মহেশখালীর সোনাদিয়া দ্বীপ বর্জ্যে সয়লাব, হুমকির মুখে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য
গভীর সাগরের পানির স্রোতে ভেসে আসা বর্জ্যে সয়লাব স্বর্ণদ্বীপ হিসেবে পরিচিত কক্সবাজারের মহেশখালীর সোনাদিয়া দ্বীপ। এতে করে দ্বীপের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে। ভেসে আসা বর্জ্যের মধ্যে ৬০ থেকে ৭০ ভাগই বিদেশি বর্জ্য বলে জানিয়েছেন সমুদ্রবিজ্ঞানীরা। সম্প্রতি বাংলাদেশ সমুদ্রবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের একদল বিজ্ঞানী ও পরিবেশকর্মী সোনাদিয়া দ্বীপ ঘুরে এসে জানিয়েছেন এ তথ্য। তাদের হিসেব মতে, পুরো সোনাদিয়া দ্বীপের বিস্তীর্ণ সৈকত ও ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলে কয়েক হাজার টন অপচনশীল ও প্লাস্টিকের বর্জ্য থাকতে পারে।
কক্সবাজারের দ্বীপ উপজেলা মহেশখালীর কুতুজুম ইউনিয়নের একটি ওয়ার্ড সোনাদিয়া দ্বীপ। অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দ্বীপ সোনাদিয়া। সোনাদিয়া দ্বীপে বসবাস করে সাড়ে তিনশ পরিবারে প্রায় দেড় হাজার জন নারী-পুরুষ। ভোটার সংখ্যা ৩৮৪। ৮০ শতাংশ মানুষ মৎস্য আহরণ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। কিছু পরিবার চিংড়ি ও লবণ উৎপাদনে জড়িত। সোনাদিয়ার তিনদিকে সমুদ্র। উত্তর পূর্বদিকে গভীর প্যারাবন বা ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট আর দক্ষিণ পশ্চিম আর উত্তর পাশে বিশাল ঝাউবিথি ও সমুদ্র সৈকত।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, সোনাদিয়া দ্বীপটি কক্সবাজার শহর থেকে ১০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে সাগরগর্ভে অবস্থিত। তিনদিকে সমুদ্রসৈকতঘেরা দ্বীপটির আয়তন প্রায় ৯ বর্গকিলোমিটার। সোনাদিয়া দ্বীপ মূলত সাগরলতায় ঢাকা বালিয়াড়ি, কেয়া-নিসিন্দার ঝোপ, ছোট-বড় খালবিশিষ্ট প্যারাবন। এটি কক্সবাজারের মহেশখালীর মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন। এই দ্বীপে ম্যানগ্রোভ বন রয়েছে। সেখানকার সাগরের পানি কক্সবাজারের মতো ঘোলা নয়, গভীর ও নীল। এই দ্বীপে প্রচুর লাল কাঁকড়া ও সামুদ্রিক পাখি রয়েছে। একসময় এই দ্বীপ ছিল ৫৬৭ প্রজাতির উদ্ভিদ, ১৫২ প্রজাতির শামুক, ২১ প্রজাতির কাঁকড়া, ৯ প্রজাতির চিংড়ি, ২০৭ প্রজাতির মাছ, ১২ প্রজাতির উভচর, ১৯ প্রজাতির সরীসৃপ এবং ২০৬ প্রজাতির পাখির অভয়ারণ্য।
সোনাদিয়া দ্বীপের প্রাণপ্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য নিয়ে গবেষণা করা বেসরকারি সংস্থা নেচার কনজার্ভেশন ম্যানেজমেন্ট নেকম এর জেলা ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ আবদুল কাইয়ুম জানান, ‘বর্তমানে সোনাদিয়া দ্বীপে ৪৫ প্রজাতির পাখি দেখা যায়। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এবং পরিবেশ বিনষ্টের কারণে প্রাণপ্রকৃতির অনেক কিছুর বিলুপ্তি ঘটেছে। হুমকিতে আছে দ্বীপের জীববৈচিত্র্য। এখন ইকোট্যুরিজম পার্ক প্রতিষ্ঠার নামে অবশিষ্ট প্রকৃতি-সম্পদও ধ্বংস করা হচ্ছে। পৃথিবীতে যে ৩০০–এর মতো চামচঠুঁটো কাদাখোঁচা (স্যান্ডপাইপার) পাখি আছে, তার উল্লেখযোগ্য অংশ দেখা যায় সোনাদিয়ার প্যারাবনে। প্যারাবন উজাড় করে চিংড়িঘের নির্মাণ করায় চামচঠুঁটোসহ অন্যান্য পাখির বিচরণ চোখে পড়ে না।’
