অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করার খেলা চলছে : শামীম ওসমান
এখন যে খেলাটা চলছে তা হলো রাষ্ট্রকে অর্কাযকর করে দেওয়া, যাতে অন্য শক্তিগুলো এদেশটার ওপর ভর করে একটা অস্থিতিশীল রাষ্ট্রে পরিণত করতে পারে। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি এ দেশের তরুণেরা খুবই স্মার্ট, তারা এটাকে প্রতিহত করবে। এখনকার নতুন প্রজন্মের দায়িত্ব হচ্ছে চোখ-কান খোলা রাখা এবং তাদের প্রতিহত করা।
এনটিভি অনলাইনকে দেওয়া এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে এ মন্তব্য করেছেন নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনে আওয়ামী লীগদলীয় সংসদ সদস্য শামীম ওসমান।
শামীম ওসমান নারায়ণগঞ্জের ওসমান পরিবারে ১৯৬১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। যে পরিবারটির রয়েছে চমকপ্রদ ইতিহাস। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে বাংলাদেশের প্রাচীনতম রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার সঙ্গে রয়েছে তাদের পারিবারিক সম্পর্ক। শামীম ওসমানের দাদা খান সাহেব এম ওসমান আলী ও বাবা এ কে এম শামসুজ্জোহা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য।
ওসমানের বড় ভাই নাসিম ওসমান জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর মেজ ভাই সেলিম ওসমান বর্তমানে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য। শামীম ওসমানের বাবা ও দুই ভাই বীর মুক্তিযোদ্ধা।
রাজনৈতিক পরিবারে জন্ম নেওয়া শামীম ওসমান ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতিতে জড়িয়েছেন। তিনি ১৯৮১ সালে সরকারি তোলারাম কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি নির্বাচিত হন। তিনি তোলারাম কলেজ থেকে আইন বিভাগে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৯৬, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে তিনি নারায়ণগঞ্জ-৪ আসন থেকে সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন।
সরকারি তোলারাম কলেজে লেখাপড়ার সময় মহিলা কলেজে অধ্যয়নরত সালমা ওসমান লিপির সঙ্গে শামীম ওসমানের পরিচয় ও প্রেমের সম্পর্ক তৈরি হয়। পরবর্তীতে ১১ জুলাই ১৯৮৭ সালে সালমা ওসমান লিপির সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি। তাঁদের ছেলে অয়ন ওসমান ও মেয়ে অঙ্গনা ওসমান।
জাতির পিতার জন্মশতবর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে এনটিভি অনলাইন বিশেষ সাক্ষাৎকার প্রচারের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এ বিশেষ সাক্ষাৎকারের সপ্তম পর্বে কথা বলেছেন নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য শামীম ওসমান। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন এনটিভি অনলাইনের স্টাফ করেসপনডেন্ট ফখরুল শাহীন।
এনটিভি অনলাইন : স্বাধীনতার ৫০ বছরে এ দেশটা কতটুকু এগিয়েছে বলে আপনি মনে করেন?
