একদিন প্রমাণ হবে আমি নির্দোষ : সাবরীনা
নভেল করোনাভাইরাসের নমুনা পরীক্ষার ভুয়া রিপোর্ট দেওয়া জেকেজি হেলথ কেয়ারের চেয়ারম্যান ডা. সাবরীনা আরিফ ও সিইও আরিফুলসহ আটজনের ১১ বছর করে কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। তিনটি ধারায় তাদের প্রত্যেককে মোট ১১ বছর করে কারাভোগ করতে হবে।
ঢাকার অতিরিক্ত মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট তোফাজ্জল হোসেন আজ মঙ্গলবার এ রায় দেন। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মকবুল হোসেন এনটিভি অনলাইনকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
রায় শেষে সাবরীনাকে আদালত থেকে হাজতখানায় নেওয়ার সময় তাঁর এক আইনজীবী বলেন, বের হয়ে যাবেন ইনশাআল্লাহ। সে সময় সাবরীনা আইনজীবীর উদ্দেশ্যে বলেন, ‘আমি তো সেদিনই মরে গেছি। যেদিন আমাকে এখানে ঢোকানো হয়েছে। আমি বের হবো কি না সেটা বড় কথা না। বড় কথা হলো দেশবাসী জানলো আমি অপরাধী।’
এরপরে সাবরীনা বলেন, ‘একদিন প্রমাণ হবে সাবরিনা নির্দোষ। আমি নির্দোষ কিন্তু দেশবাসী জানলো আমি অপরাধী। শুধু বলব, আল্লাহ একদিন এর বিচার করবেন।’
এদিকে আজ সকাল সাড়ে ৮টায় সাবরীনা, আরিফসহ আট আসামিকে আদালতে হাজির করা হয়। এরপরে বেলা ১২টা ২০ মিনিটে ঢাকার অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট তোফাজ্জল হোসেনের আদালতে সাবরীনাসহ আট আসামিকে হাজির করা হয়। সাবরীনার পরনে ছিলো গোলাপি রংয়ের শাড়ি ও মাস্ক। তাঁকে নারী পুলিশ আদালতের কাঠগড়ায় রাখেন। এসময় তাঁর আইনজীবীরা তাঁর সাথে কথা বলার জন্য ঘিরে ধরেন। এরপরে সাবরীনাকে পুলিশ ঘিরে রাখলে আইনজীবীরা চলে যায়। এরপরে সাবরীনা ক্লান্ত হয়ে কাঠগড়ায় বসে পড়েন। এরপরে বিচারক ১২টা ২৫ মিনিটে রায় ঘোষণা শুরু করলে সাবরীনা দাঁড়িয়ে মামলার রায় শোনেন।
বিচারক মামলার রায় পড়ার প্রথমে বলেন, ‘এ মামলায় সাতটি ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে। এর মধ্যে তিনটি ধারায় আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। এর মধ্যে দণ্ডবিধির ৪২০/৪৭১/ ও ৪৬৬ ধারায়। এর মধ্যে ৪২০ ধারায় সাবরীনাসহ আট আসামিকে তিন বছরের কারাদণ্ড এবং ৩ হাজার টাকা জরিমানা ও জরিমানা দিতে ব্যর্থ হলে আরও তিন মাসের কারাদণ্ড ভোগের নির্দেশ দেন। এরপরে বিচারক দণ্ডবিধির ৪৭১ ও ৪৬৬ ধারার পৃথক দুই ধারায় চার বছরের কারাদণ্ড এবং চার হাজার টাকা জরিমানা ও তা দিতে ব্যর্থ হলে আরও চার মাসের কারাদণ্ড দেন। এরপরে বিচারক বলেন, একটি সাজা শেষে আরেকটি সাজা চলবে।’
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মকবুল হোসেন এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘সাবরীনাসহ আট আসামিকে মোট ১১ বছরের জেল খাটতে হবে। একটি সাজা শেষে আরেকটি কার্যকরের কথা বলেছেন বিচারক। তবে তাঁদের বর্তমান হাজতবাস থেকে কারাদণ্ড বাদ যাবে বলে বিচারক রায়ে বলেছেন।’