সাম্প্রতিককালে এই দ্বীপের পশ্চিম-দক্ষিণাংশে সৈকতে ভেসে আসছে শত শত টন বর্জ্য। জোয়ারের পানিতে ভেসে এসে বিস্তীর্ণ সৈকতে জমা হচ্ছে এসব বর্জ্য। সৈকতে এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বর্জ্যের স্তূপ। সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, এসব বর্জ্যের সিংহভাগই বিদেশি বর্জ্য।
সম্প্রতি সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, দ্বীপের পূর্বপাড়া থেকে পশ্চিমপাড়া পর্যন্ত সাত কিলোমিটার সৈকত প্লাস্টিক বর্জ্যে ভরপুর। জোয়ারে ভেসে আসা বিভিন্ন ধরনের প্লাস্টিক পণ্য, বোতল, প্লাস্টিকের ক্যান, স্যান্ডেল, পলিথিন ব্যাগ, মাছ ধরার জাল, মেডিকেল বর্জ্যসহ বিভিন্ন ধরনের বর্জ্য সেখানে রয়েছে।
সোনাদিয়া দ্বীপের পরিবেশকর্মী মোহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন জানান, ‘জোয়ারের পানিতে ভেসে আসা বেশির ভাগ প্লাস্টিক সৈকতের বালুর নিচে চাপা পড়ছে। কিছু জোয়ারের পানিতে ভেসে যাচ্ছে। এসব খেয়ে মারা যাচ্ছে মাছ ও পাখি। গভীর সমুদ্রে দেশি-বিদেশি জাহাজ থেকে ফেলা প্লাস্টিক বর্জ্য জোয়ারে ভেসে এই দ্বীপে জমা হচ্ছে। এসব সরানোর কেউ নেই। গত বছরের ২৪ অক্টোবর ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে জলোচ্ছ্বাসে কয়েকশ টন প্লাস্টিক বর্জ্য সৈকতে ভেসে আসে। মাঝেমধ্যে জোয়ারে ভেসে আসছে প্লাস্টিক পণ্য ও মরা জীবজন্তু। বর্জ্য সরাতে সরকারি-বেসরকারি কোনো উদ্যোগ নেই।’
বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) ও সমুদ্রবিজ্ঞানী সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দারের নেতৃত্বে একদল পরিবেশবিজ্ঞানী গবেষক গত দুমাসে একাধিক দফায় সোনাদিয়া দ্বীপ পরিদর্শনে যান। তাঁরা পরিবেশ নষ্টের এই ভয়াবহ চিত্র দেখতে পান। গত ৫ জানুয়ারি সমুদ্রবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের এই কর্মকর্তাসহ জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচি ইউএনডিপির ডেপুটি আবাসিক প্রতিনিধি এই দ্বীপ পরিদর্শন করেন।
সমুদ্রবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দার জানান, ‘সোনাদিয়া দ্বীপের সৈকতে ভেসে আসা প্লাস্টিকগুলো মাইক্রোপ্লাস্টিকে পরিণত হয়ে আবার সাগরে মিশে যাচ্ছে। তাতে সমুদ্রের পানি দূষিত হচ্ছে। এ কারণে প্রাণি ও উদ্ভিদ পরিবেশ থেকে চিরতরে হারিয়ে যেতে পারে। তিন যুগ আগের সোনাদিয়ার জীববৈচিত্র্য ইতোমধ্যে অনেকাংশ ধ্বংস হয়ে গেছে।’