শামীম ওসমান : দেশকে এগিয়ে নিতে সবচেয়ে যেটি বেশি দরকার তা হলো সঠিক নেত্বত্ব। আমাদের স্বাধীনতার এ ৫০ বছরে সবচেয়ে বেশি অপ্রাপ্তি হলো— যিনি দেশটাকে স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন আমরা তাকেই হত্যা করেছি; তিনি হলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আল্লাহর হুকুম এবং অলৌকিকভাবে জাতির পিতার দুই সন্তান বেঁচে যান। তন্মধ্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শত শত বাধা অতিক্রম করে করে এবং অনেকবার হত্যা চেষ্টার পর তিনি প্রাণে বেঁচে যান। মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ লোক প্রাণ হারানোর পর হাজার হাজার মা-বোনের সম্ভ্রম নষ্টের পর এদেশকে নেত্বত্ব দেওয়া সহজ বিষয় নয়। আমি নিজেও অবাক হই, এত ছোট একটি দেশে এত বেশি মানুষকে পরিচালনা করা এবং সাহসের সঙ্গে দেশ উন্নয়নে সফলতা দেখাচ্ছেন এবং তিনি বাস্তবায়ন করে চলেছেন।
এটার একটা কারণ আমি খুঁজে পেয়েছি তা আমি আজ আপনাদের তরুণ প্রজন্মকে জানাব। ২০০১ সালে নারায়ণগঞ্জে একটি জনসমাবেশ ছিল। জনসমাবেশ শেষ, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী চলে যাবেন, এ সময় আমাকে ডেকে বললেন, ‘তুমি আমার সাথে যাবে? আমি চান্দিনা যাব, ওখানে সমাবেশ চলছে। আমি বড্ড ক্লান্ত, এখনো কিছু খাওয়ার সময়ও পাইনি। তুমি আমার সাথে চলো।’ আমি বললাম, আমি খুবই ক্লান্ত। তখন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বললেন, ‘কিছু হবে না চলো। ওখানে তুমি বক্তব্য দেওয়ার সময় আমি রেস্ট নিব।’ তিনি হেলিকপ্টারে উঠবেন, এমন সময় কিছু গরিব বৃদ্ধ মহিলা এসে দেখা করার চেষ্টা করছেন। এ সময় সিকিউরিটির লোকজন বাধা দিচ্ছিল। কিন্তু তিনি গরিব মহিলাদের কাছে হেঁটে গেলেন। সবাই তাঁকে জড়িয়ে ধরে বুকে নিয়ে আদর করলেন। এরপর কিছু ছোট বাচ্চারা এলো। তারা হাসিনা হাসিনা স্লোগান দিচ্ছিল। এ সময় তিনি আবার ওই ছোট বাচ্চাদের কাছে গিয়ে তাদের আদর করলেন। হেলিকপ্টারে ওপর পর দেখলাম তিনি কাঁদছেন। জিজ্ঞাসা করলাম, আপা আপনি কাঁদছেন কেন? জবাবে তিনি বললেন, ‘শামীম এসব গরিব মানুষগুলো যখন আমাকে জড়িয়ে ধরে তখন আমার মনে হয়, আমার মা কবর থেকে উঠে এসে আমাকে আদর করছেন। এরা যখন আমাকে জড়িয়ে আদর করে, তখন আমার মনে হয় আমার বাবা আমাকে বলছে, এদের জন্য কিছু করো। ছোট্ট বাচ্চারা যখন হাসিনা হাসিনা নামে আমাকে ডাকে, তখন আমার মনে হলো আমার ছোট্ট ভাই শেখ রাসেল আমাকে ডেকে বলছে, হাসু আপা আমাকে কোলে নিয়ে একটু আদর করো না।’
আমি তখন চিন্তা করেছি যদি শেখ হাসিনাকে আল্লাহ হায়াত দান করেন তাহলে তিনি দেশের কল্যাণে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। এবং তিনি করেও যাচ্ছেন। সারা পৃথিবী যখন অর্থনীতিতে বিপর্যস্ত, তখন তিনি একের পর এক স্বপ্ন বাস্তবায়ন করে চলেছেন। কত রকমের ষড়যন্ত্রকে তিনি মোকাবিলা করছেন। তাই স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতে আমি আল্লাহর কাছে দোয়া করি।
৭৫-এ যখন বঙ্গবন্ধুকে মারা হলো, তখন আমরা ছোট, সপ্তম-অষ্টম শ্রেণিতে পড়ি। আমাদের শৈশব-কৈশোর সব ধ্বংস করে দেওয়া হয়। তখনই রাজনীতিতে আসি। প্যালেস্টাইনের জীবন যেভাবে বড় হয়, আমরা সেভাবে বড় হয়েছি। কথায় কথায় আঘাত, বুলেট, বোমা, হত্যাচেষ্টা। আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা জানাই যে আজকে সারা বিশ্বের সামনে আমরা মাথা উঁচু করে কথা বলতে পারছি। বলতে পারছি যে, বাংলাদেশ আজ কারো পায়ের ওপর ভর দিয়ে দাঁড়ায় না, বাংলাদেশ নিজের পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়ায়।
যে ষড়যন্ত্র চারদিকে চলছে, ওনাকে যদি হারাতে হয়, বাংলাদেশ এমনভাবে মুখ থুবরে পড়বে যে বাংলাদেশের সঙ্গে তখন তুলনা হবে সিরিয়া, আফগানিস্তান, ইরাকের মতো দেশের।
এজন্য বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহেনার জন্য আমি সবার কাছে আজ দোয়া ভিক্ষা চাচ্ছি। ওনারা ওনাদের জন্য কিছু করছেন না, করছেন দেশের জন্য। দেশের মানুষের জন্য, ওনার বাবার স্বপ্ন পূরণের জন্য।
এনটিভি অনলাইন : আমরা যখন স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী, মুজিববর্ষ পালন করছি, তখন দেখছি সাম্প্রদায়িক শক্তি মাথাচারা দিয়ে উঠছে। আপনি বিষয়টাকে কিভাবে দেখছেন?
