জেলখানা থেকে ষড়যন্ত্রের সুযোগ নেই: অধ্যক্ষ সিরাজের আইনজীবী
নুসরাত জাহান রাফি হত্যা মামলায় অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলার জেলখানা থেকে ষড়যন্ত্র করার কোনো সুযোগ নেই। আমি (সিরাজ) যে জেলখানা থেকে ষড়যন্ত্র করেছি, এমন কোনো বক্তব্য সাক্ষীরা বলেননি। এমনকি কারারক্ষীসহ পাঁচজন সাক্ষী স্বীকার করেছেন, জেলখানা থেকে ষড়যন্ত্র করা যায় না, সুযোগও নেই।
আজ মঙ্গলবার ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মামুনুর রশিদের আদালতে যুক্তিতর্ক শুনানিতে প্রধান আসামি অধ্যক্ষ সিরাজের আইনজীবী ফারুক আহম্মেদ এসব যুক্তিতর্ক তুলে ধরেন।
আইনজীবী শুনানিতে আরো বলেন, ‘আমার (অধ্যক্ষ সিরাজ) বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৪(১) ধারায় যে মামলা করা হয়েছে তা আইনগতভাবে চলে না। কারণ আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনা হয়েছে, তা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের কোন ধারায় বলা নেই। তাই আসামি খালাস পাবে।’
ফারুক আহম্মেদ যুক্তিতর্কে বলেন, এই আদালতে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৪ (১) ও ৩০ ধারায় আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। সে হিসেবে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে এ মামলা চলতে পারে না। কারণ ২০০৭ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন আইন বলবৎ রয়েছে। আদালত সিআরপিসির (ফৌজদারী কার্যবিধি) ২২৭ ধারায় এটা অল্টার (বদল) করতে পারেন।
আইনজীবী আরো বলেন, আদালতে অভিযোগপত্রের দালিলিক সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে, যা আইনে কাভার করে না।
শুনানিতে ফারুক আহম্মেদ বলেন, ৬৩ নম্বর ডিএলআরের (ঢাকা ল রিপোর্ট) ২০৪ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, পুলিশ রিপোর্ট (তদন্ত প্রতিবেদন) গৃহীত হয় না। অর্থাৎ দালিলিক সাক্ষ্য হিসেবে আদালত গ্রহণ করে না।
এ সময় অপর আইনজীবী গিয়াস উদ্দিন নান্নু শুনানি করে বলেন, তাঁর ৪০ বছরের এ পেশায় কোথাও কোনো মামলায় অভিযোগপত্র গৃহীত হতে দেখেননি।
এর পরে আইনজীবী ফারুক আদালতে শুনানিতে বলেন, তদন্তকারী কর্মকর্তা ১৯ পৃষ্ঠার অভিযোগপত্র দেখে দেখে চার দিন যাবৎ আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন, যা সাক্ষ্য আইনের পরিপন্থী। সে সময়ে বিষয়টি আদালতের নজরে আনা হয়েছে। একইভাবে তদন্ত কর্মকর্তা জেরার সময় নথি দেখে দেখে জেরার জবাব দিয়েছেন, তাও সাক্ষ্য আইনের পরিপন্থী। এ বিষয়টিও সে সময় আদালতের নজরে আনা হয়েছে।
ফারুক আহম্মেদ বলেন, পিবিআই প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদারের নির্দেশে ফরমায়েশি অভিযোগপত্র প্রদান করেছেন তদন্তকারী কর্মকর্তা। এর প্রমাণ হচ্ছে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেওয়ার আগের দিন পিবিআই প্রধান বনজ কুমার মজুমদার ঢাকা পিবিআই সদর দপ্তরে সংবাদ সম্মেলন করে নুসরাত হত্যাকাণ্ডে আসামিদের কার কী ভূমিকা তা ব্যাখ্যা করেছেন। সংবাদ সম্মেলনে বনজ বাবুর বডি ল্যাঙ্গুয়েজ প্রকাশ করে অভিযোগপত্রের বিষয়ে তাঁর প্রভাব ছিল, যা দেশবাসী টেলিভিশনে দেখেছে। এ ভিডিওটি আদালতে উপস্থাপন করা হবে।
আইনজীবী ফারুক বলেন, আসামি সিরাজ কারাগার থেকে নুসরাত হত্যার নির্দেশ দিয়েছেন- এ অভিযোগ সত্য নয়। কেননা কারাগারের জেল সুপারসহ পাঁচজন কারাগারের কর্মকর্তা, কারারক্ষীর সাক্ষী ও জেরা হয়েছে। তাদের কেউ কারাগারে বৈঠক করে ষড়যন্ত্র করেছেন, তা বলেনি। কারারক্ষী ছবি রঞ্জন ত্রিপুরা এমন কোনো কথা আদালতে বলেননি যে, দর্শনার্থী যারা কারাগারে সিরাজ উদ দৌলার সাথে দেখা করেছেন। এ ছাড়া কারাগারের দর্শনার্থী রেজিস্ট্রারের একটা জায়গায় নামের পাশে লাল কালির চিহ্ন দেওয়া আছে। এতে কারো নির্দেশনা ছিল, এটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এটাতে প্রমাণ হয় যে, মূল রেজিস্ট্রার আদালতে জমা না দিয়ে নতুনভাবে রেজিস্ট্রার বানিয়ে আদালতে জমা দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে বেনিফিট অব ডাউটের (সন্দেহ) সুবিধা পাবেন আসামিরা।
