মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলামের শাহাদাতবার্ষিকী সোমবার
বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম বীর বিক্রমের ৪৫তম শাহাদাতবার্ষিকী সোমবার। ১৯৭১ সালের ৮ আগস্ট সুনামগঞ্জের গুরুত্বপূর্ণ নদীবন্দর সাচনা পাকিস্তানি হানাদারদের হাত থেকে দখল মুক্ত করার লক্ষ্যে পরিচালিত রক্তক্ষয়ী সম্মুখ যুদ্ধে তিনি শাহাদাত বরণ করেন। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে অন্যতম স্মরণীয় এ যুদ্ধে তিনি কমান্ডার হিসেবে নেতৃত্ব দেন।
ভয়াবহ এই যুদ্ধে মুক্তিসেনাদের প্রবল আক্রমণে ৩৬ জন পাকিস্তানি নিহত হয়। একপর্যায়ে পাকিস্তানি সেনারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়লে সাচনা বন্দর শক্রমুক্ত হয়। কিন্তু যুদ্ধ শেষে পলায়নরত পাকিস্তানি সেনাদের কাভারিং ফায়ারের একটি বুলেট সিরাজুল ইসলামের কপালে বিদ্ধ হলে তিনি গুরুতর আহত হন। সঙ্গে সঙ্গে মিত্র বাহিনীর হেলিকপ্টারে করে ভারতে নেওয়ার পথে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর লাশ নিয়ে হেলিকপ্টার ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে টেকেরঘাটে অবতরণ করে। সেখানে খাসিয়া পাহাড়ের পাদদেশে পূর্ণ সামরিক মর্যাদায় তাঁর দাফন সম্পন্ন হয়।
মৃত্যুর মাত্র সাতদিন আগে সিরাজুল ইসলাম যুদ্ধক্ষেত্র থেকে তাঁর বাবাকে একটি চিঠি লেখেন। সেই চিঠির প্রতিটি লাইনে ফুটে উঠেছে মাতৃভূমির প্রতি তাঁর নিখাঁদ ভালোবাসা। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুক্তিযুদ্ধের কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের জন্য সরকার শহীদ সিরাজকে বীর বিক্রম খেতাব প্রদান করে।
শহীদ সিরাজুল ইসলাম ১৯৫২ সালে কিশোরগঞ্জের ইটনা উপজেলার ছিলনী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালে কিশোরগঞ্জ গুরুদয়াল কলেজের বিএ প্রথম বর্ষের ছাত্র ছিলেন তিনি। যুদ্ধের শুরুতেই তিনি মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেন এবং ভারতের আসামে ইকোয়ান ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। প্রশিক্ষণ শেষে দেশে ফিরে তিনি ৫ নম্বর সেক্টরের অধীনে সাব-সেক্টর কমান্ডার হিসেবে সাচনা যুদ্ধ ছাড়াও সিলেট ও সুনামগঞ্জ এলাকায় আরো অনেক যুদ্ধে বীরত্বের সঙ্গে অংশ নেন।
মরহুম মকতুল হোসেন ও গফুরুন্নেছার একমাত্র ছেলে শহীদ সিরাজ ছিলেন দুই বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে সবার বড়। শহীদ সিরাজ ছিলেন অবিবাহিত।
স্বাধীনতা পরবর্তী শহীদ সিরাজের পরিবারের কাহিনী অত্যন্ত করুণ। পুত্র শোকে তাঁর বাবা ১৯৭৩ সালে ইন্তেকাল করেন। একমাত্র পুত্রকে হারিয়ে তাঁর মা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন এবং দীর্ঘদিন অপ্রকৃতিস্থ থাকার পর রোগে-শোকে ১৯৮৮ সালে তিনিও মারা যান। প্রতিকূল অবস্থার কারণে শহীদ সিরাজের দুই বোনকে সুশিক্ষিত করে তোলা সম্ভব হয়নি। খুব সাধারণ ঘরে তাদের বিয়ে হয়। বড় বোন মনোয়ারা খাতুন কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ উপজেলার নিয়ামতপুরে ঘর-সংসার করছেন। ছোট বোন আনোয়ারা খাতুন তিন ছেলে ও দুই মেয়ে ১৯৯২ সালে মৃত্যুবরণ করেন।
স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত সাচনা নদীবন্দরকে সিরাজ নগর হিসেবে নামকরণের ঘোষণা দেন। কিন্তু প্রয়োজনীয় উদ্যোগের অভাবে নামকরণ কার্যকর হয়নি। তাঁর স্মরণে জেলা সদরে গুরুদয়াল সরকারি কলেজ প্রাঙ্গণে একটি ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়েছে এবং নিজ বাড়ি ইটনা উপজেলা সদরে ধনু নদীর ওপর একটি সেতুর নামকরণ করা হয়েছে। কিন্তু সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার টেকেরঘাটে অবস্থিত শহীদ সিরাজের কবর অযত্ন-অবহেলায় জরাজীর্ণ হয়ে পড়ায় যেকোনো সময় নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
শহীদ সিরাজের শাহাদাতবার্ষিকী পালন উপলক্ষে কিশোরগঞ্জের ইটনা সমিতি ও শহীদ সিরাজুল ইসলাম বীর বিক্রম স্মৃতি সংসদ বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।
সাচনা নদী বন্দরের নাম সিরাজনগর কার্যকর ও সুনামগঞ্জের টেকেরঘাটে শহীদ সিরাজের জরাজীর্ণ কবর সংস্কারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক, জেলা পরিষদের প্রশাসক, মুক্তিযুদ্ধা সংসদ ও রাজনৈতিক নেতারাসহ দেশপ্রেমিক জনগণের আহ্বান জানিয়েছেন কিশোরগঞ্জস্থ ইটনা সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট আব্দুল মালেক ভূঁইয়া এবং শহীদ সিরাজুল ইসলাম বীর বিক্রম স্মৃতি সংসদের সভাপতি অ্যাডভোকেট মারুফ আহমেদ।