কবর থেকে উঠে এলেন ‘জিন্দাবাবা’
তিনদিন পর ‘কবর’ থেকে বের হলেন ‘জিন্দাবাবা’। গত রোববার হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলার নয়াপাথারিয়া গ্রামে কবরে প্রবেশ করেন তিনি। আজ মঙ্গলবার বেলা ২টা ২০ মিনিটে কবরের মাটি সরানোর পর জিতু মিয়া ওরফে জিন্দাবাবা উঁকি দিলে ভক্তরা তাঁকে টেনে কবর থেকে বের করে আনেন।
এ সময় হাজার হাজার দর্শক করতালি দেন। অনেকে মুঠোফোনে দৃশ্যটি ভিডিও করেন। কবর থেকে বের হওয়ার পর জিতু মিয়া কিছু সময় পানিতে ভেসে থাকেন। আজ অবশ্য হাত-পা ছড়িয়ে পানিতে ভাসেন। গত শনিবার তিনি হাত-পা বেঁধে পানিতে ভাসেন।
urgentPhoto
গত রোববার কবরে ঢোকার আগে জিতু মিয়া দাবি করেন, এর আগে ১১ বার ‘কবরে চিল্লা’ (কবরে প্রবেশ) নিয়েছেন তিনি। এটাই তাঁর সর্বশেষ চিল্লা বলে তিনি জানান।
জিতু মিয়া দাবি করেন, গত ৪৫ বছর ধরে ভারতসহ দেশের বিভিন্ন মাজারে ‘সাধনা’ করেছেন তিনি। তিনি হবিগঞ্জ শহরতলির মরহুম আধ্যাত্মিক সাধক দেওয়ান মাহবুব রাজার ভক্ত। স্বপ্নের মাধ্যমে মাহবুব রাজার কাছ থেকে ‘চিল্লায়’ যাওয়ার নির্দেশ পেয়ে তিনি এ রকম ১২টি চিল্লা দিয়েছেন।
কবর থেকে ওঠার পর জিতু মিয়া বলেন, ‘আমার ওপর নির্দেশ ছিল ১২ বার কবরে চিল্লা নেওয়ার। আমি নিয়েছি।’ শ্বাস নিতে কষ্ট হয়েছে কি না সাংবাদিকদের এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন- ‘না।’
তিনদিন কিছু খাননি বলেও দাবি করেন জিতু মিয়া। তিনি বলেন, ‘আল্লাহর নাম নিলে আর কোনো কিছু খাওয়া লাগে না। গিয়ে দেখেন ওখানে প্রস্রাব, পায়খানাও নেই।’
যদিও রোববার কবরে ঢোকার সময় জিতু মিয়ার সঙ্গে ৩০০ গ্রাম আঙুর ও এক বয়াম বিস্কুট দেওয়া হয়েছিল। আজ মঙ্গলবার কবর থেকে ওঠানোর পর বিস্কুটের কোনো বয়াম দেখা যায়নি। শুধু একটি লাল পলিথিন দেখা গেছে। তাতে কোনো কিছু দেখা যায়নি। এ ছাড়া কোনো মল দেখা যায়নি।
আশপাশের লোকজন বিস্কুটের বয়াম ও আঙুরের কথা জিজ্ঞেস করলে জিতু মিয়া কোনো জবাব দেননি।
জিতু মিয়া বলেন, ‘সাধনায় মাটিতে থাকা যায়, পানিতে ভাসা যায়। আগুনেও থাকা যায়।’
কবর থেকে ওঠানোর পর জিতু মিয়াকে জায়গা দানকারী নয়াপাথারিয়া গ্রামের মেহেদী মিয়ার ছেলে জুয়েল মিয়া জানান, জিন্দাবাবাকে জীবন্ত কবর দেওয়ার পর থেকে তাদের মধ্যে একটা ভীতি কাজ করছিল। তাই তাঁরা রীতিমতো কবর পাহারা দিয়েছেন।
এদিকে জিতু মিয়াকে আজ কবর থেকে তোলা হবে এই খবরে আশপাশের বিভিন্ন গ্রামসহ দূর-দূরান্ত থেকে হাজার হাজার নারী-পুরুষ নয়াপাথারিয়া গ্রামে ভিড় জমান। বেলা সোয়া ২টার দিকে যখন কবরের ওপর থেকে মাটি সরানো হচ্ছিল তখন সেখানে আসা লোকজনের মধ্যে নানা ধরনের আলোচনা চলছিল। তিনি জীবিত নাকি মারা গেছেন। মারা গিয়ে থাকলে আশ্রয় দানকারী ও কবর দেওয়ায় জড়িতদের মামলা মোকদ্দমা কিংবা জেল-জরিমানার শিকার হতে হবে। সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে কবরের উপরের মাটি সরানোর সঙ্গে সঙ্গে দেখা যায় জিতু মিয়া উঁকি দিয়েছেন। এ সময় ভক্তরা তাঁকে টেনে কবর থেকে ওপরে উঠিয়ে মাথার ওপর তুলে উল্লাস করেন। এ সময় জিতু মিয়া কিছু সময় পুকুরে ভেসে থাকার ইচ্ছে প্রকাশ করেন। তাঁর ইচ্ছে অনুযায়ী তাঁকে পুকুরে ভাসিয়ে দেওয়া হয়।
