দুর্যোগ মোকাবিলায় দেশের সক্ষমতা নিয়ে আত্মতুষ্টির সময় আসেনি : টিআইবি
প্রাণহানি কমানো, দুর্যোগ মোকাবিলার কাঠামোবদ্ধ মডেল প্রস্তুত ও বিভিন্ন দেশের তা অনুসরণসহ বাংলাদেশ দুর্যোগ মোকাবিলায় যথেষ্ট সুনাম অর্জন করলেও এ ক্ষেত্রে যথেষ্ট উৎকর্ষ সাধনের সুযোগ আছে এবং এখনও আত্মতুষ্টির সুযোগ আসেনি বলে জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
সংস্থাটির মতে, ক্রমবর্ধমান প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং তা মোকাবিলায় বিদ্যমান সুশাসনের ঘাটতির কারণে এখনও বছরে জাতীয় আয়ের প্রায় দুই দশমিক দুই শতাংশ ক্ষতি হয়।
আজ বৃহস্পতিবার ‘দুর্যোগ মোকাবিলায় সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায় : ঘূর্ণিঝড় আম্ফানসহ সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা জানায় সংস্থাটি। সেইসঙ্গে দুর্যোগ মোকাবিলায় সুশাসনের চ্যালেঞ্জ থেকে উত্তরণে ১২ দফা সুপারিশ প্রদান করে।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ঘূর্ণিঝড় আম্ফানসহ সাম্প্রতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় সুশাসনের অগ্রগতি ও চ্যালেঞ্জগুলো পর্যালোচনা করার উদ্দেশ্যে চলতি বছরের ১৮ মে থেকে ২৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়কালে এ গবেষণার তথ্য সংগ্রহ, বিশ্লেষণ ও প্রতিবেদন প্রণয়নের কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। যার সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য হলো সাম্প্রতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় সুশাসনের অগ্রগতি ও চ্যালেঞ্জগুলো পর্যালোচনা এবং গবেষণায় প্রাপ্ত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সুপারিশ প্রদান করা।
গবেষণার ফলাফল বিশ্লেষণ করে টিআইবি জানায়, পূর্বে সংঘটিত দুর্যোগসহ সর্বশেষ ঘূর্ণিঝড় আম্ফান মোকাবিলায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। স্বচ্ছতার ক্ষেত্রে দেখা যায়, কোনো কোনো দুর্গম এলাকায় দুর্যোগের পূর্বাভাস সংক্রান্ত তথ্য প্রকাশ ও সতর্কতামূলক বার্তা প্রচারসহ আক্রান্ত জনগোষ্ঠীর মধ্যে হট লাইনের নম্বর প্রচার করা হয়নি; স্থানীয়ভাবে ত্রাণ ও সুবিধাভোগীর তালিকা এবং মন্ত্রণালয়ের সুনির্দিষ্ট কর্মকর্তাদের বিভাগ ও জেলাভিত্তিক তদারকি প্রতিবেদন করার দায়িত্ব থাকলেও এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনও প্রকাশ করা হয়নি।
এ ছাড়া, রাজনৈতিক বিবেচনায় তহবিল বরাদ্দের কারণে সর্বোচ্চ ক্ষতিগ্রস্ত জেলাগুলোতে কম বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে উল্লেখ করে টিআইবি জানায়, নিয়মিত মেরামতের ঘাটতির করণে বাঁধের মোট ৮৪টি পয়েন্ট ভাঙাসহ ২৩৩ কিলোমিটার বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যা মেরামতে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। ফলে জোয়ারের পানি প্রবেশ করে দুর্গত এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। এমনকি আম্ফান আঘাত হানার ছয় মাস পরেও সাতক্ষীরার আশাশুনিতে বাঁধ সংস্কার না করায় ঘরবাড়ি পানির নিচে তলিয়ে প্রায় ২০ হাজার মানুষ গৃহহীন ছিল।
জমির দীর্ঘ মেয়াদি ক্ষয়-ক্ষতি বিবেচনায় না নেওয়ায় শুধু উপকূলীয় জেলাগুলোতে ঘূর্ণিঝড় আম্ফান পরবর্তী প্রথম বছরান্তে কৃষিতে প্রাক্কলিত ক্ষতির পরিমাণ হবে প্রায় দুই হাজার ৩৫ কোটি টাকা এবং আগামী দুই থেকে তিন বছর প্রায় ৬১ হাজার ৬০২ হেক্টর জমি ব্যবহার অনুপযোগী থাকার ঝুঁকিতে রয়েছে বলেও জানায় সংস্থাটি।
সক্ষমতার ক্ষেত্রে প্রচার পদ্ধতি আধুনিকায়নসহ সতর্ক বার্তা সাধারণ জনগণের জন্য বোধগম্যভাবে প্রচার করতে না পারা, চাহিদা অনুযায়ী আশ্রয়কেন্দ্রের নির্মাণ ও প্রস্তুতে ঘাটতি, স্থানীয় পর্যায়ে ত্রাণের চাহিদাসহ পর্যাপ্ত ত্রাণ মজুদে ঘটতি ছিল বলে উঠে এসেছে টিআইবির গবেষণায়।
স্থানীয় জনপ্রশাসন, জনপ্রতিনিধি এবং আন্তপ্রাতিষ্ঠানিক সমন্বয়ের ঘাটতির কারণে দুর্গম এলাকায় যথাসময়ে ত্রাণ না পৌঁছানো, একই সুবিধাভোগীর একাধিকবার ত্রাণ পাওয়াসহ বিবিধ অনিয়ম ও দুর্নীতির চিত্র গবেষণায় উঠে এসেছে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি।
ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘দুর্যোগ মোকাবিলায় বাংলাদেশ সুনাম অর্জন করেছে এবং অনেক ক্ষেত্রে কোনো কোনো দেশ আমাদের মডেল অনুসরণও করছে। কিন্তু ব্যাপক অগ্রগতি স্বত্ত্বেও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক অঙ্গীকার, জাতীয় আইন, নীতিমালা এবং আদেশাবলী প্রতিপালনে এখনও উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ঘাটতি রয়ে গেছে।’
‘পাশাপাশ বিদ্যমান গবেষণায় সুশাসনের প্রতিটি নির্দেশকেই ব্যাপক ঘাটতি দেখা গেছে। যেহেতু বাংলাদেশ দুর্যোগ মোকাবিলায় ভালো করেছে এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে যথেষ্ট প্রস্তুতি ও সক্ষমতাও আছে, তাই বিদ্যমান ঘাটতি ও চ্যালেঞ্জগুলো এড়িয়ে দুর্যোগ মোকাবিলায় আরও ভালো করা সম্ভব,’ বলেন তিনি।
বাংলাদেশ দুর্যোগ মোকাবিলায় অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ায় এক ধরনের আত্মতুষ্টি আছে মন্তব্য করে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘এ আত্মতুষ্টির কারণে দুর্যোগ মোকাবিলায় দীর্ঘকালীন যে চ্যালেঞ্জগুলো এখনও বিদ্যমান সেগুলো অবহেলা করা হয় এবং চ্যালেঞ্জগুলো নিরসন করে আরো অগ্রগতির প্রয়াসে ঘাটতি দেখা যায়। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় উৎকর্ষ সাধন করা গেলে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে জাতীয় আয়ের গড়ে ২.২ শতাংশ বার্ষিক যে ক্ষতি হয় তা কমিয়ে আনা সম্ভব।’