প্রত্যন্ত পাহাড়ে বিদ্যার্থীদের স্বপ্নপূরণ
স্বপ্নপূরণ হয়েছে খাগড়াছড়ির দীঘিনালা উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রাম সীমানাপাড়ার শিশু বিদ্যার্থীদের। কিছুদিন আগে একটি জাতীয় দৈনিকে স্কুল না থাকায় শিশুদের নানা দুর্ভোগের কথা প্রকাশের পর দুর্গম এই জনপদে ৩০ লাখ টাকা ব্যয়ে স্কুলটি নির্মাণ করা হয়।
শনিবার বিকেলে খাগড়াছড়ির সংসদ সদস্য কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা ফলক উন্মোচনের মাধ্যমে বিদ্যালয়টির উদ্বোধন করেন। বিদ্যালয়টির নাম রাখা হয়েছে ‘হোসনে আরা মনজুর বিদ্যানিকেতন’। চট্টগ্রামের সাবেক সিটি মেয়র মনজুর আলম ও তাঁর স্ত্রী হোসনে আরা বেগমের নামে প্রতিষ্ঠা করা হলো স্কুলটি। স্কুল নির্মাণের অর্থ ব্যয় হয় মোস্তফা হাকিম ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনের তহবিল থেকে।
১০০ ফুট দৈর্ঘ্য ও ২৫ ফুট প্রস্থের তিনতলা ফাউন্ডেশনের ওপর আপাতত টিনের ছাউনির ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। পাশে নির্মাণ করা হয়েছে দৃষ্টিনন্দন শহীদ মিনার ও খেলার মাঠ।
বিদ্যালয়ের শ্রেণি কার্যক্রম পরিচালনার জন্য নিয়োগ দেওয়া হয়েছে ছয়জন শিক্ষক। এ ছাড়া শিক্ষার্থীদের পোশাকের পাশাপাশি শীতের সোয়েটার এবং প্রতিজনের জন্য কম্বলও দেওয়া হয়েছে। নতুন বিদ্যালয়, নুতন পোশাক আর সঙ্গে নতুন শীতের কাপড় পেয়ে আনন্দে অনেকটা আত্মহারা দুর্গম অঞ্চলের এসব খুদে শিক্ষার্থী।
হোসনে আরা মনজুর বিদ্যানিকেতনের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র রিটন ত্রিপুরা জানায়, সে আগে দীঘিনালার নয়মাইল গুচ্ছগ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করত। তার বাড়ি তৈদুছড়া এলাকায়, যা তার বিদ্যালয় থেকে আট কিলোমিটার দূরে। প্রতিদিন ভোর ৫টায় ঘর থেকে বের হয়ে বিদ্যালয়ে পৌঁছাতে সকাল ৮টা বেজে যেত। আবার বিকেল ৪টায় বিদ্যালয় ছুটির পর বাড়িতে পৌঁছাতে সন্ধ্যা ৭টা বেজে যেত।
এভাবেই প্রতিদিন উঁচু-নিচু পাহাড়ি পথ হেঁটে বিদ্যালয়ে আসত সে। সকালে ঘর থেকে খাবার খেয়ে আবার রাতে বাড়িতে ফিরে খাবার খেতে হতো তার। শুধু রিটন ত্রিপুরাই নয়, তার মতো আরো ২০ শিশু শিক্ষার্থীকে এভাবেই কষ্ট করে হেঁটে বিদ্যালয়ে আসতে হতো প্রতিদিন। অনেক শিশু আবার বিদ্যালয় দূরে হওয়ায় পড়াশোনাই করত না। দীঘিনালার সীমানাপাড়া গ্রামটিতে প্রাথমিক বিদ্যালয় না থাকায় গ্রামের শিক্ষার্থীরা এভাবেই কষ্ট করে এতদিন পড়াশোনা করত।
কথা হয় সীমানাপাড়া গ্রামের পুরোহিত পরানধন ত্রিপুরা (৫৫), ধনরঞ্জন ত্রিপুরা (৬০), পিলানী ত্রিপুরা, যদু মোহন ত্রিপুরা, নিরণ বালা ত্রিপুরা ও সুমন্তী ত্রিপুরার সঙ্গে। এনটিভি অনলাইনের সঙ্গে আলাপকালে তাঁরা জানান, সীমানাপাড়ায় ১০০টির বেশি পরিবার রয়েছে। এর মধ্যে ৪০ পরিবার খাগড়াছড়ি সদর উপজেলার আর ৪০ পরিবার দীঘিনালা উপজেলার। তৈদুছড়া এলাকায় রয়েছে আরো ৭০ পরিবার।
দুই গ্রামের এই দেড়শ পরিবারের শিশুদের পড়াশোনার জন্য কোনো প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিল না। গ্রামের কয়েকজন শিশু ব্র্যাক স্কুলে ও কিছু শিশু নয়মাইল গুচ্ছগ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ অনেক দূরের বিদ্যালয়ে পড়তে যেত। বিদ্যালয় অনেক দূরে হওয়ায় ঝড়-বৃষ্টি হলে শিশুরা বিদ্যালয়ে যেতে পারত না।
