চার শিশু হত্যার রায়ে কেউ খুশি নয়
গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জেরে হবিগঞ্জের বাহুবল উপজেলায় চাঞ্চল্যকর চার শিশু হত্যার দায়ে মামলার রায়ে রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামিপক্ষের আইনজীবী অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
রাষ্ট্রপক্ষ এ মামলায় সব আসামির ফাঁসির দণ্ডাদেশ আশা করেছিলেন। অন্যদিকে এ মামলার পুনরায় তদন্তের পাশাপাশি উচ্চ আদালতে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন আসামিপক্ষের আইনজীবী।
আজ বুধবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে সিলেটের দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক মকবুল আহসান এ মামলার রায় ঘোষণা করেন। রায়ে তিন আসামিকে ফাঁসির দণ্ডাদেশ, আরো দুজনকে সাত বছর করে সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। অপরাধ প্রমাণিত না হওয়ায় তিনজন খালাস পেয়েছেন।
ফাঁসির দণ্ডাদেশপ্রাপ্তরা হলেন হাবিবুর রহমান আরজু, রুবেল মিয়া ও উস্তার মিয়া। সাত বছরের সশ্রম দণ্ড দেওয়া হয়েছে জুয়েল মিয়া ও শোয়েব আহমেদ বশিরকে। আর খালাস পেয়েছেন আবদুল আলী বাগাল, বিল্লাল মিয়া ও বাবুল মিয়া।
তাঁদের মধ্যে উস্তার মিয়া, বাবুল মিয়া ও বিল্লাল পলাতক। বাকিরা রায় ঘোষণার সময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন।
মামলার রায়কে কেন্দ্র করে আজ সকাল থেকে আদালত চত্বরে কড়া নিরাপত্তা নেওয়া হয়। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে কারাগারে থাকা পাঁচ আসামিকে আদালতে হাজির করা হয়। মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ছিলেন কিশোর কুমার কর ও আসামিপক্ষের আইনজীবী মো. শফিউল আলম।
রায়ের পর গণমাধ্যমে প্রতিক্রিয়ায় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী কিশোর কুমার বলেন, ‘নিষ্পাপ একটা শিশুকে তাঁরা পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে আমরা মোটামুটি ৫২ সাক্ষী দিয়ে এই মামলাটাকে সুস্পষ্ট প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছি। কিন্তু এখানে রায়ে আমরা যথেষ্ট পরিমাণে সন্তুষ্ট হতে পারি নাই।’
‘কারণ, এখানে আমরা আশা করেছিলাম যে, সব আসামিকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হবে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে দেখা যায়, তিনজন আসামিকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছে এবং দুজন আসামিকে সাত বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে এবং তিনজন আসামিকে খালাস দেওয়া হয়েছে।’
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আরো বলেন, ‘আমরা এখনো পূর্ণাঙ্গ আদেশটা পাই নাই বা রায়ের কপিটাও আমাদের কাছে আসে নাই। আমরা রায়ের কপিটা পাওয়ার পরে রায়ের কপিটা পর্যালোচনা করে, আমরা এর বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।’
অপরদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবী মো. শফিউল আলম বলেন, ‘এই রায় আইনের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণভাবে পরিপন্থী। এই রায়ে যদি কাউকে শাস্তি প্রদান করতে হয়, যেসব সাক্ষী আসছে সব আসামিকে সাজা দিতে হবে। আর যদি খালাস দিতে হয়, তাহলে প্রত্যেক আসামিকেই খালাস দিতে হবে। এখানে স্বেচ্ছাপ্রণোদিত জবানবন্দি যেটা, এটা ভলান্টারি এবং ট্রু ছিল না, কোনো নিরপেক্ষ সাক্ষী নাই, কোনো প্রত্যক্ষদর্শী নাই। লার্নেড কোর্ট সম্পূর্ণ বে-আইনিভাবে এই রায়টা প্রদান করেছেন।’
