খাটে-মেঝেতে ২ শিশুর গলাকাটা লাশ, পাশে ঝুলন্ত মা
হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলার একটি গ্রাম থেকে দুই শিশু ও তাদের মায়ের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। শিশু দুটির লাশ গলাকাটা অবস্থায় ঘরের খাট ও মেঝেতে পড়েছিল। আর মায়ের লাশটি পাশেই ফাঁস দেওয়া অবস্থায় ঝুলছিল বলে পুলিশ জানিয়েছে।
গতকাল শুক্রবার মধ্যরাতে উপজেলার ধর্মঘর ইউনিয়নের নিজনগর গ্রাম থেকে তিনটি লাশ উদ্ধার করা হয় বলে এনটিভি অনলাইনকে নিশ্চিত করেছেন জেলার জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) এস এম রাজু আহমেদ।
নিহতরা হলেন- গ্রামের ব্যবসায়ী আব্দুল মজিদের (৩০) স্ত্রী হাদিছা বেগম (২৪) এবং তাদের আড়াই বছর বয়সী মেয়ে মীম আক্তার ও সাত মাসের ছেলে মোজাহিদ মিয়া। হাদিছা পাশের ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার বুজন্তি ইউনিয়নের শামীম আহমদের মেয়ে।
হাদিছার স্বজনরা দাবি করেছেন, তিনজনকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। ঘটনার পর থেকে আব্দুল মজিদ ও তাঁর পরিবারের লোকজন পলাতক রয়েছে।
দুই শিশু সন্তানকে জবাই করে হত্যার পর হাদিছা বেগম গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করতে পারেন এমন কথাও বলছেন স্থানীয়দের কেউ কেউ।
জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার এস এম রাজু আহমেদ আজ শনিবার সকালে বলেন, লাশ ময়নাতদন্তের জন্য হবিগঞ্জ সদর হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে। এরই মধ্যে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) সদস্যরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন ও তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর পরই এ ব্যাপারে প্রকৃত তথ্য পাওয়া যাবে বলে জানান তিনি।
হাদিছার স্বজনরা জানান, ২০১৪ সালে মজিদের সঙ্গে হাদিছা বেগমের বিয়ে হয়। বিয়ের কিছুদিন পর থেকেই স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বনিবনা হচ্ছিল না। মজিদের উগ্র মেজাজের কারণে সামান্য বিষয়েই ঝগড়াঝাটি লেগেই থাকত। মজিদ প্রায়ই স্ত্রীকে মারধর করতেন।
ধর্মঘর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সামসুল ইসলাম কামাল রাতে এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘শুক্রবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে এলাকার লোকজন আমাকে ফোন করে বলে, এখানে দুটি বাচ্চা আর এক মহিলা মারা গেছে। বাইরে থেকে তারা দেখেছে। আমি সঙ্গে সঙ্গে মেম্বারকে নিয়ে এলাম। অনেক লোকজন। ঘরের বাইরে তালা দেওয়া, পিছনের দিকে খোলা। আরেকটা ঘর দেখলাম খোলা। সেখানে মেয়েটা মেঝেতে পড়ে আছে, বাচ্চাটা খাটে।’
চেয়ারম্যান আরো জানান, তিনি এই পরিবারের লোকজনকে বিশেষ জানেন না। ফলে তাদের সম্পর্কে কোনো কিছু জানেন না। তিনি আসার পর এই বাড়ির লোকজন বিশেষ কাউকে দেখেননি।
হাদিছার ছোট ভাই দ্বীন ইসলাম এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘কয়েকদিন আগে দুলাভাই (মজিদ) আমাকে ফোন দিয়ে বলেন, তোদের বোনেরে নে। না নিলে কাইটা ফেলামু। তোরার কয় লাখ টাকা লাগব। আমি তালইরে (মজিদের বাবা) ফোন দিয়ে বিষয়টি জানাই। তিনি সমাধান করে দেওয়ার আশ্বাস দেন।
গত সোমবারে আমার মা বোনের বাড়িতে আসেন। তখন মায়ের সঙ্গে দুলাভাই বা তাঁর মা-বাবা কোনো কথা বলেননি। পরে আমার মা চলে যান। তিন দিন আগে বাচ্চারে ডাক্তার দেখানোর জন্য বোন আর দুলাভাই মাধবপুর যায়। আমার বাবা বলার পরও দুলাভাই আমাদের বাসায় যায় নাই। বাড়ি চলে আসছে।’
দ্বীন ইসলাম অভিযোগ করে বলেন, ‘আমার দুলাভাই নিজে দুইটা বাচ্চারে কাটছে, আমার বোনরে মারছে। নিজে কাটছে। ও আমারে বলেছে, তোরার বোনরে নে, নাইলে আমি কাইটা ফেলব। আমার বোন সুস্থ ছিল। আমার বোন আমারে অভিযোগ করছে। কথা উল্টা-পাল্টা করলেই মারধর শুরু করত। এই বাড়ির মানুষ সবাই তারে ডরায়। তার ডরে কেউ কথা বলে না। তাঁর উগ্র মেজাজ।’
রাত ৯টায় বাড়ি আসলেও কাউকে পাওয়া যায়নি বলে জানান হাদিছার ভাই।
হাদিছার বাবা শামীম আহমেদ কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘দুইটা মেয়ে আর আমার মেয়েটারে খুন করছে। হায় আল্লাহ, আমার মেয়েটা কী দোষ করছিল। দোষ করলে মেয়েটারে আমার বাড়িত দিত। মাইরা ঘরে তালা দিয়া সবাই বাড়ি থেকে বাইর হয়ে গেছে। আমি এর বিচার চাই। প্রতিশোধ চাই। আমি জানের বদলা জান চাই।’
এই ঘটনার খবর শুনে সেখানে এসেছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বুজন্তি ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মাহবুবুল আলম। তিনি জানান, মজিদ উগ্রমেজাজি। বিয়ের পর থেকে দুই-তিনবার তিনি এ নিয়ে দরবার করেছেন। ছেলের বাড়ির লোকজন মেয়েটাকে আবার বুঝে নিয়ে এসেছে। শ্বশুরবাড়ির সঙ্গেও ছেলে ভালো ব্যবহার করত না।
‘এখানে কেউ তো নাম বলতে চায় না। কিন্তু আমি জানছি, ঘটনাটা ঘটছে দুপুর দেড়টার দিকে। মজিদ দুইটা মেয়েকে ও স্ত্রীকে মেরে ঘরে তালা দিয়ে ধর্মঘরের দিকে চলে গেছে। তদন্ত করলেই সেটা বেরিয়ে আসবে। আমি এই নরপিশাচের বিচার চাই’, যোগ করেন সাবেক এই চেয়ারম্যান।
রাত ৮টার দিকে স্থানীয়রা বিষয়টি জানতে পারে। বাড়ির বাইরে তখন অন্ধকার ছিল। ঘর তালাবদ্ধ। পরিবারের লোকজন ছিল না। বাইরে থেকে তারা ঝুলন্ত লাশ দেখতে পায়। পরে একে একে গ্রামের লোকজন জানতে পারে। গ্রামের লোকজনই পুলিশকে খবর দেয় বলে জানান মাধবপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) চন্দন কুমার চক্রবর্তী।