শামীম ওসমান : এটা বাংলাদেশের ইতিহাসে সব সময় ছিল। পাকিস্তান আমলে আব্বার কাছে শুনেছি, যখন কোনো ষড়যন্ত্র হতো, তখন বিহারি বাঙালিরা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার চেষ্টা করতো। এরা তো এখনো রয়ে গেছে। আমরা একাত্তরেও কিন্তু শতভাগ ভোট পাইনি। ২১ শতাংশ ভোট বিপক্ষে গিয়েছিল। তাদের উত্তরসূরিরা কিন্তু এখনো আছে। সে সব শক্তি, যারা ধর্মের লেবাস পরে ধর্মের কথা বলে আজ তারা এগুলো করে। মনে হবে, এরাই সব কিছু করে, তবে এরা কিন্তু সব কিছু করে না। পেছন থেকে কেউ কলকাঠি নাড়ছে। ভৌগোলিক কারণে আমরা এমন অবস্থানে রয়েছি যে, আমদের পার্শ্ববর্তী যারা শক্তিধর দেশ আছে তারা পৃথিবীর সুপ্রিম পাওয়ার হতে চায়। পৃথিবীর কোনো কোনো রাষ্ট্র হয়তো চেষ্টা করতে পারে বাংলাদেশকে এমন একটা জায়গায় নিয়ে যেতে চায়, যাতে তালেবান রাষ্ট্রের বা হরকাতুল জিহাদের মতো প্রডাক্ট তৈরি করা যায়।
এ দেশে হাজার বছরে একজন বঙ্গবন্ধু আসে, নবাব সিরাজউদ্দৌলা আসে, কিন্তু এ দেশে বছরে বছরে মীর জাফর আর খন্দকার মোশতাক তৈরি হয়। মীর জাফর আর খন্দকার মোশতাকের বংশধররা, যারা বিদেশের টাকায় লালিত-পালিত হয়, তারা নিজের স্বার্থে দেশটাকে এমন অবস্থায় নিতে চায়, যে দেশটা একটা অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত হবে। এ বিষয়টা মোকাবিলার দায়িত্ব দেশের যুবকদের। এ দেশের যুবকেরা বঙ্গবন্ধুর ডাকে যেমন করে দেশটা স্বাধীন করেছিল, আমরা যেমন বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিশোধের দাবিতে যারা আন্দোলন করেছিলাম, আমার আব্বা-ভাইয়েরা যুদ্ধ করে এ দেশটাকে স্বাধীন করেছেন। এখনকার নতুন প্রজন্মের দায়িত্ব হচ্ছে চোখ-কান খোলা রাখা এবং তাদের প্রতিহত করা। কারণ তারা সরকারের পরিবর্তন চায় না। যে খেলাটা এখন চলছে তা হলো রাষ্ট্রকে অর্কাযকর করে দেওয়া। যাতে অন্য শক্তিগুলো এদেশটার ওপর ভর করে একটা অস্থিতিশীল রাষ্ট্রে পরিণত করতে পারে, যাতে এদেশের শিল্প-বাণিজ্য ধ্বংস হয়। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি এ দেশের তরুণেরা খুবই স্মার্ট, তারা এটাকে প্রতিহত করবে।