বিপ্লবী রেবতী বর্মণের ৬৪তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ
শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার আজীবন বিপ্লবী সৈনিক, মার্কসীয় তাত্ত্বিক রেবতী মোহন বর্মণের আজ ৬৪তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৫২ সালের ৬ মে পরলোকগমন করেন তিনি।
৬৪ বছরের ব্যবধানে নতুন প্রজন্মের অনেকের কাছেই অজানা রেবতীর জন্ম-মৃত্যু, জীবনবোধ ও জীবনচর্চার কালোত্তীর্ণ ইতিহাস।
রেবতী মোহন বর্মণ ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের ঐতিহাসিকক্ষণে বর্তমান কিশোরগঞ্জ জেলার ভৈরব উপজেলার শিমূলকান্দি গ্রামে এক শিক্ষিত বিত্তশালী বর্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা হরনাথ বর্মণ ছিলেন একজন প্রখ্যাত আইনজীবী। ইংরেজদের প্রতি আনুগত্যের জন্য তিনি ‘রায়’ উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন।
পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে চতুর্থ রেবতী মোহন বর্তমান ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সরাইল উপজেলার চুন্টা গ্রামের একটি স্কুলে শিক্ষাজীবন শুরু করেন। ছাত্রাবস্থায় ইংরেজদের বিরুদ্ধে অসহযোগ ও স্বদেশি আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ায় তাঁর বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি হয়। এরপর বিভিন্ন স্কুল পরিবর্তনের পর ১৯২২ সালে কিশোরগঞ্জের আজিমুদ্দিন হাই স্কুলের ছাত্র হিসেবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। একই বছর কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হয়ে ১৯২৮ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে এমএ পাস করার পর ‘বেণু’ নামক একটি মাসিক পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব নেন।
রেবতী মোহন বর্মণের রাজনীতি শুরু স্কুলজীবন থেকেই। বিপ্লবী ত্রৈলোক্যনাথ মহারাজের জীবনাদর্শের প্রভাবে তিনি মার্কসীয় তত্ত্বে আকৃষ্ট ঢাকার ‘শ্রী সংঘের’ সদস্য হিসেবে কলকাতা, বাকুড়া ও বীরভূমের বিভিন্ন অঞ্চলে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যান। এরপর ১৯৩০ সালে রাজপুতনায় ব্রিটিশ সরকার তাঁকে গ্রেপ্তার করে। ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত কারাগারে বন্দি থাকেন তিনি।
কারাগারে থাকাকালীন সমাজ বিবর্তনমূলক অসংখ্য গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি রচনা করেন রেবতী। সেসব পাণ্ডুলিপি থেকে পরে ১৭টি বই আকারে প্রকাশ করা হয়, যা বর্তমানে অত্যন্ত মূল্যবান গ্রন্থ হিসেবে বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়ে সারা বিশ্বে পঠিত হচ্ছে।
জনশ্রুতি রয়েছে, কারাগারে থাকাকালীন ব্রিটিশ সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে ওই বিপ্লবী নেতার দেহে কুষ্ঠের জীবাণু অনুপ্রবেশ ঘটায়। এরপর ঘাতকব্যাধি কুষ্ঠে আক্রান্ত হন এবং ১৯৪৯ সালে নিজ জন্মভূমি ভৈরবে চলে আসেন। সে সময় তিনি কুষ্ঠ রোগাক্রান্ত পচন ধরা আঙুলে রশি দিয়ে হাতের সঙ্গে কলম বেঁধে রচনা করেন তাঁর অমর গ্রন্থ ‘সমাজ ও সভ্যতার ক্রমবিকাশ’।
১৯৩৮ সালে পরিবারের পক্ষ থেকে এলাকার শিশুদের শিক্ষিত করে তুলতে স্থাপন করা হয় একটি প্রাইমারি স্কুল, যা পরবর্তী সময়ে শিমূলকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় হিসেবে পরিগণিত হয়। কুষ্ঠরোগ আক্রান্ত রেবতী মোহন ভৈরবে আসার পর শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে ঘরের বেড়ার (পার্টিশনের) আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে রেখে অপর পাশ থেকে ছাত্র পড়াতেন বলে তাঁর শিক্ষার্থীরা জানান।
রেবতী মোহনের সেই দিনের শিশু শিক্ষার্থী, আজকের বয়োবৃদ্ধ হোমিও চিকিৎসক আবদুল গনি জানান, শিক্ষক হিসেবে তিনি (রেবতী মোহন) ছিলেন অত্যন্ত উঁচুমানের পাণ্ডিত্যের অধিকারী। সহজ ও সাবলীল ভাষায় তিনি শিক্ষা দিতেন।
১৯৪৭ সালে সাম্প্রদায়িক চেতনায় বিভক্ত ভারতবর্ষের পাকিস্তান অংশে অসাম্প্রদায়িক সমাজ সংস্কারক রেবতীর বিরুদ্ধে ধর্মান্ধগোষ্ঠী এলাকাবাসীকে ক্ষেপিয়ে তোলে। তাঁর বিরুদ্ধে নেতিবাচক কথা-বার্তা শুরু হলে ১৯৫০ সালে প্রিয় জন্মভূমি ভৈরব ছেঁড়ে ভারতের আগরতলায় চলে যেতে বাধ্য হন। সেখানে ১৯৫২ সালের ৬ মে আত্মীয়স্বজন, পরিবার-পরিজনবিহীন একান্ত নিভৃতে এক খড়ের চালায় ৪৭ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন কালোত্তীর্ণ এ মহাপুরুষ।
ভৈরবের শিমূলকান্দি গ্রামের যে বাড়িটিতে রেবতী হেঁটে বেড়াতেন আপনমনে, পরিকল্পনা করতেন শাসক ও শোষকগোষ্ঠী ইংরেজদের তাড়াতে কিংবা সমাজ বিবর্তনের নতুন কোনো সূত্র লিখতেন কাগজের সাদা জমিনে। স্বপ্ন দেখতেন শিক্ষার আলোয় আলোকিত হয়ে উঠছে এলাকার অনগ্রসর সমাজ-সে বাড়িতে আজ তাঁর কোনো স্মৃতিই অবশিষ্ট নেই। তবে খুব বেশি দেরি হয়ে গেলেও নতুন প্রজন্ম কালোত্তীর্ণ রেবতী মোহন বমর্ণকে নিয়ে ভাবতে শুরু করেছে। সে ভাবনার ফল হিসেবে প্রগতি কেন্দ্র ১৯৯৯ সালে রেবতী মোহন স্মারকগ্রন্থ ‘কালোত্তীর্ণ রেবতী মোহন বমর্ণ’ প্রকাশ করে। অপরদিকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে শিমূলকান্দি হাই স্কুলের সামনে একটি স্মৃতিফলক নির্মিত হয়েছে।