মকবুল হোসেন বলেন, ‘বিচারক রায়ের সময় বলেছেন, ডা. সাবরিনা-আরিফসহ অন্য আসামিরা করোনা পরীক্ষার ভুয়া রিপোর্ট দিয়েছে। রাষ্ট্র যখন নাগরিকের করোনা পরীক্ষা বিনামূল্যে করার দায়িত্ব নেয়। তখন তারা করোনার ভুয়া পরীক্ষা করে মানুষের জীবন নিয়ে খেলেছে। তারা মানুষদের করোনার ভুয়া সার্টিফিকেট দিতো। এজন্য তাদের সাজা দেওয়া হলো।
গত ২৯ জুন যুক্তিতর্ক শুনানি শেষে ঢাকার অতিরিক্ত মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট তোফাজ্জল হোসেন এ রায়ের দিন ধার্য করেন।
এর আগে গত ১১ মে ঢাকার অতিরিক্ত মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট তোফাজ্জল হোসেনের আদালতে আত্মপক্ষ সমর্থনে তাঁরা নিজেদের নির্দোষ দাবি করে ন্যায়বিচার প্রত্যাশা করেন। ২০২০ সালের ২০ আগস্ট আলোচিত এ মামলাটির অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে বিচার শুরুর নির্দেশ দেন আদালত।
এর আগে ওই বছরের ১৩ আগস্ট ডা. সাবরীনা, আরিফ চৌধুরীসহ আট জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের শুনানির জন্য দিন নির্ধারণ করেন আদালত। ওই দিন আসামিপক্ষ সময়ের আবেদন করায় বিচারক সময়ের আবেদন মঞ্জুর করে নতুন দিন নির্ধারণ করেন।
২০২০ সালের ৫ আগস্ট মামলার তদন্ত সংস্থা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের পরিদর্শক লিয়াকত আলী ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ডা. সাবরীনা, সিইও আরিফুল হক চৌধুরীসহ আট জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। মামলার অপর ছয় আসামি হলেন—শফিকুল ইসলাম রোমিও, জেবুন্নেসা, আবু সাঈদ চৌধুরী, হুমায়ুন কবির হিমু, তানজিলা পাটোয়ারী ও বিপ্লব দাস।
অভিযোগপত্রে ডা. সাবরীনা ও আরিফুল হক চৌধুরীকে এ অসাধুচক্রের মূলহোতা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বাকিরা প্রতারণা ও জালিয়াতি করতে তাঁদের সহযোগিতা করেন বলে বলা হয়েছে।
অভিযোগপত্রে যা বলা আছে
তদন্ত কর্মকর্তা অভিযোগপত্রে বলেন, মামলার এজাহারনামীয় গ্রেপ্তার ৯ নং আসামি ও এদের মধ্যে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেওয়া তিন আসামির জবানবন্দির কপিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ডকুমেন্টারি দালিলিক কাগজপত্র পর্যালোচনায় জানা যায়, জেকেজি হেলথ কেয়ার একটি নাম সর্বস্ব প্রতিষ্ঠান। যার আছে শুধু সিটি করপোরেশন কর্তৃক ২০২০ সালের ১৬ জুন প্রাপ্ত ট্রেড লাইসেন্স। অথচ জেকেজি হেলথ কেয়ার প্রতিষ্ঠানটি তার দুই মাস আগে অর্থাৎ ১৬ এপ্রিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে অনুমতি পেয়ে ঢাকাসহ নারায়ণগঞ্জ এলাকায় ৮টি বুথ স্থাপন করে করোনা উপসর্গ রোগীদের স্যাম্পল কালেকশন শুরু করে, যা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক ডিজি আবুল কালাম আজাদের চরম দায়িত্বহীনতার পরিচয় প্রকাশ পায়।
