আজ শহীদ সিরাজুদ্দীন হোসেনের অন্তর্ধান দিবস
আজ শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনের ৪৭তম অন্তর্ধান দিবস। দৈনিক ইত্তেফাকের তৎকালীন নির্বাহী সম্পাদক সিরাজুদ্দীন হোসেনকে পাকিস্তানি বাহিনী ও আলবদররা ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর তাঁর চামেলীবাগের বাড়ি থেকে অপহরণ করে। এর পর থেকে তাঁর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। শহীদ সিরাজুদ্দীন হোসেন ছিলেন একাত্তরের ডিসেম্বরে হানাদার বাহিনী ও আলবদর পরিচালিত বুদ্ধিজীবী নিধনযজ্ঞের প্রথম শিকার।
অবরুদ্ধ ঢাকা নগরীতে বসে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে তিনি বলিষ্ঠ সাংবাদিকতা করেছেন। ইত্তেফাকের পাতায় তাঁর সাহসিকতাপূর্ণ সম্পাদকীয় ও রিপোর্টের কারণে জামায়াতে ইসলামীর মুখপত্র দৈনিক সংগ্রাম তাঁকে হুমকিও দিয়েছে। ‘ঠগ বাছিতে গা উজাড়’, ‘অধূনা রাজনীতির কয়েকটি অধ্যায়’, ‘এতদিনে’ ইত্যাদি তাঁর প্রকাশিত প্রবন্ধ ও সম্পাদকীয়, যা পাকিস্তান রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎহীনতার ইঙ্গিত দেয়। ১৯৪৭ সালের দেশভাগ নিয়ে লেখা তাঁর বই ‘ইতিহাস কথা কও’ বা ‘লুক ইন টু দ্য মিরর’ আমাদের ইতিহাসের এক উল্লেখযোগ্য সংযোজন।
সিরাজুদ্দীন হোসেন ১৯২৯ সালের ৩ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন। দুই ভাই ও দুই বোনের মধ্যে তিনি তৃতীয়। স্ত্রী নূরজাহান সিরাজী ২০১২ সালে মারা গেছেন। তাঁদের সংসারে আট ছেলে।
যশোর জিলা স্কুল, ঝিকরগাছা স্কুল হয়ে তিনি কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হন। থাকতেন বেকার হোস্টেলে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন তাঁর সহপাঠী। তাঁরা ছিলেন ঘনিষ্ঠ বন্ধু।
পড়াশোনা করার সময় অভাবের কারণে দৈনিক আজাদে শিক্ষানবিশ সহসম্পাদক হিসেবে কাজ করেন। ১৯৪৭ সালে দেশভাগ হলে কলকাতা থেকে ঢাকায় চলে আসেন। চাকরি করেন আজাদেই।
১৯৫২ সালে একুশে ফেব্রুয়ারি থেকে পরবর্তী সময়ে ভাষা আন্দোলন নিয়ে দৈনিক আজাদে তাঁর সাংবাদিকতা ছিল অনবদ্য। সে সময় তিনি আজাদের বার্তা সম্পাদক।
১৯৫৪ সালে পত্রিকার মালিক-সম্পাদক মাওলানা আকরম খাঁর সঙ্গে যুক্তফ্রন্ট বিষয়ে দ্বিমত করায় তাঁকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। সে বছরই তিনি যোগ দেন দৈনিক ইত্তেফাকে, বার্তা সম্পাদক হিসেবে। জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্রের পক্ষে তাঁর সাংবাদিকতা এগিয়ে যেতে থাকে।
সুলেখক। গ্রীম ভ্রাতৃদ্বয়ের রূপকথা নামে তাঁর একটি অনুবাদগ্রন্থ সে সময় অনেকেরই নজর নাড়ে। অনেক অনুবাদ করেছেন।
