বান্দরবানে এলজিইডির সড়ক নির্মাণে নয়ছয়ের অভিযোগ
কোনো তদারকি ছাড়াই বান্দরবানের টংকাবতীতে চলছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) সড়কের নির্মাণকাজ। সংশ্লিষ্টদের যোগসাজশে তিনটি প্যাকেজে প্রায় ১১ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণকাজে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে। যেনতেনভাবে বিশ শতাংশ কাজ না করেই অফিস ম্যানেজ করে গত বছর প্রথম দফায় আগাম ৫০ শতাংশের কাজের বিল উত্তোলন করে নিয়েছে প্রভাবশালী ঠিকাদাররা। রাস্তায় বালি দেওয়ার নামে প্রকৃতি ধ্বংস করে এস্কাভেটর দিয়ে পাহাড় কেটে সড়কে ব্যবহার করা হচ্ছে লাল মাটি।
সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, বান্দরবান সদর উপজেলার টংকাবতী হাতিরডেরা সড়কে সবচেয়ে বেশি অনিয়ম এবং কাজে নয়ছয় হচ্ছে সড়কের দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্যাকেজে। এক নম্বর ইট ব্যবহারের কথা থাকলেও ড্রেনের কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে দুই-তিন নম্বর মানের ইট। সাববেইজ তৈরি না করেই মাটি কেটে করা কাঁচা সড়কের ওপর তড়িঘড়ি করে ডাম্পার ট্রাকে করে ঢেলে দেওয়া হচ্ছে বালি মিশ্রিত কংক্রিটের বড় খোয়া (মেকাডম)। সঙ্গে সঙ্গেই শ্রমিকরা সড়কের লেভেল মিলাচ্ছে আর তাৎক্ষণিক রোলার দিয়ে ডলে সমান করা হচ্ছে ভালোমন্দ মিশ্রিত খোয়ার মেকাডম। রোলার দিয়ে ডলা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই গুঁড়া হয়ে যাচ্ছে খোয়াগুলো। তবে অনিয়ম ঢাকতে ঠিকাদাররা তড়িঘড়ি করে নির্মাণকাজ চালালেও তিনটি প্যাকেজের কোথাও এলজিইডির দায়িত্বশীল কোনো কর্মকর্তাকেই দেখা যায়নি। কার্যাদেশের শর্ত মোতাবেক সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নিজ নিজ কাজে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রকৌশল তদারকি করার কথা থাকলেও তাদের কাউকেই খোঁজে পাওয়া যায়নি। রাস্তায় বালি দেওয়ার নামে এস্কাভেটর দিয়ে পাহাড় কেটে সাবাড় করে লাল মাটি ব্যবহার করা হচ্ছে। পাহাড় কেটে হাতিরডেরা এলাকার প্রাকৃতিক পরিবেশ ধ্বংস করছেন ঠিকাদাররা।
নির্মাণকাজের শ্রমিক মো. নাছির বলেন, খারাপ ইট ও খোয়ার মেকাডম মিশ্রিত থাকায় সবাই অভিযোগ করছে। প্রতিদিনই বিভিন্ন জনের কথা শোনাতে হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারদের বিষয়টি জানিয়েছি আমরা। কিন্তু ঠিকাদার কাজ চালিয়ে যেতে বলছেন, আমরা শ্রমিকরা কী করব। সবাইতো আমাদেরই গালিগালাজ করে।
রাজমিস্ত্রি জাহিদ হোসেন বলেন, ভালোমন্দ দেখার দায়িত্ব আমাদের নয়। আমরা ঠিকাদারের কাজ করি। ঠিকাদার যেমন মালামাল দিচ্ছেন, যেভাবে কাজ করতে বলছেন; আমরা ঠিক তেমনভাবেই কাজ করছি। দায়দায়িত্ব ঠিকাদারের ও অফিসের।
এলজিইডি অফিস ও স্থানীয়দের তথ্যমতে, বান্দরবান সদর উপজেলার টংকাবতী ইউনিয়নের লামা-সুয়ালক রাস্তা থেকে চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার চরম্বা সড়ক পর্যন্ত হাতিরডেরা প্রায় ১১ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ কাজের কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছিল ২০২১ সালে। চলতি বছরের অক্টোবর মাসে সড়ক নির্মাণকাজের সময়সীমা শেষ হয়ে গেছে। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর বর্ধিত সময় নিয়ে নির্মাণকাজ শুরু করেছে ঠিকাদার। কিন্তু দ্বিতীয় প্যাকেজের কাজ ৫০ ভাগও এগোতে পারেনি। তবে প্রথম ও দ্বিতীয় প্যাকেজের কাজ ৬০ থেকে শতাংশের মতো শেষ হয়েছে। সড়কের শূন্য থেকে তিন হাজার ৯২০ মিটার পর্যন্ত প্রথম প্যাকেজের কাজটির ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ইমু কনস্ট্রাকশনের নামে বাস্তবায়ন করছেন ঠিকাদার মো. মোজাফ্ফর। কাজের প্রাক্কলিত মূল্য পাঁচ কোটি ৯৮ লাখ টাকা হলেও অফিস ম্যানেজ করে ব্যয় বাড়িয়ে ছয় কোটি ৩৯ টাকায় চুক্তিমূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে বিল তুলে নিয়েছেন দুই কোটি ৩৫ লাখ টাকা। পরের প্যাকেজটি তিন হাজার ৯২১ মিটার থেকে ছয় হাজার ৭৩০ মিটার পর্যন্ত। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এম এম ট্রেডার্সের নামে কাজটি বাস্তবায়ন করছেন আওয়ামী লীগনেতা উজ্জ্বল কান্তি দাস ও তাপস দাস। এ কাজে প্রাক্কলিত মূল্য চার কোটি ৫৫ লাখ টাকা থেকে ব্যয় বাড়িয়ে চার কোটি ৮৬ লাখ টাকায় চুক্তিমূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে। কাজের কোনো অগ্রগতি না থাকলেও ইতোমধ্যে বিল উত্তোলন করে নিয়েছেন এক কোটি নয় লাখ টাকা। দীর্ঘদিন বিরতির পর গত মাসে পুনরায় কাজ শুরু করেছেন ঠিকাদার। শেষের প্যাকেজটি দ্বিতীয় প্যাকেজের শেষাংশ থেকে ১০ হাজার ৯৮০ মিটার পর্যন্ত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স ইউটিমংয়ের নামে বাস্তবায়ন করছেন ঠিকাদার জসিম উদ্দিন ও সায়েদুল ইসলাম জুয়েল। এ কাজেও প্রাক্কলিত মূল্য ছয় কোটি ৩৯ লাখ টাকা থাকলেও ব্যয় বাড়িয়ে ছয় কোটি ৮৯ লাখ টাকায় চুক্তিমূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে। অফিস ম্যানেজ করে গত বছরই ২০ শতাংশ কাজ শেষ না করেই তিন কোটি সাত লাখ টাকা কাজের বিল উত্তোলন করে নিয়েছিল ঠিকাদার। তবে দীর্ঘদিন পর নতুন করে কাজ শুরু করেছে ঠিকাদার। ইতোমধ্যে কাজের অগ্রগতিও এগিয়েছে ৫০ ভাগের মতো।
স্থানীয় ইউপি সদস্য নূরুল কবীর ও স্থানীয় বাসিন্দা সাপ্রু ম্রো, রিয়াংরে ম্রো অভিযোগ করে বলেন, সড়ক নির্মাণকাজে কোনো তদারকি নেই। ঠিকাদার নিজের ইচ্ছেমতো অনিয়ম করছেন সড়ক নির্মাণ কাজে। নিম্নমানের কংক্রিট, বালি, ইট, লোহা ব্যবহার করে সড়ক, ড্রেন, গাইড ওয়ালের কাজ করছেন। সাববেইজ তৈরি না করেই মাটি কেটে কাঁচা সড়কে ডাম্পার ট্রাকে করে ঢেলে দেওয়া হচ্ছে ভালোমন্দ মিশ্রিত খোয়ার মেকাডম। সঙ্গে সঙ্গেই রোলার দিয়ে ডলে সমান করে ফেলায় অনিয়মগুলো চোখের আড়ালে চলে যাচ্ছে। রাস্তায় বালির নামে পাহাড় কেটে লাল মাটি দেওয়া হচ্ছে। তবে অনিয়মের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন সংশ্লিষ্ট ঠিকাদাররা।
সড়ক নির্মাণকাজের দায়িত্বপ্রাপ্ত এলজিইডি সহকারী প্রকৌশলী আমানুর রহমান বলেন, দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্যাকেজে প্রায় ছয় কিলোমিটার রাস্তায় পুরোনো ইট ছিল। সরকারিভাবে দামদরে ইটের অর্থকেটে নিয়ে পুরোনো ইটগুলো ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়। যার কারণে বড় খোয়ার মেকাডমে ভালোমন্দ মিশ্রিত রয়েছে। সাববেজ তৈরি করেই মেকাডম দেওয়া হচ্ছে। পাহাড়ে শতভাগ নিখুঁত কাজ করা কঠিন। কাজের মধ্যে ভুলত্রুটি হচ্ছে। সেগুলো পুনরায় ঠিকভাবে করানো হচ্ছে। কাজের অগ্রগতি অনুসারে গত বছর জুন মাসের আগেই ঠিকাদাররা প্রথম দফায় বিল উত্তোলন করেছিল। অনেকে কমবেশি পেয়েছিল।
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর সদর উপজেলা প্রকৌশলী বি এম মাহমুদুল হাসান বলেন, জনবল সংকট রয়েছে। তার পরও কার্যাদেশ মোতাবেক কাজের গুণগতমান ঠিক রেখে সড়কের নির্মাণকাজ বাস্তবায়নে সচেষ্ট রয়েছে তারা। কাজের অনিয়ম পাওয়া গেলে পুনরায় কাজ করিয়ে নেওয়া হচ্ছে। নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারের অভিযোগে দ্বিতীয় প্যাকেজের কাজ বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে।