ইউপি নির্বাচনে আ. লীগে মনোনয়ন বাণিজ্য!
নরসিংদীর শিবপুর উপজেলার ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) নির্বাচনে ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকায় আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীক বিক্রি হয়েছে। এই অভিযোগ করেছেন দলটির একাধিক নেতাকর্মী।
তাঁদের অভিযোগ, শিবপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হারুন-অর-রশীদ খান ও সাধারণ সম্পাদক সামসুল আলম রাখিল এই মনোনয়ন বাণিজ্য করেছেন। দল থেকে তাঁদের দুজনকে বহিষ্কারের দাবিতে দলের সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন তাঁরা।urgentPhoto
তবে শিবপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সামসুল আলম রাখিল মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
দ্বিতীয় ধাপে আগামী ৩১ মার্চ শিবপুর উপজেলার সাতটি ইউপিতে নির্বাচন হচ্ছে। এগুলো হলো জয়নগর, বাঘাব, সাধারচর, আয়ুবপুর, দুলালপুর, যোশর ও পুটিয়া। এর মধ্যে জয়নগর, বাঘাব ও সাধারচর ইউপিতে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বঞ্চিত প্রার্থীরা এনটিভি অনলাইনের কাছে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগ করেছেন। ওই তিনটি ইউনিয়নসহ সাতটি ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের নেতাদের মনোনয়ন বাণিজ্যের প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল হয়েছে গতকাল সোমবার। গতকাল ছিল প্রতীক বরাদ্দের দিন।
জয়নগরে ১৬ লাখ টাকায় নৌকা বিক্রি!
জয়নগর ইউনিয়নে মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগ তুলে আওয়ামী লীগের প্রার্থী পরিবর্তনের জন্য দলের সভানেত্রীর কাছে আবেদন করেন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. মোক্তার হোসেন ভূঁইয়া।
ওই আবেদন ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের একাধিক নেতাকর্মী সূত্রে জানা যায়, শিবপুরের জয়নগর ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের প্রার্থী চূড়ান্ত করতে বর্ধিত সভা করা হয়। সেই সভার সিদ্ধান্ত মোতাবেক জয়নগর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি বাদল মিয়া ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. মোক্তার হোসেন ভূঁইয়াকে দলীয় মনোনয়ন দিতে উপজেলা সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের কাছে প্রস্তাব দেওয়া হয়। ওই ইউনিয়নে নির্বাচন করার জন্য আওয়ামী লীগের সাতজন মনোনয়ন কেনেন। পরে তিনজন মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নেন। কিন্তু ১৬ লাখ টাকার বিনিময়ে ইতালির নাগরিক মো. নাদিম সরকারকে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীক দেওয়া হয়। অথচ নাদিম সরকার এক সময় ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
এ ব্যাপারে আবেদনকারী আওয়ামী লীগের নেতা মো. মোক্তার হোসেন ভূঁইয়া এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘আমাদের ওপর অবিচার করা হয়েছে। আমি একজন ত্যাগী নেতা ছিলাম। আমাদের বঞ্চিত করে নব্য একজন যার পরিবারের কেউ ২০ বছরে একদিনও আওয়ামী লীগের কোনো কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করে নাই এবং আজকে যাকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে তাকে কোনোদিন আমরা আওয়ামী লীগের কর্মকাণ্ডে দেখি নাই। টাকার বিনিময়ে এই মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে।’
বাঘাবতে ১৫ লাখ টাকায় নৌকা বিক্রি!
মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগ এনে প্রার্থী হওয়ার জন্য গত ২৮ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরাবর একটি আবেদন করেন বাঘাব ইউপির বর্তমান চেয়ারম্যান ও শিবপুর পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি এ কে বশির আহম্মেদ বাবলু। তিনি তাঁর আবেদনে উল্লেখ করেন, উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক আশরাফুল ইসলাম রিপন নামের একজন অল্পবয়সী অচেনা তরুণকে দলীয় মনোনয়ন দেন। সে আওয়ামী লীগ ও এর কোনো অঙ্গ সংগঠনের সঙ্গে জড়িত নয়। তাঁর সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছি, সে ছাত্রজীবনে আওয়ামী লীগবিরোধী সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিল। সে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হারুন-অর-রশীদ খানের নিকট আত্মীয়।
আবেদনে এ কে বশির আহম্মেদ বাবলু অভিযোগ করেন, সভাপতি হারুন-অর-রশীদ খান দলীয় মনোনয়ন দেওয়ার জন্য তাঁর কাছে ১৫ লাখ টাকা দাবি করেন। তিনি টাকা দিতে অপারগতা প্রকাশ করায় হারুন-অর-রশীদ খান জনগণ ও তৃণমূলের মতামত উপেক্ষা করে তাঁকে চেয়ারম্যান পদের তালিকায় ২ নম্বরে রাখেন।
