বঙ্গবন্ধু ভালোবাসতেন খেলাধুলা-সংস্কৃতি
ছোটবেলা থেকেই দুরন্ত ছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দারুণ ফুটবল খেলতেন। ভালোবাসতেন গান, কবিতা, চলচ্চিত্র। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে ভারত থেকে এনে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের কবিতাও তাঁর অনেক ভালো লাগত।
বঙ্গবন্ধু ছিলেন তরুণদের আইকন। তরুণরা তাঁর মতো হতে চাইতেন। তরুণদের মতোই বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতির কল্যাণে সদা তৎপর ছিলেন। বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিচর্চায় যাঁরা আইকনিক তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন বঙ্গবন্ধু। সুকোমল বৃত্তির জন্য তাঁর ভালোবাসা ছিল। সংস্কৃতিমনা রাষ্ট্র গড়তে চেয়েছিলন তিনি। জাতির আত্মার চিৎকার শুনে তিনি তা নিরসনে উদ্যোগ নিয়েছেন।
বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থের প্রথমদিকে বলা হয়েছে, ‘ছোট সময়ে আমি খুব দুষ্টু প্রকৃতির ছিলাম। খেলাধুলা করতাম, গান গাইতাম...। সেবা সমিতির কাজ করতাম।... ফুটবল, ভলিবল খেলতাম। খুব ভালো খেলোয়াড় ছিলাম না। তবুও স্কুলের টিমের মধ্যে (আমার) ভালো অবস্থান ছিল।’ এ গ্রন্থের ১৪ পৃষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু নিজ বয়ানে বলছেন, ‘খেলাধুলার দিকে আমার খুব ঝোঁক ছিল। আব্বা আমাকে বেশি খেলতে দিতে চাইতেন না। কারণ আমার হার্টের ব্যারাম হয়েছিল। আমার আব্বাও ভালো খেলোয়াড় ছিলেন। তিনি অফিসার্স ক্লাবের সেক্রেটারি ছিলেন। আর আমি মিশন স্কুলের ক্যাপ্টেন ছিলাম। আব্বার টিম ও আমার টিমে যখন খেলা হতো তখন জনসাধারণ খুব উপভোগ করত। আমাদের স্কুল টিম খুব ভালো ছিল। মহকুমায় যারা ভালো খেলোয়াড় ছিল, তাদের এনে ভর্তি করতাম এবং বেতন ফ্রি করে দিতাম।’ শুধু গোপালগঞ্জে নয়; ৪০-এর দশকে ওয়ান্ডারার্সের হয়ে ঢাকায় গিয়েও ফুটবল খেলেছেন তিনি।
সে সময় দেশের সেরা ফুটবলাররাই ওয়ান্ডারার্সে খেলার সুযোগ পেতেন। বঙ্গবন্ধু ১৯৪০ থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত টানা আট বছর ঢাকা ওয়ান্ডারার্সের জার্সি গায়ে স্ট্রাইকার পজিশনে খেলেছেন। ১৯৪৩ সালে বগুড়ায় আয়োজিত একটি ফুটবল টুর্নামেন্টে বঙ্গবন্ধুর অধিনায়কত্বে শিরোপা জিতেছিল ওয়ান্ডারার্স।
খেলাপাগল বঙ্গবন্ধু যুদ্ধবিধ্বস্ত, সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশেও খেলাধুলাকে ভুলে থাকেননি। ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় ক্রীড়া নিয়ন্ত্রণ সংস্থা গঠন করেন। বাংলাদেশে ঘরোয়া খেলাধুলার শুরু তখন থেকেই। আর্থিক সংকটের মধ্যেও দেশের খেলাধুলার অবকাঠামো উন্নয়নে সাধ্যমতো চেষ্টা করে যান বঙ্গবন্ধু। দেশের শীর্ষ ও গুরুত্বপূর্ণ ক্রীড়া ফেডারেশনগুলো তাঁর হাতেই গড়া। ১৯৭৪ সালে তো ফিফার সদস্যপদ পায় বাংলাদেশ।