অভিযোগপত্রে বলেন, ‘বিষয়টি সরেজমিনে তদন্তের জন্য মহাখালী স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডিজি গিয়ে এডিজির (প্রশাসন) সঙ্গে আলোচনা ও জিজ্ঞাসাবাদে তিনি জানান, জেকেজি হেলথ কেয়ার সংক্রান্ত সব ধরনের কাগজপত্র সাবেক ডিজি আবুল কালাম আজাদের নির্দেশে তিনি স্বাক্ষর করেছেন।’
বিষয়টি তদন্তকালে জানা যায়, সাবেক ডিজি আবুল কালাম আজাদ অবৈধ ও বেআইনিভাবে নাম সর্বস্ব প্রতিষ্ঠান জেকেজিকে করোনার মতো একটি স্পর্শকাতর বিষয়ে স্যাম্পল কালেকশনের কাজটি প্রদান করেন। তদন্তকালে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এডিজির লিখিত বক্তব্য অনুযায়ী জেকেজি হেলথ কেয়ার কোনোভাবে স্যাম্পল কালেকশন বাবদ টাকা গ্রহণ এবং স্যাম্পল দাতাদের রিপোর্ট ও সার্টিফিকেট প্রদান করতে পারবে না বলে শর্ত থাকলেও জেকেজি হেলথ কেয়ার অবৈধ পন্থায় স্যাম্পল গ্রহণ ও টাকা সংগ্রহ করেছে বিধায় আসামিদের প্রতারণার বিষয়টি স্পষ্ট হয়।
আরও বলেন, ‘স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী কোনো স্যাম্পল পরীক্ষার অনুমতি না থাকলেও জেকেজি হেলথ কেয়ার ‘আইদেশি’র মাধ্যমে স্যাম্পল পরীক্ষা করে সরকারি নির্দেশনা অমান্য করে প্রতারণার মাধ্যমে প্রাপ্ত অর্থ আত্মসাৎ করেছে। এছাড়া ‘আইদেশি’র কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে জানতে পারি, জেকেজি হেলথকেয়ার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আদেশের ব্যত্যয় ঘটিয়ে নির্দিষ্ট বুথের বাইরে গিয়ে প্রতারণার উদ্দেশে স্যাম্পল সংগ্রহ করেছে।’
অভিযোগপত্রে বলা হয়, রোগীদের স্বীকারোক্তি এবং ওভালগ্রুপের আরিফুল চৌধুরী ও ডা. সাবরিনা শারমিন হোসাইনদের ব্যাংক স্টেটমেন্ট পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০২০ সালের মে থেকে জুন মাসে তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে পর্যাপ্ত পরিমাণ টাকা লেনদেন হয়েছে। এতে স্পষ্ট হয়, করোনাকালীন তারা টাকার বিনিময়ে করোনা স্যাম্পল সংগ্রহ করে তা পরীক্ষা না করে সরকারি লোগো ব্যবহার করে জাল সার্টিফিকেট প্রদান করে প্রতারণার মাধ্যমে টাকা আত্মসাৎ করেছে। বিষয়টি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক ডিজি আবুল কালাম আজাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলেও তিনি প্রয়োজনীয় কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। এছাড়া, তদন্তকালে প্রাথমিকভাবে প্রমাণ পাওয়া যায়, সাবেক ডিজি আবুল কালাম আজাদ অবৈধ সুবিধা প্রাপ্তির শর্তে জেকেজিকে কাজ পাওয়া থেকে শুরু করে প্রতিটি বিষয়ে অবৈধ সুবিধা দিয়ে আসছিলেন।
২০২০ সালের ২৩ জুন সাবরীনার স্বামী আরিফুল হক চৌধুরীসহ ছয়জনকে গ্রেপ্তার করে তেজগাঁও থানা পুলিশ। এ ছাড়া ২০২০ সালের ১২ জুলাই দুপুরে ডা. সাবরীনাকে ঢাকা মহানগর পুলিশের তেজগাঁও বিভাগীয় উপকমিশনারের (ডিসি) কার্যালয়ে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তাঁকে করোনার ভুয়া রিপোর্ট দেওয়ার অভিযোগে তেজগাঁও থানায় করা মামলায় গ্রেপ্তার দেখায় পুলিশ।