আদালতে উদ্ধত আচরণ নুসরাত হত্যা মামলার আসামিদের
ফেনীর সোনাগাজীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে পুড়িয়ে হত্যা মামলায় ২১ আসামিকে আজ বৃহস্পতিবার ফেনী করাগার থেকে জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আদালতে হাজির করা হয়। এ সময় তাঁদের বিরুদ্ধে চার্জশিট গঠনে ক্ষুব্ধ হয়ে আদালতেই মামলার এজাহারকারী, আইনজীবী ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে উদ্ধত আচরণ করেন অভিযুক্তরা।
আজ দুপুর ১২টার দিকে ওই আসামিদের ফেনীর জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম জাকির হোসেনের আদালতে হাজির করা হলে তাঁরা বাদী পক্ষকে নানাভাবে হুমকি দিতে থাকেন।
বাদীর আইনজীবী রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘নুসরাত জাহান রাফির হত্যামামলার এজাহারকারী আজ আদালতে উপস্থিত ছিলেন। মামলার সিএস-এ (চার্জশিট) আজ দাখিল হয়েছে। আদালতে চার্জশিটভুক্ত আসামিরাও উপস্থিত ছিলেন। এজহারকারীকে দেখেই আসাসমিরা ক্ষিপ্ত হয়ে, তাঁকে আদালতেই মেরে ফেলবে, এ ধরনের ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করেন।’
‘পরবর্তী সময়ে যেহেতু নুসরাতের আইনজীবী আমি, আমাকে দেখার পরে এমন অবস্থা সৃষ্টি হয় যে, পারলে তারা কাস্টডি ভেঙে আমাকেও সেই মুহূর্তে হত্যা করে। তাৎক্ষণিকভাবে পিবিআইয়ের লোকজন, পুলিশ প্রশাসনের লোকজন সেখানে উপস্থিত হয়ে তাদের কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করেছে’, যোগ করেন রফিকুল ইসলাম।
মামলার বাদী নুসরাতের ভাই মাহমুদুল হক নোমান চার্জশিট গঠন এবং নিজের পরিবারের নিরাপত্তা প্রসঙ্গে বলেন, ‘চার্জশিটে আমার আপত্তি নেই। চার্জশিট যথাযথভাবে হয়েছে। তবে ওসি মোয়াজ্জেম ও সাংবাদিক আবুল হোসেন রিপনকে এই চার্জশিটে আনা উচিত ছিল।’
মাহমুদুল হক নোমান আরো বলেন, ‘আমি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। আমি জোর দাবি জানাচ্ছি যেন আমার বাড়িতে ও আমার জন্য নজরদারি বাড়ানো হয়। কোর্টে আজকে এজলাসের ভিতরে তারা (নুসরাত হত্যা মামলার আসামিরা) যে ধরনের অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করছিল সেটা অত্যন্ত দুঃখজনক ও দুর্ভাগ্যজনক। আমি ও আমার আইনজীবীর সঙ্গে তারা যে ধরনের আচরণ করেছে এটা হতে পারে না।’
আজ ফেনীর জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম জাকির হোসেনের আদালতে নুসরাত হত্যা মামলার ২১ আসামিকে উপস্থিত করা হলে বিচারক মামলাটি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তরের আদেশ দেন। মামলার অভিযোগপত্র গ্রহণসহ অন্যান্য কাজ এখন থেকে ট্রাইব্যুনালেই চলবে।
মামলার বাদীপক্ষের অন্যতম আইনজীবী শাহজাহান সাজু আদেশ-পরবর্তী সময়ে এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘মামলাটি একজন নারীকে পুড়িয়ে হত্যার জন্য দায়ের করা হয়েছে। মামলার তদন্তকারী সংস্থা পিবিআই যে অভিযোগপত্র দিয়েছে, সে অভিযোগপত্র গ্রহণ বা শুনানির এখতিয়ার ম্যাজিস্ট্রেট (হাকিম) কোর্টের নেই। ফলে অভিযোগপত্র জমা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সেটি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন বিশেষ ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়েছে। সেখানেই অভিযোগ গ্রহণের বিষয়ে শুনানি হবে।’
এর আগে সকাল সাড়ে ৯টা থেকে ১০টার মধ্যে মাদ্রাসা অধ্যক্ষ এস এম সিরাজ উদ দৌলা ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা রুহুল আমিনসহ সব আসামিকে আদালতে হাজির করেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। তাঁরা তখন আদালতে হট্টগোল তৈরির চেষ্টা করেন।
ফেনীর সোনাগাজীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে পুড়িয়ে হত্যা মামলায় ২১ আসামিকে আজ বৃহস্পতিবার ফেনী কারাগার থেকে জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আদালতে হাজির করা হয়। ছবি : ফোকাস বাংলা
আদালত চলাকালে আসামি মোকসুদ আলমের পক্ষে তাঁর আইনজীবী গিয়াস উদ্দিন নান্নু জামিনের আবেদন করেন। কিন্তু বিচারক জানিয়ে দেন, জামিন সংক্রান্ত বিষয়াদি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে শুনানি হবে। সেখানে আবেদন করতে হবে।
গতকাল বুধবার দুপুরে ফেনীর জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিমের আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা শাহ আলম এই অভিযোগপত্র জমা দেন। তিনি জানান, অভিযোগপত্রে অভিযুক্তদের সর্বোচ্চ শাস্তি চাওয়া হয়েছে।
অভিযুক্ত অন্য ১৪ আসামি হলেন নুর উদ্দিন (২০), শাহাদাত হোসেন শামীম (২০), কাউন্সিলর মাকসুদ আলম ওরফে মোকসুদ আলম (৫০), সাইফুর রহমান মোহাম্মদ জোবায়ের (২১), জাবেদ হোসেন ওরফে সাখাওয়াত হোসেন জাবেদ (১৯), হাফেজ আবদুল কাদের (২৫), আবছার উদ্দিন (৩৩), কামরুন নাহার মনি (১৯), উম্মে সুলতানা ওরফে পপি ওরফে তুহিন ওরফে শম্পা ওরফে চম্পা (১৯), আবদুর রহিম শরীফ (২০), ইফতেখার উদ্দিন রানা (২২), ইমরান হোসেন ওরফে মামুন (২২), মোহাম্মদ শামীম (২০) ও মহিউদ্দিন শাকিল।
ঘটনার এক মাস ২১ দিনের মাথায় মামলাটির অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। অভিযোগপত্রে মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলাকে হত্যার হুকুমদাতা হিসেবে আসামি করা হয়েছে। নুসরাত হত্যাকাণ্ডে ১৬ জনকে দায়ী করে ৭২২ পৃষ্ঠার অভিযোগপত্র চূড়ান্ত করা হয়েছে। সরাসরি হত্যাকাণ্ডে অংশ না নিলেও হত্যার মূল দায় অধ্যক্ষ সিরাজের।
এর আগে গত মঙ্গলবার রাজধানী ধানমণ্ডিতে পিবিআইর সদর দপ্তরে উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) বনজ কুমার মজুমদার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, নুসরাত হত্যাকাণ্ডে ১৬ জন জড়িত থাকার প্রমাণ পেয়েছেন তাঁরা। এদের মধ্যে ১২ জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ শাস্তির আবেদন জানানো হবে।
ডিআইজি আরো বলেন, এ মামলায় ৯২ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে, যাদের মধ্যে সাতজন এরই মধ্যে আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন।
সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলার বিরুদ্ধে মেয়েকে যৌন হয়রানি করার অভিযোগ আনেন নুসরাতের মা শিরিন আক্তার।
মামলাটি তুলে না নেওয়ায় গত ৬ এপ্রিল পরীক্ষার হল থেকে কৌশলে ডেকে পাশের ভবনের তিনতলার ছাদে নিয়ে সিরাজ উদ দৌলার সহযোগীরা নুসরাতের গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেয়। পাঁচ দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে গত ১০ এপ্রিল রাত সাড়ে ৯টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে মৃত্যুবরণ করেন নুসরাত।