যোগাযোগ করা হলে এ কে বশির আহম্মেদ এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘আমি এলাকার জনপ্রিয় চেয়ারম্যান। আমি মানুষের কল্যাণে কাজ করেছি। এলাকার জনগণ ও আমার দলের নেতাকর্মীরা আমাকেই পুনরায় চেয়ারম্যান হিসেবে দেখতে চান।’
সাধারচরে ২০ লাখ টাকা ঘুষ
প্রবীণ আওয়ামী লীগের নেতা ও সাধারচর ইউপি নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে মনোনয়ন চেয়েছিলেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আবদুল হাই মিয়া (আবদুল হাই মাস্টার)। তিনি এনটিভি অনলাইনের কাছে অভিযোগ করেন, ‘মনোনয়ন বোর্ড সিদ্ধান্ত নিয়া আমাকে নমিনেশন দেয়। সাবেক এমপি আসাদুল হক ভূঁইয়া মোহন আমাকে বলেন, আমি নমিনেশন পাইছি। এলাকায় গিয়া কাজ করো। আমি এলাকায় গিয়া কাজ করতে আরম্ভ করি। পরবর্তী সময়ে শুনলাম দলের সভাপতি হারুন-অর-রশীদ খান ও সাধারণ সম্পাদক সামসুল আলম রাখিল প্রায় ২০ লাখ টাকা ঘুষ বাণিজ্য নিয়ে আমার নাম পাঠাই নাই।’
আবদুল হাই মাস্টার অভিযোগ করেন, তাঁর পরিবর্তে যাঁকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে তাঁর নাম মাছিউল গনি সরকার স্বপন। তিনি এখনো আওয়ামী লীগের সক্রিয় সদস্য নন।
আবদুল হাই বলেন, ‘একটা ইঙ্গিত দিছিল আমার সাধারচর ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতির কাছে, যে কিছু টাকা-পয়সার কথা কয়। ক্যামনে তাঁর কাছে টাকার কথা খুঁজি। সে তো অনেক সিনিয়র ম্যান। চাইতেও তো লজ্জা করে। দেখো তুমি পারো কি না। আমাকে বলছিল। আমি বলছি, যারা আমার ১০ বছরের জুনিয়র কর্মী, তাদের হাতে আমি টাকা দিয়া নমিনেশন নিয়া আমি চেয়ারম্যান হইতে চাই না।’
‘আজ ৫০ বছর এই দল কইরা আমি দলের একটা নমিনেশন পাই না। এই দলের যে নোংরামি এবং এখানে আওয়ামী লীগের পদবাণিজ্যসহ এই নমিনেশনের বাণিজ্য, লাখ লাখ টাকা তারা আত্মসাৎ করে। এই কলুষিত শিবপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সঙ্গে আমি থাকতে পারি না।’ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলছিলেন প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল হাই মাস্টার।
স্থানীয় আওয়ামী লীগ সূত্রে জানা গেছে, আবদুল হাই মাস্টার ১৯৬৬ সালে ছাত্রলীগে যোগদানের মধ্য দিয়ে রাজনীতি শুরু করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় মুজিব বাহিনীর কমান্ডার ছিলেন এই প্রবীণ নেতা।
শিবপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের দীর্ঘদিনের সহসভাপতি তিনি। বিগত পাঁচটি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের হয়ে নির্বাচন করেন তিনি। কিন্তু বিএনপির প্রয়াত মহাসচিব আবদুল মান্নান ভূঁইয়ার ব্যাপক জনপ্রিয়তা ও প্রভাবের কারণে জিততে পারেননি তিনি। এবার প্রথমবারের মতো দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করার আশা থাকলেও, তাতে গুঁড়েবালি।
অভিযোগ অস্বীকার করে পাল্টা অভিযোগ
মনোনয়ন বাণিজ্যের ব্যাপারে শিবপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হারুন-অর-রশীদ খানের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। এ ব্যাপারে কথা বলেছেন সাধারণ সম্পাদক সামসুল আলম রাখিল। তিনি বলেন, ‘দলের নেতাদের মতামতের ভিত্তিতেই ইউপি নির্বাচনে চেয়ারম্যান প্রার্থী চূড়ান্ত করা হয়েছে। যাঁরা বিগত সময়ে দলের হয়ে কাজ করেননি বা যাঁরা এলাকায় জনপ্রিয় নন, চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায় বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের কারণে দলের ভাবমূর্তি নষ্ট করেছেন, তাঁদের এবার মনোনয়ন দেওয়া হয়নি। তাই যাঁরা মনোনয়ন পাননি তাঁরাই মনোনয়ন বাণিজ্যের কথা বলছেন। অথচ তাঁরা মনোনয়ন পাওয়ার জন্য টাকা নিয়ে পিছে পিছে ঘুরেছেন। তাঁদের কাছ থেকে টাকা নেইনি এবং তাঁদের মনোয়ন দেওয়া হয়নি- এই কারণেই মিথ্যা অভিযোগ করছেন তাঁরা।’
প্রধানমন্ত্রীর কাছে অভিযোগ দেওয়া প্রসঙ্গে সামসুল আলম রাখিল বলেন, ‘তিনি দলের সভানেত্রী, দেশের প্রধানমন্ত্রী, দেশের সব মানুষেরই তাঁর কাছে অভিযোগ করার সুযোগ আছে। যতই অভিযোগ করুক তাতে কাজ হবে না। কারণ দলীয় মনোনয়ন দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো লেনদেন হয়নি।’
রাখিল বলেন, ‘এবার যে সাতজনকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে তাঁদের মধ্যে পাঁচজন বিগত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের হয়ে নির্বাচন করেছেন। যে দুজন বাদ পড়েছেন তাঁদের দলের নেতাকর্মীরা সমর্থন দেন নাই বলেই বাদ পড়েছেন। এর মধ্যে বাঘাব ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান বাবলু কোনো দিন নৌকা প্রতীকের পক্ষে কাজ করেন নাই। এই ধরনের প্রার্থীকে দল মনোনয়ন না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মনোনয়ন বাণিজ্যের যে অভিযোগ তাঁরা করছেন তা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও বানোয়াট।’