সীমানাপাড়ার রহি রঞ্জন ত্রিপুরা জানান, তাঁর দুই মেয়ে। একজন দ্বিতীয় শ্রেণি ও অন্যজন তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে। গ্রামে বিদ্যালয় না থাকায় তাদের খাগড়াছড়ি সদরে ভাড়া বাসায় রেখে খাগড়াপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ালেখা করাচ্ছিলেন। গ্রামে বিদ্যালয়টি হওয়ায় সবার জন্যই খুব উপকার হয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
শনিবার বিকেলে আনুষ্ঠানিকভাবে বিদ্যালয়টির উদ্বোধনের সময় ঢল নামে সাধারণ মানুষের। সকাল থেকে লোকে লোকারণ্য হয়ে যায় দুর্গম এ পাহড়ি জনপদ।
দুপুর ২টায় বিদ্যালয় মাঠে শুরু হয় উদ্বোধন অনুষ্ঠান। মোস্তফা হাকিম ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনের পরিচালক সীতাকুণ্ডের সাংসদ মো. দিদারুল আলমের সভাপতিত্বে উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে সাংসদ কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা বলেন, ‘সাবেক মেয়র মনজুর আলম সীমানাপাড়ার জন্য দেবতা হয়ে আবির্ভাব হয়েছেন। পশ্চাৎপদ সীমানাপাড়ার মানুষের জন্য তাঁর এ অবদান খাগড়াছড়িবাসী আজীবন মনে রাখবে।’
কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা আরো বলেন, ‘সমাজসেবায় কোনো জাতি-ধর্ম-বর্ণ থাকা উচিত নয়। মোস্তফা হাকিম ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনই তারই প্রমাণ। তিনি বলেন, ‘স্কুল হয়েছে বড় কথা নয়, এটাকে ধরে রাখতে হবে। স্কুলের আগামী দিনের সফলতা নির্ভর করবে এলাকাবাসীর ওপর।’ উদ্বোধন অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন উন্নয়নকর্মী বিনোধন ত্রিপুরা।
চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র মো. মনজুর আলম তাঁর বক্তব্যে বলেন, ‘আমি মানুষের জন্য কাজ করি। সমাজসেবা করে তৃপ্তি পাই। মানুষের সেবা করাই প্রকৃত রাজনীতি।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমার চাওয়া-পাওয়ার কিছু নেই। বঞ্চিত মানুষের সেবা করে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে চাই।’
উদ্বোধন অনুষ্ঠানে বিদ্যালয়টির প্রতিষ্ঠাতা হোসনে আরা বেগম, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা) মো. আবদুর রহমান, দীঘিনালা জোন অধিনায়ক লে. কর্নেল মহসীন রেজা, দীঘিনালা উপজেলা চেয়ারম্যান নব কমল চাকমা, দীঘিনালা উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) সামশুল আলম, মোস্তফা হাকিম ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনের পরিচালক ও বিদ্যালয় পরিচালনা পরিষদ সভাপতি নিজামুল আলম, মোস্তফা হাকিম গ্রুপের পরিচালক যথাক্রমে মো. সারোয়ার আলম, মো. সাইফুল আলম, মো. কাউসার রাব্বী, কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজার নিপুর চৌধুরী, মোস্তফা হাকিম বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের প্রিন্সিপাল মো. আলমগীর, ভাইস প্রিন্সিপাল বাদশা আলম, কোম্পানির ইঞ্জিনিয়ার বিপুল জ্যোতি চাকমা, উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি হাজি মো. কাসেম, দীঘিনালা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মিজানুর রহমান, প্রেসক্লাব সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম রাজু, বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা ধীনা ত্রিপুরা প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।