তবে আজ জিতু মিয়া পুকুরে সাঁতার না কেটে হাত-পা ছড়িয়ে বেশ কিছু সময় পানিতে ভাসতে থাকেন। পরে ভক্তরা তাঁকে পুকুর থেকে তুলে আনেন। এ সময় তাঁকে কিছুটা দুর্বল দেখাচ্ছিল।
এরপর জিতু মিয়াকে নেওয়া হয় জায়গা দানকারী মেহেদী মিয়ার বাড়িতে। সেখানে তিনি আসা ভক্ত ও সাংবাদিকদের নানা প্রশ্নের জবাব দেন।
স্থানীয় লোকজন ও জিতু মিয়ার পারিবারিক সূত্র জানায়, সুনামগঞ্জ জেলার শাল্লা উপজেলার টেকাই মিয়ার ছেলে জিতু মিয়া প্রায় ২৫ বছর আগে নবীগঞ্জ উপজেলার তিমিরপুর গ্রামে এসে বসবাস শুরু করেন। সেখানে জিতু মিয়া (৮৫) স্ত্রী সন্তানদের রেখে বিভিন্ন মাজারে গিয়ে আধ্যাত্মিক সাধনা করেন। প্রায় ১০ দিন আগে তিনি নয়াপাথারিয়া গ্রামে আসেন। এরপর হাত-পা বেঁধে গ্রামের বিভিন্ন পুকুরে ভেসে থেকে তিনি আধ্যাত্মিক কেরামতি দেখান। পুকুরে তাঁর ভেসে থাকা দেখে গ্রামের লোকজন তাঁকে পীর হিসেবে বিশ্বাস করেন। পরে তিনি ওই গ্রামের মেহেদী মিয়ার পুকুরপাড়ে গিয়ে আস্তানা করার জন্য অবস্থান নেন। প্রথমে মেহেদী মিয়া ও তাঁর পরিবারের লোকজন জায়গা দিতে অনীহা প্রকাশ করেন। পরে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে তাঁকে জায়গা দেন। এরপর পুকুরের মধ্যে দীর্ঘ সময় ভেসে থাকলে মেহেদী মিয়ার পরিবারের লোকজন তাঁকে বিশ্বাস করেন এবং তাঁর প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েন।
জিতু মিয়া তাঁদের জানান, তিনি কবর খুঁড়ে তিন দিনের জন্য চিল্লায় যাবেন। এতে তাঁরা অনেকটা ভয় পেয়ে যান। তাঁর কথা শুনে গ্রামের লোকজনদের দাওয়াত দিয়ে বাড়িতে আনেন মেহেদী মিয়া।
মেহেদী মিয়ার ছেলে জুয়েল মিয়া গ্রামবাসীর সঙ্গে জিতু মিয়ার বিষয়ে কথা বলেন। জিতু মিয়া গ্রামবাসীর উদ্দেশে বলেন, এর আগেও তিনি একাধিকবার কবরে অবস্থান করেছেন। তিনি জানান, গত ৪৫ বছর ধরে ভারতসহ দেশের বিভিন্ন মাজারে মাজারে ‘সাধনা’ করেছেন। তিনি হবিগঞ্জ শহরতলীর মরহুম আধ্যাত্মিক সাধক দেওয়ান মাহবুব রাজার ভক্ত। স্বপ্নের মাধ্যমে মাহবুব রাজার কাছ থেকে ‘চিল্লায়’ যাওয়ার নির্দেশ পেয়েছেন তিনি। ‘চিল্লা’ মানে হচ্ছে কবরে প্রবেশ করা।
জিতু মিয়া বলেন, ‘আমি নিজের ইচ্ছেয় কবরে যাচ্ছি। আমি আগেও গিয়েছি। যদি কোথাও লিখে বলতে হয় আমি তাও রাজি আছি। আমি যদি মারাও যাই তবুও কেউ দায়ী নয়। আমার দায়দায়িত্ব আমার।’ তাঁর কথামতো গত ২৭ মার্চ ৩ দিনের চিল্লায় যাওয়ার দিন ঠিক করা হয়। সিদ্ধান্ত মোতাবেক পুকুরপাড়ে একটি ঘর তৈরি করা হয়। ওই ঘরে মাটি কেটে কবর খোঁড়া হয়। সামনে থেকেই সব তদারকি করেন জিতু মিয়া। কবরের ওপর সমান করে বাঁশও দেওয়া হয়। বাঁশের ওপর পাটি বিছানো হয়। একপর্যায়ে সবাই মিলে জিতু মিয়াকে কবরে ঢুকিয়ে দিয়ে পাটির উপর মাটি দিয়ে ঢেকে দেন স্থানীয় বাসিন্দারা। সঙ্গে দেওয়া হয়েছিল ৩০০ গ্রাম আঙ্গুর আর একটি বিস্কুটের ‘বয়াম’। তাঁর নির্দেশ মোতাবেক আজ মঙ্গলবার তাঁকে কবর থেকে বের করা হয়।
এদিকে ‘জিন্দাবাবা’ ওরফে জিতু মিয়ার আস্তানাকে ঘিরে এরই মধ্যে ছোটখাটো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে শুরু করেছে। আগত লোকজন তাঁর কাছ থেকে পানিপড়া ও রোগমুক্তির জন্য দোয়া চাইছেন।