মায়েদের লাশও নিতে চায় না সন্তানরা!
রাজধানীর উত্তরখানে আপন নিবাস বৃদ্ধাশ্রমে থাকা বৃদ্ধারা মারা গেলে তাঁদের লাশ সন্তানরা নিতে চায় না। তাই কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে তাঁদের দাফন করা হয় বলে জানিয়েছেন বৃদ্ধাশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক সৈয়দা সেলিনা শেলী।
আজ শনিবার এনটিভি অনলাইনের এই প্রতিবেদককে সৈয়দা সেলিনা শেলী বলেন, বৃদ্ধাশ্রমে কিছুদিন থাকার পর এক মা মারা গিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর সন্তানরা লাশ নিতে চাননি। পরে নিজেদের উদ্যোগেই লাশ দাফনের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
সেলিনা শেলী বলেন, বৃদ্ধাশ্রমে থাকা কোনো বৃদ্ধার নাম-ঠিকানা বা সঠিক পরিচয় জানা নেই। কিন্তু যাঁদের পরিচয় জানা আছে, তাঁরা মারা গেলেও তাঁর লাশ নিতে চায় না সন্তানরা। অনেকে বলেন, লাশ দাফন করার মতো জায়গা তাঁদের নেই।
আপন নিবাস বৃদ্ধাশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক বলেন, ‘নানা কারণে আমাদেরই লাশ দাফনের ব্যবস্থা করতে হয়। এমনকি লাশ কাঁধে নেওয়ার মতো লোকজনও পাওয়া যায় না। এসব কারণে কোনো সন্তান বৃদ্ধাশ্রমে মাকে দেখতে এলে তাঁদের নাম-ঠিকানা ও মুঠোফোন নম্বর লিখে রাখি। যাতে করে কোনো বৃদ্ধা মারা গেলে তাঁর লাশ দাফন করার জন্য তাঁর সন্তানদের সহযোগিতা পাওয়া যায়।’
আপন নিবাস বৃদ্ধাশ্রম
আপন নিবাস বৃদ্ধাশ্রমের কার্যক্রম সম্পর্কে সৈয়দা সেলিনা শেলী এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘আমি এই আশ্রম পরিকল্পিতভাবে করিনি। মানবাধিকার সংগঠন কর্মজীবী নারীর সঙ্গে কাজ করতাম। আমি নারীর অধিকার, মর্যাদা নিয়ে যে সমস্যা তা নিয়ে কাজ করতাম। এই কাজের সুবাদে ২০ বা ৩০ বছর আগে যেসব অসহায় নারীকে নিয়ে কাজ করেছি, তাঁরা যখন বুড়ো হয়েছেন তখন তাঁরা বলেন, আমাদের আপনি অধিকারের কথা, ন্যায়নীতির কথা শিখিয়েছেন। কিন্তু এখন এই বয়সে পরিবারে আমাদের সন্তান থাকলেও ভাত দেয় না, আমরা পরিবারে জায়গা পাচ্ছি না, আমরা যাব কই। আমাদের একটা ব্যবস্থা করে দেন।’
এরপর সাতজন বৃদ্ধাকে নিয়ে প্রথমে নিজের বাড়িতে রাখেন শেলী। নিজের চাকরির টাকায় তাঁদের ভরণ-পোষণ চালাতেন। কিন্তু কয়েক বছর পর এসব নিয়ে তাঁর পরিবারে সমস্যা শুরু হয়। আত্মীয়স্বজনদের অনেকেই বিষয়টি পছন্দ করেননি। তাঁরা বলতেন, ঘরের মধ্যে এতগুলো মানুষ, তাদের জন্য রান্না করা সব মিলিয়ে নাকি শেলীর বাড়ি হোটেলের মতো মনে হতো।
এরপর সেলিনা শেলী এই বৃদ্ধাদের রাখার জন্য একটি ভাড়া বাড়ি খুঁজতে শুরু করেন। ছয় মাস খোঁজার পরেও কোনো বাড়ি পাননি। কোনো বাড়িওয়ালা বাসা ভাড়া দিতে চাইতেন না। কারণ বয়স্ক নারীরা প্রস্রাব-পায়খানা করবেন, কফ-থুতু ফেলবেন। হয়তো তাঁদের বাসা নষ্ট হয়ে যাবে।
এখন যে ভবনে আপন নিবাস বৃদ্ধাশ্রম, সেটি আসলে একটি পরিত্যক্ত বাড়ি ছিল বলে জানান সৈয়দা সেলিনা শেলী। রাস্তা ছিল না, বিদ্যুৎ সংযোগ ছিল না। এমনকি পানির ব্যবস্থাও ছিল না। তারপরেও অল্প কিছু টাকা ভাড়া দিয়ে ওই সাতজন মানুষকে নিয়ে ২০১০ সালে এই বাড়িতে ওঠেন তিনি। বলেন, ‘সে সময় তাদের তিন বেলা ঠিকমতো খাবার দিতে পারি নাই। এ সময় উত্তরা এলাকার রুবি বেগম নামের একজন নারী আমাকে ব্যাপক সাহায্য করেছেন এবং এখন পর্যন্ত করে যাচ্ছেন। আমি আমার গহনা বিক্রি করেছি, শাড়ি বিক্রি করেছি শুধু তাদের খাবার জোগাড় করতে।’
২০১২ সালের জানুয়ারি মাসে আনুষ্ঠানিকভাবে আপন নিবাস বৃদ্ধাশ্রমের কার্যক্রম শুরু হয়। বর্তমানে এখানে কর্মচারীর সংখ্যা পাঁচজন। বাকিরা স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করে। বিভিন্ন ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানের সামান্য কিছু অনুদানের টাকা দিয়েই চলছে বৃদ্ধাশ্রমটির কার্যক্রম।
আপন নিবাসে সকালে বাসিন্দাদের নাশতা দেওয়া হয়। এরপর সকাল ১০টার সময় ভাত, দুপুরে ভাত এবং রাতে ভাত দেওয়া হয়। এ ছাড়া কোনো কোনো দিন তাঁদের জন্য বিকেলে হালকা নাশতার ব্যবস্থাও করা থাকে।
সৈয়দা সেলিনা শেলী আরো জানান, কিছু দিন আগে ফেসবুকে আপন নিবাস নিয়ে একটি পোস্ট দেওয়ার ফলে তরুণ ছেলেমেয়েরাও আর্থিক সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। অনেকে এখানে খাবার নিয়ে এসে নিজের হাতে বৃদ্ধাদের খাইয়ে যান।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাইলে সেলিনা শেলী জানান, তেমন কোনো পরিকল্পনা নেই তাঁদের। আপাতত মাথা গোঁজার জন্য স্থায়ী একটি জমি পেলেই খুশি তাঁরা। যেন সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে পারেন বৃদ্ধ মায়েরা। সংসার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েও যেন নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন তাঁরা। আর এ জন্য সমাজের সচ্ছল ও বিত্তশালী ব্যক্তিদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি। আর কিছু না হলেও একবেলা খাবার দিয়ে সাহায্য করতে আহ্বান জানান তিনি।
সবশেষে শেলী বলেন, ‘বাংলাদেশের কোথাও যদি এমন কোনো মা থাকেন যার নিরাপদ আশ্রয় নেই, সেই খবরটা আমাদের ফোন করে জানালে আমরা গিয়ে তাঁদের নিয়ে আসব।’