১৯৭২ সালে কলকাতা মোহনবাগান দল ঢাকা একাদশ ফুটবল দলের সঙ্গে ফুটবল খেলতে ঢাকা সফর করে। বঙ্গবন্ধু সেদিনও খেলা শুরুর আগে মাঠে উপস্থিত হয়ে খেলোয়াড়দের উৎসাহ জুগিয়েছিলেন। বাংলাদেশ দল দেশের মাটিতে সেদিন সালাউদ্দিনের দেওয়া ১-০ গোলে জয়লাভ করে। ১৯৭৩ সালেও বঙ্গবন্ধু কলকাতা মোহনবাগান ও ঢাকা একাদশ দলের খেলা উপভোগ করেন স্টেডিয়ামে উপস্থিত থেকে। ১৯৭৩ সালে ঢাকা স্টেডিয়ামে রাশিয়ান মিনস্ক ডায়নামো বনাম বাংলাদেশ একাদশ দলের মধ্যে ফুটবল প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকা স্টেডিয়ামে বঙ্গবন্ধু সেদিন তাঁর ডানদিকে শেখ রাসেল, বাঁ দিকে তাজউদ্দীন আহমদসহ তাঁর মন্ত্রিপরিষদ সদস্যদের নিয়ে গ্যালারিতে বসে খেলা উপভোগ করেছিলেন। পরের বছর (১৯৭৪ সাল) বঙ্গবন্ধুর বড় ছেলে শেখ কামালের গড়া দল আবাহনী আইএফএ শিল্ড টুর্নামেন্ট খেলতে যায় কলকাতায়। বঙ্গবন্ধু তাদের এই যাত্রার প্রাক্কালে আবাহনীর খেলোয়াড়, কোচ, কর্মকর্তা প্রমুখকে বঙ্গভবনে ডেকে নিয়ে তাদের শুভেচ্ছা জানান। একইভাবে ১৯৭৫ সালে মালয়েশিয়ার মারদেকা কাপে খেলতে যাওয়া বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের খেলোয়াড় ও কর্মকর্তাদের গণভবনে ডেকে নিয়ে শুভেচ্ছা জানিয়ে তাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন, ‘খেলায় জয়লাভের চেয়েও দেশের মান-সম্মান অনেক বড়।’ তাঁরা যেন এমন আচরণ না করে, যাতে দেশের সম্মান ক্ষুণ্ণ হয়। তিনি সেদিন খেলোয়াড়দের কঠোর অনুশীলনেরও তাগিদ দিয়েছিলেন এবং খেলাধুলার সার্বিক মান উন্নয়নে তাঁর সরকারের নানা পরিকল্পনা ও প্রচেষ্টার কথাও তুলে ধরেছিলেন। শুধু বঙ্গবন্ধুই নন, তাঁর উত্তর প্রজন্মের সদস্যরাও এ দেশের ক্রীড়াকে উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর অবস্থায় নিয়ে যেতে অবদান রেখেছেন
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ (২০১২) এবং ‘কারাগারের রোজনামচা’ (২০১৭) গ্রন্থসহ তাঁর চিঠিপত্রে পাওয়া যায় বাংলা ও বিশ্বসাহিত্যের নিবিষ্ট এক পাঠকসত্তাকে।
রবীন্দ্রনাথ ছিলেন এই নেতার অন্তরজুড়ে। ১৯৬৬ সালের ১৭ জুলাই তারিখে লেখা তাঁর কারালিপিতে আছে রবীন্দ্রনাথের রাশিয়ার চিঠি না পড়তে পারারও খেদ :
‘আমার কতগুলি বইপত্র আই বি Withheld করেছে। আমাকে খবর দিয়েছে Reader’s Digest, টাইমস, নিউজউইক এবং রাশিয়ার চিঠি, কোনো বই-ই পড়তে দিবে না। পূর্বেও দেয় নাই। ... কত অধঃপতন হয়েছে আমাদের কিছুসংখ্যক সরকারি কর্মচারীর। রাজনীতির গন্ধ যে বইতে আছে তাঁর কোনো বই-ই জেলে আসতে দিবে না। জ্ঞান অর্জন করতে পারব না, কারণ আমাদের যারা শাসন করে, তারা সবাই-ই মহাজ্ঞানী ও গুণী!’
