মেয়রের চেয়ারে বসার ৫ মিনিটেই বরখাস্ত হলেন বুলবুল
সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রায়ে প্রায় দুই বছর পর রাজশাহী সিটি করপোরেশনের (রাসিক) মেয়রের দায়িত্ব নিয়েছিলেন মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল। কিন্তু মেয়রের চেয়ারে বসার পাঁচ মিনিটের মধ্যেই সাময়িক বরখাস্ত হয়েছেন তিনি।
রাজশাহী মহানগর বিএনপির সভাপতি মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল আজ রোববার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে দায়িত্ব নিতে নগর ভবনে যান। এর আগে থেকে মেয়র বুলবুলের বিপক্ষের কয়েকজন কাউন্সিলর মেয়রের কক্ষে তালা দিয়ে পাশে মেয়রের সহকারী একান্ত সচিবের কক্ষে বসে ছিলেন।
কয়েকজন ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সিটি করপোরেশনের একাধিক কর্মকর্তা ও কর্মচারী অভিযোগ করে বলেন, গত সিটি নির্বাচনে বিএনপির সমর্থন নিয়ে ৯ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়ার পর আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়া এ কে এম রাশেদুল হাসান টুলুর নেতৃত্বে কয়েকজন কাউন্সিলর মেয়রের কক্ষে তালা দিয়ে চাবি নিজেদের কাছে রেখে দেন। এ সময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন ৩ নম্বর ওয়ার্ডের বিএনপিপন্থী কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান, ৫ নম্বর ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগপন্থী কাউন্সিলর কামরুজ্জামান কামরু, ১২ নম্বর ওয়ার্ডের বিএনপিপন্থী কাউন্সিলর ইকবাল হোসেন দিলদার, ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের বিএনপিপন্থী কাউন্সিলর রবিউল আলম মিলু, ১৬ নম্বর ওয়ার্ডের বিএনপিপন্থী কাউন্সিলর বেলাল আহম্মেদ ও ১২ নম্বর ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগপন্থী কাউন্সিলর আরমান আলী।
বুলবুল মেয়রের কক্ষে ঢুকতে না পেরে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার দপ্তরে গিয়ে অপেক্ষা করেন। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে মেয়রের সহকারী একান্ত সচিবের কক্ষে বসে থাকা মেয়র বুলবুলের বিরোধিতাকারী কাউন্সিলরদের কক্ষের আসবাবপত্র ও থাই গ্লাস ভেতর থেকে ভাঙচুর করা হয়। এ সময় মেয়র বুলবুলের সঙ্গে বিএনপি নেতাকর্মীরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। তারা মেয়রের সহকারী একান্ত সচিবের কক্ষের আসবাবপত্র ও থাই গ্লাস ভাঙার জন্য ভেতরে অবস্থানকারী মেয়রের বিপক্ষে অবস্থান নেওয়া কাউন্সিলরদের দায়ী করেন।
এ সময় নগর ভবনে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়লে বিপুল পুলিশ মোতায়েন করা হয়। পরে পুলিশের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এলে দুপুর ২টার দিকে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ড. শরীফ উদ্দিন ও সচিব মাহাবুবুর রহমানের উপস্থিতিতে তালা ভেঙে মেয়রের কক্ষ খোলা হয়।
এর আগে সিটি করপোরেশনের প্রকৌশল বিভাগের একজন প্রকৌশলী মেয়রের কক্ষের তালা ভাঙার উদ্যোগ নিলে ৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর এ কে এম রাশেদুল হাসান টুলু খারাপ আচরণ করে তাঁকে তাড়িয়ে দেন।
তবে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে কাউন্সিলর রাশেদুল হাসান টুলু ও রবিউল আলম মিলু তাঁদের বিরুদ্ধে মেয়রের সহকারী একান্ত সচিবের কক্ষ ভাঙচুরের অভিযোগ অস্বীকার করে মেয়র বুলবুলের সঙ্গে আসা দলীয় নেতাদের এজন্য দায়ী করেন। কাউন্সিলর টুলু মেয়রের কক্ষে তালা দেওয়ার অভিযোগও অস্বীকার করেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বোয়ালিয়া মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাহাদাৎ হোসেন বলেন, কে বা কারা মেয়রের কক্ষে তালা লাগিয়েছিল, তা সেখানে উপস্থিত কেউ জানাতে পারেনি।
