‘আমাকে দেখে সপ্ত আশি বছর মনে হয়?’
দেশের সুখ-শান্তি ও সুশাসন ফিরিয়ে আনতে জাতীয় পার্টিকে আরেকবার ভোট দিয়ে ক্ষমতায় আনার আহ্বান জানিয়েছেন দলের চেয়ারম্যান ও সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তিনি বলেছেন, মানুষ সুখের দিন দেখতে চায়। মানুষ পরিবর্তন চায়। আগের এরশাদের আমলে ফিরে যেতে চায়।
আজ শনিবার বিকেলে ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জ উপজেলা ডাকবাংলো মাঠে উপজেলা জাতীয় পার্টি আয়োজিত জনসভায় এসব কথা বলেন এরশাদ।
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান বলেন, ‘এখানে তো কাউন্সিল মিটিং হওয়ার কথা। এটাকে কাউন্সিল মিটিং বলা চলে? লক্ষ মানুষের সমাবেশ। কেন? মানুষ সুখের দিন দেখতে চায়। মানুষ পরিবর্তন চায়। ওই আগের দিনে ফিরে যেতে চায়। সুশাসন ছিল, চিকিৎসা ছিল, ডাক্তার ছিল, প্রশাসন ছিল। ওইটাতে ফিরে যেতে চায়। ওই দিন নাই এখন আর। ওই দিনে ফিরে যেতে চায়। আপনারা তাই চান না? সুশাসন চান না? নিরাপত্তা চান না?
এরশাদ বলেন, ‘একটা প্রশ্ন করি, আমি বলি কেমন আছ? বলে ভালো আছি। ৬০ টাকা চালের দাম। মানুষ ভালো থাকতে পারে? আমাদের এই অঞ্চলে তো কোনো কল-কারখানা নাই। চাকরি-বাকরি নাই। ছেলেমেয়েরা বিএ পাস করে বেকার। দুঃখ করে বলতে হয়, ছেলেরা ফেনসিডিলে আসক্ত হয়েছে। ইয়াবা খায়। কেন? কেন চাকরি নাই? কেন আমার এখানে শিল্প কারখানা নাই? কেন ছেলেমেয়েরা বেকার? এই দেশ মানুষ স্বাধীন করেছিল, স্বাধীনভাবে বাঁচবে। আজ সবাই বেকার। কত পারসেন্ট বেকার, তার কোনো হিসাব নাই। একটা কনস্টেবলের চাকরি নিতে দশ লক্ষ টাকা লাগে। একজন নৈশপ্রহরীতে শুনি পাঁচ লক্ষ টাকা লাগে। শিক্ষকের ১৫-২০ লক্ষ টাকা লাগে। কোথায় যাচ্ছি আমরা? কোথায় বাস করছি আমরা? সভ্য থেকে বিসর্জন দিয়েছি আমরা। ওই সভ্যতাকে ফিরিয়ে আনতে চাই। সুশাসন ফিরিয়ে আনতে চাই। সুখ ফিরিতে আনতে চাই। আপনাদের শান্তি ফিরিয়ে আনতে চাই। তাই আপনাদের এই কথা বলতে এসেছি, আরেকবার সুযোগ দেন, জাতীয় পার্টিতে সুযোগ দেন। আমরা দেখাতে চাই, পরিবর্তন কিভাবে আনতে হয়। আমরা দেখাতে চাই। কেন? মানুষ অতীতের কথা মনে করে। এরশাদ সাহেব যখন ছিল, ভালোই ছিলাম।’
সাবেক রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘আমাকে দেখতে আসে (লোকজন)। দেখলে তো হবে না, ভোট দিয়ে ক্ষমতায় আনতে হবে। সেই প্রতিশ্রুতি আপনারা আমাকে দেন। আবার ক্ষমতায় যদি আসতে পারি, আপনাদের দুঃখ দূর করতে আমি বদ্ধপরিকর।’
জনসভায় প্রবীণ রাজনীতিবিদ ও সাবেক সামরিক শাসক এরশাদ বলেন, ‘আমাকে দেখে সপ্ত আশি (৮৭) বছর মনে হয়? মনে হয়? (ওপাশ থেকে লোকজন বলে ওঠেন, ‘না’) আমার বয়সে লোক চলাফেরা করে? (ওপাশ থেকে লোকজন আবার বলে ওঠেন, ‘না’) আমি কেন চলাফেরা করি? কেন আসছি? কেন বক্তৃতা দিতে আসছি? আবার দেখতে চাই ক্ষমতায়, জাতীয় পার্টিকে। ওই লাঙলকে দেখতে চাই। এজন্য ঘুরে বেড়াই।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ দূত বলেন, ‘আমি যখন রাস্তায় আসতে ছিলাম, আমাদের একজন এমপি টেলিফোন করেছেন। স্যারকে তিনদিন ধরে একের পর… স্যারকে মারি ফালাবেন নাকি।’
‘মরব না ইনশাল্লাহ। আল্লাহ যখন হায়াৎ দিয়েছেন, তখন মরব। কিন্তু দেখে যেতে চাই মরার আগে, আবার সুখ-শান্তি ফিরে আসছে। আবার সুশাসন ফিরে আসছে। আবার মানুষ শান্তিতে আছে। আবার জাতীয় পার্টির লাঙল দেখে মানুষ খুশি হবে, আনন্দে থাকবে।’
জাতীয় পার্টির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য হাফিজ উদ্দিন আহম্মেদের সভাপতিত্বে জনসভায় বক্তব্য দেন দলের মহাসচিব এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী মশিউর রহমান রাঙ্গা, রংপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা প্রমুখ।