এর এক সপ্তাহ পর ২৪ জুলাই জেলখানায় মা-বাবার কথা স্মরণে এলে তিনি সমাগত দুঃখদিনে আশ্রয় নেন রবীন্দ্রকাব্যে :
‘মনে মনে কবিগুরুর কথাগুলো স্মরণ করে একটু শান্তি পেলাম।
বিপদে মোরে রক্ষা করো
এ নহে মোর প্রার্থনা,
বিপদে আমি না যেন করি ভয়।’
বঙ্গবন্ধু তাঁর ২১ বছর বয়সের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে আত্মজীবনীতে লিখেছেন :
‘একটা ঘটনার দিন-তারিখ আমার মনে নাই, ১৯৪১ সালের মধ্যেই হবে, ফরিদপুর ছাত্রলীগের জেলা কনফারেন্স, শিক্ষাবিদদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। তাঁরা হলেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম, হুমায়ুন কবির, ইব্রাহিম খাঁ সাহেব। সে সভা আমাদের করতে দিল না, ১৪৪ ধারা জারি করল। কনফারেন্স করলাম হুমায়ুন কবির সাহেবের বাড়িতে। কাজী নজরুল ইসলাম সাহেব গান শোনালেন।’
বঙ্গবন্ধুর লেখায় নানা প্রসঙ্গে এসেছে। সাহিত্য ও সংস্কৃতিজগতের গুণীদের কথা, যেমন শাহেদ সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিম, মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন, হবীবুল্লাহ বাহার, মুজিবুর রহমান খাঁ, মাওলানা আকরম খাঁ, আবুল মনসুর আহমদ, ইব্রাহীম খাঁ, কাজী মোহাম্মদ ইদ্রিস, মাহমুদ নূরুল হুদা, মোহাম্মদ মোদাব্বের, কামরুদ্দিন আহমদ, রণেশ দাশগুপ্ত, সত্যেন সেন, অজিত কুমার গুহ, মুনীর চৌধুরী, খন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস প্রমুখ। এসেছে পত্রিকা পড়া, পত্রিকার প্রতিবেদন ও কলামের অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ ও গান শোনার কথা। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরে এক ভ্রমণে গিয়ে নৌপথে আব্বাসউদ্দীনের কণ্ঠে ভাটিয়ালি গান শোনার অনুপম অভিজ্ঞতা বর্ণিত হয়েছে এই মহান নেতার কলমে :
নদীতে বসে আব্বাসউদ্দীন সাহেবের ভাটিয়ালি গান তাঁর নিজের গলায় না শুনলে জীবনের একটা দিক অপূর্ণ থেকে যেত। তিনি যখন আস্তে আস্তে গাইতেছিলেন তখন মনে হচ্ছিল, নদীর ঢেউগুলিও যেন তাঁর গান শুনছে। তাঁরই শিষ্য সোহরাব হোসেন ও বেদারউদ্দিন তাঁর নাম কিছুটা রেখেছিলেন। আমি আব্বাসউদ্দীন সাহেবের একজন ভক্ত হয়ে পড়েছিলাম। তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘মুজিব, বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে বিরাট ষড়যন্ত্র চলছে। বাংলা রাষ্ট্রভাষা না হলে বাংলার কৃষ্টি, সভ্যতা সব শেষ হয়ে যাবে। আজ যে গানকে তুমি ভালবাস, এর মাধুর্য ও মর্যাদাও নষ্ট হয়ে যাবে। যা কিছু হোক, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতেই হবে।’ আমি কথা দিয়েছিলাম এবং কথা রাখতে চেষ্টা করেছিলাম।