‘ডেইজ ডিসাইসিভ’ নামে দেশভাগ নিয়ে তাঁর একটি অনবদ্য বই আছে, যার বাংলা ভার্সনের নাম ‘ইতিহাস কথা কও’।
১৯৬৪ সালে যখন ঢাকায় দাঙ্গা হয়, তখন সিরাজুদ্দীন হোসেন সোচ্চার ছিলেন দাঙ্গাবিরোধী আন্দোলনে। মানিক মিয়া, শেখ মুজিবুর রহমান, সিরাজুদ্দীন হোসেন ও আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী মিলে দাঙ্গাবিরোধী প্রচারণা চালিয়েছিলেন। পত্রিকাগুলো শিরোনাম করেছিল ‘পূর্ব পাকিস্তান রুখিয়া দাঁড়াও’।
বার্তা সম্পাদকরা সাধারণত লেখেন না। নিউজের আইডিয়া দেন, সম্পাদনা করেন, পরিকল্পনায় নেতৃত্ব দেন। সিরাজুদ্দীন হোসেন কিন্তু লিখতেনও। কাশ্মীর নিয়ে, বই আমদানি নিয়ে, সোভিয়েত ভ্রমণ নিয়ে তাঁর ধারাবাহিক লেখা ছাপা হয়েছে। দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক সংকট নিয়ে তিনি লিখেছেন। তাঁর কলাম ‘মঞ্চে-নেপথ্যে’ ছিল জনপ্রিয়।
তিনি ছিলেন বাংলায় অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের জনক। তাঁর অসামান্য দক্ষতায় ছেলেধরাদের হাত থেকে শিশুরা মুক্তি পেয়েছিল। এ জন্য তিনি আইপিআই বা ইন্টারন্যাশনাল প্রেস ইনস্টিটিউট থেকে পুরস্কার পেয়েছিলেন।
১৯৬৬ সালে আওয়ামী লীগ ছয় দফা দিলে তার প্রচার ও প্রসারে অসাধারণ পরিশ্রম করেছেন তিনি। তাঁর করা শিরোনামগুলো ছিল অনবদ্য। যেমন—‘সুকুইজ্জা কডে’, ‘চিনিল ক্যামনে’, ‘বিক্ষুব্ধ নগরীর ভয়াল গর্জন : আমি শেখ মুজিব বলছি’, ‘ঠগ বাছিতে গাঁ উজাড়’, অধূনা রাজনীতির কয়েকটি অধ্যায়’ ইত্যাদি।
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব ছিল প্রগাঢ়। রাজনীতির মাঠে বঙ্গবন্ধু যা করতেন, পাঠকের মাঝে তা ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে সিরাজুদ্দীন হোসেন ছিলেন অসাধারণ। ইত্তেফাকের শিরোনাম দেখার জন্য মানুষের কৌতূহল ছিল।
ছয় দফা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ও সত্তরের নির্বাচনের সময় সিরাজুদ্দীন হোসেন সাংবাদিকতায় ইতিহাস সৃষ্টি করে গেছেন।
১৯৭১ সালে তাঁর সাংবাদিকতা বারবার মৌলবাদীদের আক্রমণের শিকার হয়েছে। তারপরও তিনি লিখে গেছেন। সে সময় এ রকম সাহসিকতার সঙ্গে ঢাকায় বসে সাংবাদিকতার উদাহরণ বিরল।
১০ ডিসেম্বর তাঁকে ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসর আলবদররা।
তিনি তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া স্মৃতিপদক ও একুশে পদক পেয়েছেন।
আজ তাঁর অন্তর্ধান দিবসে তাঁর মোহাম্মদপুরের বাড়িতে বাদ মাগরিব মিলাদ মাহফিল ও আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে। খাজুরায় শহীদ সিরাজুদ্দীন হোসেন কলেজে আলোচনা অনুষ্ঠান ও মাগুরার শরুশুনা গ্রামে শহীদের পৈতৃকভিটায় মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে।