করোনা সংকট মোকাবেলায় দশ দফা সুপারিশ টিআইবির
সরকার কর্তৃক বেশ কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ সত্ত্বেও করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ, আক্রান্ত ব্যক্তির চিকিৎসা ও টিকা কার্যক্রম এবং করোনার প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে গৃহীত প্রণোদনা কার্যক্রমে এখনও নানাবিধ অনিয়ম-দুর্নীতিসহ সুশাসনের বিশেষত অন্তর্ভুক্তি ও স্বচ্ছতার চ্যালেঞ্জ অব্যাহত রয়েছে। বিশেষ করে, সংকট মোকাবিলায় সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা গ্রহণ, সম্পদের যথাযথ ব্যবহার, পরিস্থিতি অনুযায়ী দ্রুত সাড়া প্রদান এবং সেবা সম্প্রসারণ করা হয়নি, যা ভবিষ্যৎ নতুন কোনো ঢেউয়ের প্রেক্ষিতে অত্যন্ত উদ্বেগজনক।
‘করোনাভাইরাস সংকট মোকাবিলায় সুশাসন : অন্তর্ভুক্তি ও স্বচ্ছতার চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে আজ এই মন্তব্য করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, উপদেষ্টা-নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের, গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল হাসান। টিআইবির গবেষণা ও পলিসি বিভাগের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো শাহজাদা এম আকরামের তত্ত্বাবধানে প্রণীত গবেষণাটি উপস্থাপন করেন একই বিভাগের রিসার্চ ফেলো মো. জুলকারনাইন ও রিসার্চ এসোসিয়েট কাওসার আহমেদ। গবেষক দলের অপর সদস্য হলেন একই বিভাগের রিসার্চ এসোসিয়েট রাবেয়া আক্তার কনিকা। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন টিআইবির আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের সমন্বয়ক মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম।
গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, কোভিড-১৯ মোকাবিলায় সরকারের বেশকিছু ইতিবাচক পদক্ষেপের মধ্যে অন্যতম হলো- ভারত সরকারের নিষেধাজ্ঞায় সেরাম ইন্সটিটিউটের একক উৎস থেকে টিকা রপ্তানি বন্ধ হওয়ার পর সরকারের প্রচেষ্টায় দ্বিপাক্ষিক চুক্তির মাধ্যমে চীন থেকে টিকা ক্রয়, কোভ্যাক্স উদ্যোগ থেকে কস্ট শেয়ারিং বা বিনা মূল্যে টিকা সংগ্রহ এবং বিভিন্ন দেশ থেকে প্রাপ্ত অনুদান দিয়ে জুলাই ২০২১ থেকে গণটিকা কার্যক্রম শুরু করা।
এ সময় সরকারের তৎপরতায় ৩১ মার্চ ২০২২ পর্যন্ত প্রায় ২৯.৬৪ কোটি ডোজ টিকা সংগ্রহ করা হয়। সংগৃহীত টিকা থেকে ৩১ মার্চ ২০২২ পর্যন্ত প্রায় ১২.৭৭ কোটি মানুষকে প্রথম ডোজ (মোট জনসংখ্যার ৭৪.৯৬ শতাংশ) এবং ১১.২৪ কোটি মানুষকে দ্বিতীয় ডোজ (৬৬.০ শতাংশ) টিকা প্রদান করা হয়েছে। এছাড়া, প্রায় ৯৫ লাখ মানুষকে বুস্টার ডোজ প্রদান করা হয়। বিভিন্ন পেশা-জনগোষ্ঠীর মানুষকে টিকার আওতায় আনতে সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ, কমিউনিটি ক্লিনিক ইত্যাদি থেকে টিকা কার্যক্রম পরিচালনা করা হয় এবং ১২ থেকে ১৭ বছর বয়সী স্কুলশিক্ষার্থী, কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থী, বস্তিবাসী ও ভাসমান জনগোষ্ঠীকে টিকার আওতায় আনতে বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়।
তবে গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য বলছে, কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ সত্ত্বেও কোভিড-১৯ মোকাবিলা কার্যক্রমে এখনও সুশাসনের বহুবিধ চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান, যা এই কার্যক্রমের কাঙ্ক্ষিত ফলাফল বিশেষত দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর জন্য কাঙ্ক্ষিত ফলাফল অর্জনকে বাধাগ্রস্ত করছে। টিকাসহ চিকিৎসা ব্যবস্থা ও প্রণোদনা কার্যক্রম সকলের জন্য সমান প্রবেশগম্যতা ও অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত না করায়, সেবাপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে এলাকা, শ্রেণি, লিঙ্গ ও জনগোষ্ঠীভেদে বৈষম্য রয়ে গেছে। যা দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে সেবা থেকে বঞ্চিত করছে এবং হয়রানি ও আর্থিক বোঝা তৈরি করেছে। প্রণোদনা কর্মসূচি বাস্তবায়নেও সুশাসনের চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান থাকায় অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের কাছে প্রণোদনার সুফল প্রত্যাশিতভাবে পৌঁছায়নি। এ ছাড়া, স্বচ্ছতার ঘাটতি একদিকে অনিয়ম-দুর্নীতির ঝুঁকি তৈরি করেছে ও অন্যদিকে সংঘটিত দুর্নীতিকে আড়াল করার সুযোগ তৈরি হয়েছে। সেবা কার্যক্রমে অভিযোগ নিরসন ব্যবস্থা না থাকায় সমস্যা নিরসনে বা অনিয়ম-দুর্নীতির সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছে না।
গবেষণার ফল অনুযায়ী, কোভিড-১৯ সংক্রমণের দুই বছর অতিক্রান্ত হলেও প্রয়োজনের চেয়ে পরীক্ষাগার স্বল্পতা, সক্ষমতার অধিক সেবাগ্রহীতা ও দুর্বল ব্যবস্থাপনার কারণে নমুনা পরীক্ষায় বিভিন্ন সমস্যা বিদ্যমান।
জরিপের তথ্য অনুযায়ী, ২৬.১ শতাংশ সেবাগ্রহীতা কোভিড-১৯ নমুনা পরীক্ষা করাতে গিয়ে বহুমুখী সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন এবং ১৫ শতাংশ সেবাগ্রহীতা অনিয়ম-দুর্নীতির শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে, নমুনা প্রদানের সময় পরীক্ষাগারগুলোতে স্বাস্থ্যবিধি না মানা, নমুনা দিতে গিয়ে দীর্ঘ সময় অপেক্ষার পর ফিরে আসা, পরীক্ষাগারে কর্মীদের দুর্ব্যবহার, বাসা থেকে নমুনা দিতে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা, নমুনা দিতে একাধিকবার কেন্দ্রে যাওয়া, ভুল প্রতিবেদন দেওয়ার কারণে পুনরায় পরীক্ষা করতে বাধ্য হওয়া ইত্যাদি অভিযোগের কথা জানা গেছে। নমুনা পরীক্ষার পর রিপোর্ট পেতে গড়ে ২.৫ দিন (সর্বোচ্চ ৯ দিন) এবং পরীক্ষাগারে নমুনা দিতে গিয়ে গড়ে ৩ ঘণ্টা (সর্বোচ্চ ১০ ঘণ্টা) অপেক্ষা করতে হয়েছে। এ ছাড়া পরীক্ষাগারের স্বল্পতা, অতিরিক্ত ভিড়, নমুনা প্রদানে জটিলতা, অতিরিক্ত খরচ ইত্যাদি কারণে নমুনা পরীক্ষার ক্ষেত্রে জনগণকে বিশেষত দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষকে নিরুৎসাহিত করেছে।