পদ্মার পাড়জুড়ে কান্না, ৪৮ লাশ উদ্ধার
মানিকগঞ্জের পদ্মায় লঞ্চডুবির ঘটনায় নিহতের সংখ্যা ক্ষণে ক্ষণেই বাড়ছে। লাশ নিয়ে ভিড়ছে একেকটি ট্রলার আর স্বজনদের দিগ্বিদিক ছোটাছুটি। সেই সঙ্গে স্বজনদের কান্নায় ভারী হয়ে উঠেছে পদ্মার দুই তীর।
আজ রোববার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া থেকে ছেড়ে আসা এমভি মোস্তফা নামে একটি লঞ্চ দুর্ঘটনায় পড়ে। মাঝপদ্মায় ‘এমভি নার্গিস’ নামে সারবোঝাই একটি কার্গোর ধাক্কায় লঞ্চটি ডুবে যায়। লঞ্চটি রাজবাড়ীর দৌলতদিয়া যাচ্ছিল। লঞ্চটিতে দেড় শতাধিক যাত্রী ছিল বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন।
এ ঘটনায় সর্বশেষ ৪৮ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এখনো অনেকে নিখোঁজ রয়েছেন।
দৌলতদিয়া এবং পাটুরিয়া দুটি ঘাটেই অপেক্ষা করছেন লঞ্চে নিখোঁজ হওয়া যাত্রীদের স্বজনরা। স্বজনদের এখন একটাই চাওয়া, তাঁরা যেন অন্তত লাশটি পান।
লঞ্চ থেকে বেঁচে ফেরাদের একজন মো. হানিফ এনটিভিকে বলেন, ‘আমরা পাঁচজন ছিলাম। আমি, আমার পরিবার (স্ত্রী), শাশুড়ি আর আমার দুই ছেলেমেয়ে। হঠাৎ লঞ্চের মাঝখানে বালুর না কিসের নৌকা এসে ধাক্কা মারল। মুহূর্তে কাইত হয়ে ডুবে গেল লঞ্চ। আমি আর আমার ছেলে কেবল বের হয়ে আসতে পেরেছি। বাকিদের কোনো খোঁজ পাই নাই।’
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) মুন্সীগঞ্জ অফিসের কর্মচারী মুরাদ হোসেনের স্ত্রী, ছয় বছরের মেয়ে, শাশুড়ি আর শ্যালক ছিলেন ডুবে যাওয়া লঞ্চটিতে। আজ সারা দিন খুঁজে শ্যালকের মৃতদেহ পেয়েছেন মুরাদ। স্ত্রী আর একমাত্র মেয়ে এখনো নিখোঁজ। শাশুড়ি বেঁচে ফিরতে পেরেছেন কেবল। পদ্মার পাড়ে বসে বিলাপ করছিলেন মুরাদ, ‘আমার মেয়েকে ফিরিয়ে দেন আপনারা...’
রাত সাড়ে ১১টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) এ এস এম মাহফুজুল হক নুরুজ্জামান ও নৌপুলিশ ফাঁড়ির (ডিআইজি) মো. মনিরুজ্জামান ঘটনাস্থলে আছেন। লাশ শনাক্তের জন্য পাটুরিয়ায় দুটি কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে।
মানিকগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান জানান, যে সারবোঝাই কার্গো লঞ্চটিকে ধাক্কা দিয়েছিল, এর মাস্টার ও তাঁর দুই সহকর্মীকে আটক করা হয়েছে।
ঘটনাস্থলে পরিদর্শন করেছেন নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান। এ ছাড়া বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান ড. খন্দকার শামসুজোহা, মানিকগঞ্জের জেলা প্রশাসক (ডিসি) রাশিদা ফেরদৌস, পুলিশ সুপার (এসপি) বিধান ত্রিপুরা, রাজবাড়ীর ডিসি মো. রফিকুল ইসলাম খান ও এসপি তাপতুন নাসরীন ঘটনাস্থলে গেছেন।
নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে সাতটি শিশু, ১৪ জন নারী রয়েছেন বলে নিশ্চিত করেছেন মানিকগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান। উদ্ধার করা মৃতদেহগুলোর মধ্যে ছয় মাস বয়সী এক শিশুর পরিচয় জানা গেছে। তার নাম স্মৃতি। সে রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ থানার আদর্শ গ্রামের বাসচালক ফারুক হোসেনের মেয়ে।
পাটুরিয়া ঘাটের ট্রাফিক ইন্সপেক্টর আনোয়ার হোসেন এনটিভি অনলাইনকে জানান, এমভি মোস্তফা নামের লঞ্চটি দেড় শতাধিক যাত্রী নিয়ে পাটুরিয়া থেকে দৌলতদিয়ায় রওনা হয়। পথে একটি কার্গোর ধাক্কায় লঞ্চটি ডুবে যায়। এতে শতাধিক যাত্রী নিখোঁজ আছেন। এ ঘটনায় ৪০ থেকে ৫০ জনকে জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, দুপুর সাড়ে ১২টায় দুজনকে নদী থেকে উদ্ধার করে শিবালয় উপজেলার উথলী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হয়।
হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) কে এম তারেক জানিয়েছেন, দুজনকে হাসপাতালে আনার পর স্মৃতি নামে এক শিশুকে মৃত ঘোষণা করা হয়েছে।
বেলা ২টার দিকে প্রথম পদ্মার বুক থেকে এক নারীর লাশ উদ্ধার করা হয়। এরপর থেকে কিছুক্ষণ পরপর প্রশাসন ও স্থানীয় লোকজন নদী থেকে লাশ উদ্ধার করে পাড়ে আনতে থাকেন। সর্বশেষ রাত ৯টায় আরো ১১টি লাশ উদ্ধারের কথা জানিয়েছে পুলিশ।
লঞ্চডুবির ঘটনায় দৌলতদিয়া ও পাটুরিয়া ঘাটে মানিকগঞ্জ ও রাজবাড়ী জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে দুটি নিয়ন্ত্রণকক্ষ খোলা হয়েছে বলে জানিয়েছেন রাজবাড়ীর জেলা প্রশাসক। এ ছাড়া মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স পাটুরিয়া ঘাটে একটি মেডিকেল সেন্টার খুলেছে ।
ইতোমধ্যেই ঘটনাস্থলে পৌঁছে উদ্ধার তৎপরতা শুরু করেছে উদ্ধারকারী জাহাজ রুস্তম। দুর্ঘটনার পর থেকে স্থানীয় লোকজন, বিআইডব্লিউটিএ ও প্রশাসনের লোকজন ট্রলার নিয়ে নদীতে উদ্ধার অভিযান চালাচ্ছেন।
নিয়ন্ত্রণকক্ষ
ডুবে যাওয়া লঞ্চের নিখোঁজ যাত্রীদের বিষয়ে তথ্য জানাতে রাজবাড়ী জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে দৌলতদিয়ায় নিয়ন্ত্রণকক্ষ খোলা হয়েছে। জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. কাওসারের তত্ত্বাবধানে রোববার দুপুরে এটি খোলা হয়। নিখোঁজদের আত্মীয়স্বজনরা ঘটনাস্থলে এসে কিংবা ০১৭১৮-৮৩০৮৯৫-এই নম্বরে যোগাযোগ করতে পারবেন।
দাফনের জন্য টাকা
মানিকগঞ্জ জেলা প্রশাসনের তরফে দুর্ঘটনায় নিহতদের লাশ দাফনে প্রাথমিকভাবে ২০ হাজার টাকা করে দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া নৌমন্ত্রী নিহতদের প্রত্যেকের পরিবারকে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এক লাখ পাঁচ হাজার টাকা করে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।
তদন্ত কমিটি
লঞ্চডুবির ঘট্না তদন্তে দুটি পৃথক কমিটি গঠন করা হয়েছে। বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যানকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট কমিটির প্রতিবেদন সাতদিনের মধ্যে জমা দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় রোববার বিকেলে এ বিষয়ে একটি আদেশ জারি করে।
এছাড়া সমুদ্র পরিবহন অধিদফতরের নটিক্যাল সার্ভেয়ার ক্যাপ্টেন মো. শাজাহানকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যের আরো একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। আগামী ১৫ দিনের মধ্যে অধিদফতরের মহাপরিচালকের কাছে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে এই কমিটিকে। কমিটির সদস্যরা হলেন, সমুদ্র পরিবহন অধিদফতরের স্পেশাল অফিসার মেরিন সেফটি গোলাম মাঈনউদ্দিন হাসান ও সমুদ্র পরিবহন অধিদফতরের মুখ্য পরিদর্শক মো. শফিকুর রহমান। এ ছাড়া দুর্ঘটনা তদন্তে নৌমন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব নূর উর রহমানের নেতৃত্বে এর আগে গঠিত স্থায়ী তদন্ত কমিটি এ দুর্ঘটনার তদন্ত করবে।
রোববার নৌমন্ত্রীর জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. জাহাঙ্গীর আলম খান স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে নৌসচিব শফিক আলম মেহেদী এনটিভি অনলাইনকে বলেন, সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তর একটি কমিটি গঠন করেছে। এ ছাড়া বিআইডব্লিউটিএর নেতৃত্বেও আরো একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।