সাঈদ মাহমুদ বেলাল হায়দার আরও বলেন, ‘২০১৮ সালে প্রথম সোনাদিয়া দ্বীপে বিদেশি বর্জ্য ভেসে আসতে দেখা গেছে। পর্যায়ক্রমে তা প্রচুর পরিমাণে বর্জ্য জমা হতে থাকে। গত বছর ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং এর সময় জলোচ্ছ্বাসে সবচেয়ে বেশি বর্জ্য এসেছে। বর্তমানে পূর্ণিমা কিংবা অমাবস্যার জোয়ারে বর্জ্য সৈকতে ভেসে আসছে। সোনাদিয়া দ্বীপে যে সব বর্জ্য দেখা গেছে, তার মধ্যে ৬০ থেকে ৭০ ভাগই বিদেশি অপচনশীন বর্জ্য।’
সাঈদ মাহমুদ বেলাল বলেন, ‘এসব বর্জ্য অপসারণ না করায় জোয়ারের পানি ঢেউয়ের তোড়ে সোনাদিয়া দ্বীপের ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট বা প্যারাবনের ভেতরে ঢুকে পড়ছে। এতে করে প্যারাবন মরে যাচ্ছে। সোনাদিয়া দ্বীপে কী পরিমাণ বর্জ্য রয়েছে তার সঠিক পরিমাপ করা কঠিন। বর্তমানে সোনাদিয়া দ্বীপে কয়েকহাজার টন বর্জ্য থাকতে পারে। গত ডিসেম্বরে বাংলাদেশ সমুদ্রবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানী ও গবেষকেরা সরেজমিনে পরিদর্শনের পর সোনাদিয়া দ্বীপ থেকে প্রায় দুই টন অপচনশীল প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ করেন এবং তা কক্সবাজার পৌরসভার কাছে হস্তান্তর করেন।’
সাগর-মহাসাগর থেকে সোনাদিয়া দ্বীপে এসে এসব ময়লা আবর্জনা এসে জমা হচ্ছে। বর্তমানে দ্বীপের সৈকতের বিভিন্ন পয়েন্টে বিদেশি ময়লা আবর্জনার স্তুপ হয়ে আছে। অপচনশীল বর্জ্যের উৎস অনুসন্ধান, দ্বীপের জীববৈচিত্র্য প্রাকৃতিক সম্পদসহ নানা বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহে বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউট ও জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি ইউএনডিপির উচ্চ পর্যায়ের এই প্রতিনিধি দল সোনাদিয়া দ্বীপ পর্যবেক্ষণ করেন। দ্বীপের বর্জ্যগুলো কীভাবে এসেছে, কেন এসেছে এসব নিয়ে কথা বলেন গবেষকরা। তারা জানিয়েছেন আরব সাগরের পানির গভীর স্রোত সরাসরি সোনাদিয়া দ্বীপে এসে মিশেছে। গভীর সাগরে বিদেশি জাহাজ থেকে ফেলা বর্জ্য পানির স্রোতে সোনাদিয়া দ্বীপে চলে আসছে।
ইউএনডিপির গবেষক ড. রমিজ উদ্দিন জানান, ভেসে আসা এসব বর্জ্যের কারণে সোনাদিয়া দ্বীপের পরিবেশ-প্রতিবেশ পড়েছে হুমকির মুখে। এসব বিষয় নিয়ে সরকারি-বেসরকারি সংস্থা সবাইকে একসাথে কাজ করতে হবে। এখানকার পাখি ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় স্থানীয় জনগণ, স্থানীয় সরকার এবং উন্নয়ন সংস্থাগুলোকে কাজ করতে হবে।
ইউএনডিপির ডেপুটি আবাসিক প্রতিনিধি ভ্যান এনগুয়েন জানান, ‘সোনাদিয়া একটি সুন্দর দ্বীপ। এটি ব্লু ট্যুরিজমের জন্য খুবই উপযোগী এবং গ্রিন ট্যুরিজমের জন্য একটি অন্যতম দর্শনীয় স্থান হতে পারে। সাগর থেকে ভেসে আসা বর্জ্য অপসারণ নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের সাথে কাজ করবে ইউএনডিপি।’
সোনাদিয়া দ্বীপকে ঘিরে সরকার ইকো ট্যুরিজমসহ বিশাল অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার পরিকল্পনা নিয়েছে। তাই সমুদ্রের পাশাপাশি এই সোনাদিয়া দ্বীপের পরিবেশ-প্রতিবেশ রক্ষা করা অতীব জরুরি মনে করছেন পরিবেশবিদরা।