ। রমা তোমার কথা অনেক বলেছে। তুমি নাকি রমার খুব ভালো বন্ধু।
ডাক্তার কাকা, আপনি আমার চোখ খুলে দিয়েছেন। এত দিন আমি অন্ধ ছিলাম। আমার পিতৃপরিচয়, আমি কে, কোথায় আমার জন্ম? ওই সব নরপিশাচ রাজাকারকে আমি কোনো দিন ক্ষমা করব না। সে আমার জন্মদাতা হোক আর যা-ই হোক।
ডাক্তার কাকা চেয়ার ছেড়ে কাছে এলেন। আমার মাথায় হাত রাখলেন।
মা, তুমি অনেক বড় হবে। ডাক্তার কাকার চোখের জল আমার গায়ে পড়ল।
আমি বেরিয়ে আসতে চাইলে হাত ধরলেন ডাক্তার কাকা। বললেন, আমাদের বাড়িতে গিয়ে একবার রমার সঙ্গে দেখা করে এসো।
জি কাকা। বলেই তাঁকে প্রণাম করে বেরিয়ে এলাম। কাকা সটান দাঁড়িয়ে আছেন।
মা ওষুধের দোকানের বেঞ্চিতে বসেছিল। আমাকে আসতে দেখে উঠে দাঁড়াল। বৃষ্টি থেমেছে। ছাতা গুটিয়ে করে হাঁটছি।
মুন্সি মিঞার চা দোকান পেরোতেই পেছন থেকে কেউ একজন এসে পথ আগলে দাঁড়াল। মাকে পা ছুঁয়ে সালাম করল। উঠে দাঁড়াতেই বুঝতে পারলাম, বাকিউল। মা আর আমি কিছুটা পিছু হটে গেলাম।
কেমন আছেন খালাম্মা? বাকিউল বলল।
মা কোনো উত্তর দিল না। আমি কটমট করে তাকাচ্ছি। বাকিউল বুঝতে পেরেও না বোঝার ভান করছে।
খালাম্মা, ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলেন বুঝি? আজকাল যা দিনকাল পড়েছে না, মানুষের কত রকম যে রোগবালাই হচ্ছে। তা ওষুধ নিয়েছেন। না হয় শহরের বড় ডাক্তার দেখাতেন।
বেশ কিছু জ্ঞান দিয়ে থামল বাকিউল।
মা উশখুশ করছে। মার হাত ধরে বাকিউলের পাশ কেটে চলে এলাম।
বেশ কিছুদিন পেরিয়ে গেল। মৌলানা শরাফত খানের সঙ্গে আমার দূরত্ব ক্রমশ বাড়ছে। সারা দিন দুটো কথাও হয় না। তিনি যেটুকু বলেন, সেটুকুই জবাব পান। তিনি বুঝতে পারলেন, আমি তাঁর কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। তাই হঠাৎ করেই কাণ্ডটা ঘটালেন।
মাদ্রাসা থেকে ফেরার পথে এক প্যাকেট মিষ্টি হাতে বাড়ি ফিরলেন। মিষ্টির প্যাকেটটা মার হাতে দিয়ে বললেন, পাকা কথা দিয়ে এলাম।
পাকা কথা মানে? কিসের পাকা কথা দিয়ে এলেন?
মা যেন আকাশ থেকে পড়ল। আমি পাশের ঘরেই ছিলাম।
রাবেয়ার বিয়ের পাকা কথা?
কী বলছেন আপনি? ও তো এখন ক্লাস নাইনে পড়ে।
মা আমার জন্মদাতাকে আপনি করেই সম্বোধন করেন। কখনো তুমিতে উঠতে পারেননি। ইহজনমে পারবেন বলে মনেও হয় না।
ও কোন ক্লাসে পড়ে, সে আমার জানা আছে। মেয়ে বড় হয়েছে, বিয়ে দিব। কথা শেষ।
আমারও তো কিছু বলার আছে নাকি? আমি তো মেয়ের মা।
মেয়েমানুষের আর বলার কী আছে। তোমরা থাকো রান্নাঘর নিয়া। দুনিয়াদারির কী বোঝ?
রাবেয়া ম্যাট্রিকটা পাস দিক। তার পর বিয়ের চিন্তা করবেন। মা অনেকটা জোর গলায় কথাটা বলে থামল। আমার হাত-পা কাঁপছে। বুঝতে পারছি, এসব ওই লম্পট বাকিউলেরই কাজ।
রাবেয়ার মা আমার মুখের ওপর কোনো কথা বলো না। যাও। যা বলছি তাই করো। মেয়ের বিয়ের জন্য তৈরি হও।
ছেলেটা কে শুনি।
ভালো সম্বন্ধ সব সময় পাওয়া যায় না। ছেলে সরকারি চাকরি করে, আয়-রোজগার ভালো। মুন্সী বাড়ির ছেলে। বংশ গরিমা আছে।
মার বুঝতে বাকি রইল না, আমার জন্মদাতা মৌলানা শরাফত খান কার কথা বলছেন।
আপনি কি বাকিউলের কথা বলছেন। মা বলল।
একদম ঠিক ধরেছ। আচ্ছা রাবেয়ার মা, তুমি কী করে বুঝলা? তোমার মাথায় বুদ্ধি আছে। সে জন্য তো তোমারে আমি...। বাবার কুৎসিত গলাভাঙা হাসির শব্দ কানে আসে।
অসম্ভব। বাকিউলের সঙ্গে আমার মেয়ের বিয়ে হতে পারে না। ওই ব্যাটা আগেও নাকি এক বিয়ে করেছিল। বউ পালিয়েছে।
পুরুষ মানুষের জন্য এটা কোনো বিষয় না। ইচ্ছা করলে চারটা বিয়ে করতে পারে। বাকিউলের আয়-রোজগার ভালো। খাওয়াতে-পরাতে পারবে।
ওদের ধন-সম্পদের পাহাড় থাকলেও আমি এ বিয়েতে রাজি হবো না। মেয়ের পছন্দ-অপছন্দ দেখবেন না?
আপনার কোরআন-হাদিসে ওসব নেই?
রাবেয়ার মা, তুমি কি আমারে অপছন্দ কইরা বিয়া করছিলা?
মা চুপ করে থাকে।
চুপ কইরা আছো ক্যান? কথা কও।
মা বললেন, অতীত টাইন্যা আনলে গন্ধ বার হইব। সুতরাং ওই সব আমারে ঘাঁটাইও না।
রাবেয়ার মা। ধমকের সুরে কথা বলে মৌলানা শরাফত খান।
মা চুপ করে যায়। কান্নায় ভেঙে পড়ে বিছানায়। আমি গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরি।
দিন পেরোচ্ছে। বাড়িতে একটা গুমোট পরিবেশ বিরাজ করছে। মায়ের চেহারা মলিন। চিন্তিত। ঘুম নেই। নিয়মমতো খাওয়া নেই। মার আবার লো প্রেশার। কখন যে কী ঘটে যায়।
(চলবে)