টাকার ৬০টি মালা পেলেন তিনবারের পরাজিত প্রার্থী
নির্বাচন এলেই অংশগ্রহণ এবং পরে পরাজয়। এটাই ছিল হবিগঞ্জের বাহুবল উপজেলার সৈয়দ খলিলুর রহমানের নিয়তি। আর এজন্য সবার কাছেই তিনি ছিলেন অবহেলিত। তাঁর প্রার্থী হওয়াকে কেউ কোনো গুরুত্ব দিত না। সেই সৈয়দ খলিলুর রহমানের কাছেই পরাজিত হলেন আওয়ামী লীগের দুই প্রভাবশালী নেতা।
বার বার নির্বাচন করে পরাজিত হওয়ার পর এবার অভিনব প্রচারণা করে দুই হেভিওয়েট প্রার্থীকে পরাজিত করে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী খলিলুর।
গত রোববার রাত ১০টায় নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা ও হবিগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) ফজলুল জাহিদ পাভেল বেসরকারিভাবে হবিগঞ্জের আটটি উপজেলা নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা করেন।
ফলাফলে জানা যায়, বাহুবল উপজেলায় ২৩ হাজার ৪৮৩ ভোট পেয়ে ঘোড়া প্রতীক নিয়ে নির্বাচিত হয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী সৈয়দ খলিলুর রহমান। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আবদুল হাই নৌকা প্রতীক নিয়ে পেয়েছেন ১৭ হাজার ৬০৬ ভোট।
নির্বাচনে জেতার পর এখন বাহুবলের জনগণের মুখে মুখে ফিরছে খলিলুর রহমানের কথা। শুধু তাই নয়, তিনি বিজয়ী হওয়ার পর লোকজন তাঁকে টাকার মালা উপহার দিচ্ছেন। এ পর্যন্ত তিনি ৬০টি টাকার মালা উপহার পেয়েছেন। সব মালায় তিনি পেয়েছেন এক লাখ ৯০ হাজার টাকা।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, সৈয়দ খলিলুর রহমান নিজেকে একজন মানবাধিকারকর্মী বলে সব জায়গায় পরিচয় দেন। নির্দিষ্ট কোনো পেশা নেই তাঁর। ১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে হবিগঞ্জ-১ (বাহুবল-নবীগঞ্জ) আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে অংশ নিয়ে পরাজিত হন। এর আগে তিনি ইউপি নির্বাচন করে পরাজিত হন। ২০১৪ সালের উপজেলা নির্বাচনেও অংশ নেন তিনি। সব নির্বাচনেই বিপুল ভোটে পরাজিত হওয়ার পর এবারের উপজেলা নির্বাচনে তিনি অভিনব প্রচারণা শুরু করেন।
ঘোড়া প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করতে গিয়ে খলিলুর নির্বাচনী ইশতেহারে বলেন, আমাকে নির্বাচিত করে বাহুবলের জনগণের জুতার ধুলা-বালি পরিষ্কারের সুযোগ দিন।
পাশাপাশি কাফনের সাদা কাপড় ও ফাঁসির রশি হাতে নিয়ে সবার কাছে ভোট প্রার্থনা করে খলিলুর বলতেন, ‘যদি আমি এবারের নির্বাচনে বিজয়ী হতে না পারি, তাহলে আমি গলায় রশি দিয়ে ফাঁস দেব। নির্বাচনের পরের দিন ১১ মার্চ সকালে সবাই আমার জানাজা পড়বেন।’ তাঁর এই প্রচারণা শুনে অনেকে তাঁকে ধাওয়া করতেন এবং অনেক স্থানে ঢিল ছুড়ে মারতেন।
ব্যক্তিগত জীবনে খলিলুর বহু বিবাহ করেছেন এবং স্ত্রীদের তালাক দিয়েছেন। তিনি এই বলেও প্রচারণা করতেন, ‘আমি নির্বাচনে আসায় আমার স্ত্রী আমাকে ডিভোর্স দিয়ে চলে গেছে, আমি এখন অসহায়।’
নির্বাচনের এক সপ্তাহ আগে বাহুবল উপজেলার স্নানঘাটে এক নির্বাচনী প্রচারণায় পায়ে ব্যথা পান খলিলুর। পরে পায়ে ব্যান্ডেজ লাগিয়ে তিনি প্রচার করেন, আনারসের প্রার্থী আবদুল কাদির চৌধুরীর সমর্থকরা পাথর নিক্ষেপ করে তাঁর পা ভেঙে দিয়েছে।
সৈয়দ খলিলুর রহমানের এই অভিনব প্রচারণায় পুরো বাহুবলে হাস্যরস সৃষ্টি হয়। সেখানে নির্বাচনের মূল লড়াইয়ে ছিলেন সদ্য পদত্যাগী চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল হাই (নৌকা) এবং সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগ সহসভাপতি আবদুল কাদির চৌধুরী (আনারস)।
কিন্তু নির্বাচনের ফলাফলে সব হিসাব-নিকাশ পাল্টে দিয়ে সৈয়দ খলিলুর রহমান সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন। সৈয়দ খলিলুর রহমান পান ২৩ হাজার ৪৮৩ ভোট। আওয়ামী লীগের আবদুল হাই পান ১৭ হাজার ৬০৬ ও আবদুল কাদির চৌধুরী পান ১০ হাজার ৪৫৭ ভোট।
বাহুবল উপজেলা ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হেলাল মিয়া বলেন, ‘সৈয়দ খলিলুর রহমানের অভিনব প্রচারণায় সবাই হাসি ঠাট্টা করতেন। নির্বাচনের ১০ দিন আগে তিনি মিরপুর এলাকায় গেলে লোকজন তাঁকে টমেটো দিয়ে ঢিল ছুড়ে এবং হাসি ঠাট্টা করে বিদায় দেন। কিন্তু সাধারণ মানুষ তাঁর প্রচারণায় বিভ্রান্ত হয়ে ভোট দিলে তিনি বিজয়ী হন।’
নির্বাচনে পরাজিত সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আবদুল কাদির চৌধুরী বলেন, ‘খলিলুর রহমান লোকজনকে কান্নাকাটি করে বলেছেন, আমি চারবার নির্বাচন করে পরাজিত হয়েছি। এবার ভোট না দিলে আমি আত্মহত্যা করব। পরের দিন আমার জানাজায় যাবেন। এ ধরনের কথা বলে তিনি মানুষের সমর্থন পেয়েছেন। সৃষ্টিকর্তা যেহেতু তাঁকে নির্বাচিত করেছেন এ বিষয়ে তাই আমার বলার কিছু নেই।’
এ ব্যাপারে সৈয়দ খলিলুর রহমান বলেন, ‘আমি নির্বাচনের আগে বলেছিলাম, সুযোগ পেলে পাঁচ বছর জনগণের পায়ের ধুলা পরিষ্কার করব। এখনো আমি সেই কথায় অটল আছি। তবে কাফনের কাপড় ও ফাঁসির দড়ি নিয়ে যে কথা বলা হচ্ছে, তা অপপ্রচার। একইভাবে স্ত্রী ডিভোর্স দিয়ে চলে যাওয়ার কথাও সঠিক নয়।’
খলিলুর আরো বলেন, ‘আমার কোনো দল নেই, সংগঠনও নেই। আলুওয়ালা, ধানওয়ালা আর মাছওয়ালাদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক। কোনো নেতার সঙ্গে আমার সম্পর্ক নেই। কোনো সমাবেশে গেলে নেতারা আমাকে দেখলে হিংসা করে। কারণ হ্যাজাকের আলোর সঙ্গে হারিকেনের আলো ম্লান হয়ে যায়।’
পায়ে আঘাতের বিষয়ে নতুন চেয়ারম্যান বলেন, ‘আমি একটি সভা থেকে ফেরার পথে কে বা কারা ঢিল ছুড়ে আমাকে আহত করে। আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ি। তবে কার লোক আঘাত করেছে তা বুঝতে পারিনি।’
এদিকে নির্বাচিত হওয়ার পর চারদিক থেকে লোকজন এসে খলিলুর রহমানকে টাকার মালা উপহার দিচ্ছে। এ পর্যন্ত তিনি ৬০টি টাকার মালা উপহার পেয়েছেন। গুনে দেখা হয়, তিনি মোট পেয়েছেন এক লাখ ৯০ হাজার টাকা।
এ ব্যাপারে সৈয়দ খলিলুর রহমান বলেন, ‘লোকজন খুশি হয়ে আমাকে টাকার মালা দিচ্ছে। সুন্দ্রাটিকি গ্রামে আমাকে চারটি মালা দেওয়া হয়। সেখানে ছিল ৩৮ হাজার টাকা। এর সব নোট ছিল ১০০ আর ৫০০ টাকার। লোকজন আমার বিকাশ নাম্বার নিচ্ছে। আবার লোক পাঠিয়েও টাকা দিচ্ছে। আমি মানুষের এই ভালোবাসার প্রতিদান দিতে চাই। আমি বাহুবলে শিক্ষা, যোগাযোগ ও স্বাস্থ্যসহ সার্বিক উন্নয়নে মনোযোগী হব।’