‘আইনের যে মূল প্রিন্সিপালগুলো আছে, এই প্রিন্সিপালগুলো জাজমেন্ট পাস করাকালীন লার্নেড কোর্ট বিবেচনায় নেন নাই। আমরা মর্মাহত, আমরা ক্ষুব্ধ, আমরা সংক্ষুব্ধ। এর বিরুদ্ধে আমরা উচ্চ আদালতে যাব। আমরাও চাই, আইনের বাউন্ডারিতে ন্যায়বিচার নিশ্চিত হয়ে এ ঘটনার ফারদার তদন্ত করে প্রকৃত সত্য জাতির সামনে উপস্থাপন করা হোক। আসামিরা উচ্চ আদালতে অবশ্যই বেকসুর খালাস পাবে, রাষ্ট্রপক্ষ কোনোভাবেই এই মামলা প্রমাণ করতে পারেন নাই।’
মো. শফিউল আলম আরো বলেন, ‘১৬৪ ধারায় জবানবন্দিকে কখন কন্সিডারেশনে নেওয়া হবে, সিআর-পিসির নির্ধারিত বিধান আছে। একজন আসামির ১৬৪ ধারা জবানবন্দি কন্সিডারেশনে নেওয়ার মতো আইন যে পন্থাগুলো নির্দেশনা করছে, একটা পন্থাও এই কনফেশনাল স্টেটমেন্টে পাওয়া যায় না। মোরওভার প্রত্যেকটা কনফেশনাল স্টেটমেন্টের বক্তব্য ছিল কন্ট্রাডিকটরি। এখানে কোনো ইউনিফর্ম বক্তব্য উপস্থাপিত ছিল না, অতএব এটা যেহেতু ট্রু ও ভলান্টিয়ারি না, সেই জায়গায় আমরা কনফেশনাল স্টেটমেন্টে সম্পর্কে এইটা বেইজ করার মতো আইনগত কোনো হক বা আইনগত কোনো কারণ আছে বলে আমরা মনে করি না।’
গত বছর ১২ ফেব্রুয়ারি বাহুবল উপজেলার ভাদেশ্বর ইউনিয়নের সুন্দ্রাটিকি গ্রামের চার শিশু নিখোঁজ হয়। ১৭ ফেব্রুয়ারি সকালে গ্রামের অদূরে বালিমাটিতে পুঁতে রাখা অবস্থায় তাদের মৃতদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।
এই শিশুরা হলো—সুন্দ্রাটিকি গ্রামের মো. ওয়াহিদ মিয়ার ছেলে সুন্দ্রাটিকি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্র জাকারিয়া আহমেদ শুভ (৮), তার দুই চাচাতো ভাই আবদুল আজিজের ছেলে একই বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র তাজেল মিয়া (১০) ও আবদাল মিয়ার ছেলে একই বিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণির ছাত্র মনির মিয়া (৭) এবং তাদের প্রতিবেশী আবদুল কাদিরের ছেলে সুন্দ্রাটিকি মাদ্রাসার ছাত্র ইসমাঈল হোসেন (১০)।
এ ঘটনায় বাহুবল থানায় নয়জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন মনির মিয়ার বাবা আবদাল মিয়া। শুরুতে এ মামলা দেখভাল পুলিশ করলেও পরে তা তদন্তের জন্য জেলা গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। একই বছরের ২৯ এপ্রিল ডিবি পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুল মুক্তাদির নয়জনের বিরুদ্ধে হবিগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন।
মামলার আসামিরা ছিলেন আবদুল আলী বাগাল, হাবিবুর রহমান আরজু, রুবেল মিয়া, জুয়েল মিয়া, শোয়েব আহমেদ বশির, বিল্লাল মিয়া, উস্তার মিয়া ও বাবুল মিয়া। এ ছাড়া এ মামলার আসামি বাচ্চু মিয়া মামলা চলাকালে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে মারা যান।
অভিযোগপত্র গ্রহণের পর একই বছরের ৭ সেপ্টেম্বরে মামলাটির বিচার শুরু হয়। হবিগঞ্জ আদালতে মামলার ৫৭ সাক্ষীর মধ্যে ৪৫ জনের সাক্ষ্য নেওয়া হয়। ২০১৭ সালের ১৫ মার্চ মামলাটি সিলেট দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করা হয়। এখানে আরো সাতজনের সাক্ষ্য নেওয়া হয়।
আসামিদের মধ্যে চারজন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
সুন্দ্রাটিকি গ্রামের দুই পঞ্চায়েত আবদাল মিয়া তালুকদার ও আবদুল আলী বাগালের মধ্যে পারিবারিক বিরোধের জেরে এই হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয় বলে মামলার তদন্ত ও আসামিদের দেওয়া স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে পুলিশ জানিয়েছে।