এদিকে করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও সচিবের কক্ষে সাড়ে চার ঘণ্টা অপেক্ষা করার পর পুলিশের উপস্থিতিতে মেয়রের কক্ষের তালা ভাঙা হলে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বেলা ৩টার দিকে মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুলকে মেয়রের কক্ষে নিয়ে যান। এ সময় মেয়রপন্থী কয়েকজন কাউন্সিলর, বিএনপি দলীয় আইনজীবী ও নেতাকর্মীরা সঙ্গে ছিলেন। বুলবুল মেয়রের চেয়ারে বসে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন।
এদিকে বেলা ৩টা ৫ মিনিটের দিকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মুহাম্মদ আনোয়ার পাশা স্বাক্ষরিত মেয়র বুলবুলকে সাময়িক বরখাস্তের আদেশের কপি ফ্যাক্সযোগে রাসিকে আসে। আদেশের খবর শুনে ৩টা ১২ মিনিটের দিকে মেয়র বুলবুল তাঁর অফিস কক্ষ ত্যাগ করেন। এ সময় তিনি গণমাধ্যমকর্মীদের বলেন, যে ধরনের মামলার কারণ দেখিয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় তাঁকে আবারও সাময়িক বরখাস্তের আদেশ দিয়েছে, সে ধরনের মামলায় আগেই তাঁকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছিল। দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের পর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ থেকে তিনি দায়িত্ব ফিরে পেয়েছেন।
বুলবুল বলেন, ‘মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের আদেশ মোতাবেক আমার নামে কোনো ফ্যাক্স যদি আসে, সেটি ষড়যন্ত্রমূলক ফ্যাক্স এবং সেটির আইনগত কোনো বৈধতা নাই।’ তাই মন্ত্রণালয়ের এ আদেশ তিনি আমলে নিচ্ছেন না এবং সোমবারও তিনি অফিস করবেন বলে অফিস কক্ষ ত্যাগ করেন বুলবুল।
এদিকে, রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগের উপসচিব মুহাম্মদ আনোয়ার পাশা স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুলের বিরুদ্ধে মহানগর বিশেষ ট্রাইব্যুনাল-১, রাজশাহীর মামলা নম্বর: ১৩৬/১৫ (রাজশাহীর বোয়ালিয়া থানার মামলা নম্বর : ১৭, তারিখ- ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৫-এর অভিযোগপত্র আদালতে গৃহীত হয়েছে। সেহেতু, রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র মোসাদ্দেক হোসেনকে স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইন ২০০৯ এর ধারা ১২-এর উপ-ধারা (১)-এ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হলো।’
এর আগে ২০১৫ সালের ৭ মে রাজশাহী সিটি করপোরেশনের নির্বাচিত মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুলকে অন্য একটি মামলার বরাত দিয়ে একই কারণ দেখিয়ে সাময়িক বরখাস্ত করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। পরে হাইকোর্ট তাঁকে বরখাস্তের আদেশ অবৈধ ঘোষণা করেন। এর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করলে সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ হাইকোর্টের আদেশ বহাল রাখেন। আদালতের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে গত মঙ্গলবার স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মাহমুদুল হাসান স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে রাজশাহী সিটি করপোরেশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত মেয়র ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে নির্দেশনা দেওয়া হয়।
মেয়র বুলবুলকে আবারও সাময়িক বরখাস্তের বিষয়ে রাজশাহী সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ড. শরীফ উদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি মন্ত্রণালয় থেকে এ সংক্রান্ত নির্দেশনা পাওয়ার কথা স্বীকার করে বলেন, মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনাই বাস্তবায়িত হবে।
মেয়র বুলবুল মন্ত্রণালয়ের আদেশ অবৈধ দাবি করে সোমবার আবারও নগরভবনে আসার ঘোষণার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, তিনি মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন পড়ার পর কী করণীয় তা নিজেই বুঝতে পারবেন।