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এরশাদ বলেছেন, গত ১ ফেব্রুয়ারি সিলেটে হজরত শাহজালালের (রহ.) মাজারে দোয়া নিয়ে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে আজ ঠাকুরগাঁও থেকে প্রচারণা শুরু হলো।
আজকের জনসভায় এরশাদ আরো বলেন, ‘এখন দেশের অবস্থা কী? মানুষ নিরাপদে ঘুমাতে পারে না। এমন আইন করা হয়েছে, সাংবাদিকরা লিখতে পারে না। কথা বলতে পারে না। আমাদের জবান বন্ধ, মুখ বন্ধ। লেখা বন্ধ, কলম বন্ধ। সব বন্ধ। স্বাধীন দেশ, স্বাধীনভাবে লিখব। স্বাধীনভাবে কথা বলব-সেই সুযোগ বাংলাদেশে নাই। আমাদের সমস্ত সুযোগ হরণ করা হয়েছে। আমাদের সমস্ত স্বাধীনতা হরণ করা হয়েছে। আমরা পরাধীন জাতি হিসেবে আজ পরিগণিত। তাই এই থেকে মুক্ত করতে হবে। মানুষকে মুক্ত করতে হবে। লিখতে দিতে হবে, পড়তে দিতে হবে। স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে।’
সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদ বলেন, ‘আমি যদি ক্ষমতায় থাকতে চাইতাম, সেনাবাহিনীর প্রধান ছিলাম, কারো সাধ্য ছিল না আমাকে ক্ষমতা থেকে সরানোর। আশা করেছিলাম, তাঁরা (বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা) যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সেটা রাখবেন, আমি নির্বাচন করতে পারব। আমার দল নির্বাচন করতে পারবে। তাঁরা তাঁদের কথা রাখেন নাই। ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়ার ছয় দিন পর আমাকে জেলে দেওয়া হয়েছিল। আমার দলের সব নেতাকে জেলে দেওয়া হয়েছিল। আমার স্ত্রীকে জেলে দেওয়া হয়েছিল। ছয় বছরের সন্তান, তাকে জেলে দেওয়া হয়েছিল। সাত বছরের কন্যাকে জেলে দেওয়া হয়েছিল। তাদের লেখাপড়া নষ্ট হয়ে গেছে। জীবন নষ্ট হয়ে গেছে।
ছয় বছর জেলে ছিলাম একটানা। পৃথিবীতে কোনো নেতা একটানা ছয় বছর জেলে থাকেননি, বঙ্গবন্ধু থাকেননি। অবিচার করা হয়েছে। কী নির্যাতন আমার ওপর করা হয়েছে, সে কথা শুনলে আপনারা কষ্ট পাবেন। রোজার দিনে ইফতার করতে পারি নাই। রোজার দিনে গরম খাবার খেতে পারি নাই। সেহরি করতে পারি নাই। কিন্তু মনের বল হারাইনি। আমি জানতাম, আল্লাহ পাক একদিন মুক্ত করবেন। আমি মানুষের ক্ষতি করি নাই। আমার হাতে রক্তের দাগ নাই। আমি মানুষকে উপকার করেছি। বুকে কাছে টেনে নিয়েছি, মুখে আহার তুলে দিয়েছি। জানি, একদিন না একদিন মুক্ত হবোই।’ বলছিলেন এরশাদ।
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান বলেন, ‘আমি অসুস্থ হয়েছিলাম। আমার স্ত্রী অনশন ধর্মঘট করেছিলেন যে তাঁর স্বামীকে হাসপাতালে পাঠান। বেগম জিয়া বলেছিলেন, উনাকে মরতে দাও ওখানে, উনার চিকিৎসার প্রয়োজন নাই। উনি আরেকবার জনসভায় বলেছিলেন, আমি যখন মুক্ত মানুষ, এরশাদ জীবন্ত জেলখানায় যাবে, লাশ হয়ে ফিরে আসবে।
আমি লাশ হয়ে ফিরে আসি নাই। এই জীবন্ত মানুষ হয়ে শত মানুষের সামনে, লক্ষ মানুষের সামনে বক্তৃতা দিচ্ছি। আল্লাহর বিচার আছে। বার বার বলি, আল্লাহর বিচার আছে। আমি আল্লাহতে বিশ্বাস করি। আমার ওপর যে নির্যাতন করা হয়েছিল, তার একশ ভাগের এক ভাগও তাঁর ওপর করা হয় নাই। কিন্তু তিনি আজ ক্ষমতায় নেই। এখন আন্দোলন করেন, কী কী করেন, গাড়ি ভাঙেন। আমরা গাড়ি ভাঙি নাই। আল্লাহর বিচার শুরু হয়েছে। আল্লাহর বিচার আপনি দেখবেন।’
আগামী ৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় রায়ের দিন ধার্য রয়েছে। ওই মামলার প্রধান আসামি বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া।