আইনজীবী ফারুক বলেন, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের যে ধারায় মামলা চলছে তাতে হুকুমের আসামি দেওয়ার বিধান নেই। গত ২৭ মার্চ নুসরাতের শ্লীলতাহানির যে মামলা হয়েছে তার এখনও বিচার হয়নি। সিরাজ উদ দৌলাকে দোষী হিসেবে আদালত সাব্যস্ত করেনি। যদি ওই মামলায় সিরাজ উদ দৌলার সাজা হতো, তা হলে ক্ষোভের কারণে নুসরাতকে হত্যার পরিকল্পনা করতে পারতেন। এটা ভাবার কোনো কারণ নেই।
আইনজীবী ফারুক বলেন, মামলার তদন্ত চলাকালে আলামত উদ্ধার হলে তা আদালতকে জানানো আইনে বাধ্যবাধকতা রয়েছে বা উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত আছে। এ মামলায় তা করা হয়নি। এছাড়া উদ্ধার করা সব আলামত অভিযোগপত্র গ্রহণের সময় আদালকে জানানো হয়েছে। এটাও আইনের পরিপন্থী। ফৌজদারী কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় আসামিদের জবানবন্দিতে অন্য কারো নাম এলে সে প্রসঙ্গে তিনি আদালতকে বলেন, উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত আছে ফৌজদারী কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় কারো নাম এলে হবে না। তা ক্রসম্যাচিং করে দেখতে হবে।
এর পরে বিচারক আজকের মতো যুক্ততর্কের শুনানি মুলতবি করে আগামীকাল বুধ্বার আবারো যুক্তিতর্কের শুনানির জন্য দিন নির্ধারণ করেন।
এর আগে বিচার শুরুর ৪৭ কার্য দিবসে ৮৭ জন সাক্ষী স্বশরীরে আদালতে এসে সাক্ষ্য দেন। মামলার অভিযোগপত্রে ৯২ জন সাক্ষীর নাম দিয়েছেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা।
এদিকে যুক্তিতর্ক শুনানির সময় আজ সকালে ফেনী কারাগার থেকে অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলাসহ ১৫ আসামিকে আদালতে আনা হয়। এ ছাড়া কামরুন নাহার মনি নামের আরেক আসামি অন্তঃসত্ত্বা থাকায় আদালতে হাজির থাকা থেকে অব্যাহতির আদেশ দেন আদালত।
নথি থেকে জানা যায়, গত ৬ এপ্রিল সকালে সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার ছাত্রী নুসরাত আলিমের আরবি প্রথমপত্র পরীক্ষা দিতে মাদ্রাসায় গেলে দুর্বৃত্তরা তাকে ডেকে কৌশলে মাদ্রাসার ছাদে নিয়ে যায়। পরে তার গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। এ ঘটনায় দগ্ধ নুসরাত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১০ এপ্রিল রাতে মারা যায়। পরদিন ১১ এপ্রিল বিকেলে সোনাগাজীতে তাঁর জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।
এ ঘটনায় মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলাকে প্রধান আসামি করে আরো আটজনের নাম উল্লেখ করে সোনাগাজী মডেল থানায় মামলা করে নুসরাতের ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান। পিবিআই ও পুলিশ এ মামলায় ২১ জনকে গ্রেপ্তার করে। এদের মধ্যে হত্যায় সরাসরি জড়িত পাঁচজনসহ ১২ জন আসামি আদালতে হত্যার দায় স্বীকার করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। গত ২৯ মে দুপুরে ফেনীর সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট জাকির হোসেনের আদালতে নুসরাত হত্যা মামলার তদন্ত কমকর্তা পিবিআই পরিদর্শক শাহআলম আদালতে ১৬ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। এ ছাড়া গ্রেপ্তার পাঁচ আসামিকে মামলার দায় থেকে অব্যাহতি দেন আদালত।