দিনে লোডশেডিং, সন্ধ্যার পর বরফকল বন্ধের নির্দেশ!
এমনিতেই বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণে অধিকাংশ সময় বন্ধ রাখতে হয় উপকূলের বরফকলগুলো। তার ওপর দৈনিক পাঁচ ঘণ্টা বরফকল বন্ধ রাখতে কলগুলোকে চিঠি দিয়েছে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি। আর এ কারণে বরফের ভয়াবহ সংকটে পড়েছেন দক্ষিণাঞ্চলের বৃহৎ মোকাম পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার আলীপুর ও মহিপুরের মৎস্যজীবীরা।
ফলে ভরা মৌসুমে প্রচুর ইলিশ আহরণ করলেও আহরিত ইলিশের গুণগত মান বজায় রাখতে পারছেন না তাঁরা।
এর আগে কয়েক বছর সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলের নির্দেশনায় ইলিশের মৌসুমে মহিপুর-আলীপুরের জন্য বাড়তি বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। সেখানে এ বছর বিদ্যুৎ বিভ্রাটের পাশাপাশি উল্টো ভরা মৌসুমে সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত বরফকল (শিল্পপ্রতিষ্ঠান) বন্ধ রাখতে চিঠি দেয় কলাপাড়া পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি। ফলে এ পেশা সংশ্লিষ্ট অন্তত ৬০ হাজার পরিবার এখন চরম বিপাকে পড়েছে।
দীর্ঘ প্রায় এক যুগ পর এ বছর প্রচুর ইলিশ ধরা পড়ছে। ফলে মৎস্যজীবীরা দীর্ঘদিনের লোকসান পুষিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি জেলেরাও তাদের দাদনের বোঝা অনেকটা হালকা করার সুযোগ পেয়েছে। কিন্তু পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি টানা বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে না পাড়ায় মৎস্যজীবীরা বরফ সংকটে পড়েছেন।
এ বছর অ্যামোনিয়া গ্যাস ও লবণের মূল্য দ্বিগুণ বৃদ্ধি পাওয়ায় বরফের দাম বেড়ে গেছে। এর সঙ্গে বিদ্যুৎ বিভ্রাটে আরো বিপাকে হাজার হাজার মৎস্যজীবী। বিষয়টি সমাধানে পল্লী বিদ্যুৎ কলাপাড়ার কর্মকর্তাদের দ্বারস্থ হয়েছেন আড়ত মালিকসহ মৎস্যজীবীরা। কিন্তু তাঁরা নির্বিকার।
এফবি মা-বাবার দোয়া ট্রলারের রতন মাঝি জানান, প্রয়োজনীয় বরফ না পেয়ে দুই পাড়ে এখন অপেক্ষা করছে শত শত ট্রলার।
একই মন্তব্য মাঝি শেখ ফরিদের। অবস্থা এমন হয়েছে যে ১২০ টাকা ক্যান দরের বরফ ২০০ টাকায়ও কিনতে পারছে না উৎপাদন সংকটের কারণে। কেউ খোল বরফ নিয়ে ছুটছেন পুরো সলিড বরফের দাম দিয়ে।
জেলেদের অভিযোগ, এক ক্যান সলিড বরফে অন্তত দেড় মণ বরফ হয়। আর খোল বরফে হয় সর্বোচ্চ এক মণ। বরফকল মালিকরা জানান, এক ক্যান সলিড বরফ উৎপাদনে টানা ৩০ থেকে ৩৬ ঘণ্টা বিদ্যুৎ সরবরাহের প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু টানা বিদ্যুৎ পাওয়া যায় না অধিকাংশ সময়।
মে থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত হচ্ছে বরফ উৎপাদনের মৌসুম। এ সময় প্রচুর ইলিশ ধরা পড়ে। স্থানীয় বরফ মিলগুলো চাহিদানুযায়ী বরফ উৎপাদন করতে পারছে না।
আড়তমালিক সমিতির নেতা নিমাই চন্দ্র দাস জানান, বরফকল বন্ধের চিঠি দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া দিনের মধ্যে বহু দফায় লোডশেডিং হওয়ায় এখন আহরিত ইলিশের পচন ঠেকাতে বরিশাল কিংবা খুলনা থেকে বরফ সংগ্রহ করে জেলেদের নদীতে পাঠাতে হচ্ছে।
এদিকে সময়মতো বরফ দিতে না পারায় ইলিশ ঠিকমতো রক্ষণাবেক্ষণ করতে না পারায় ইলিশের মান নষ্ট হয়ে গেছে বলে অভিযোগ মাছ ব্যবসায়ী মজনু গাজীর। আহরিত শত শত মণ ইলিশ নষ্টের আশঙ্কা তাঁর।
বরফকল মালিকরা জানান, গত মৌসুমে বরফ উৎপাদনের জন্য এক মণ লবণ কিনেছেন ৫০০ টাকায়, এখন কিনতে খরচ হচ্ছে এক হাজার ২০০ থেকে এক হাজার ৪০০ টাকা। এ ছাড়া প্রতি সিলিন্ডার অ্যামোনিয়া গ্যাস কিনতে আগে খরচ হতো ছয় থেকে সাত হাজার টাকা। এ মৌসুমের শুরুতে তা কিনতে হয়েছে ৯ থেকে ১৪ হাজার টাকায়। এ ছাড়া প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ সাত টাকার বেশি মূল্যে কিনে বরফ উৎপাদন করতে হচ্ছে। এতে প্রতি ক্যান বরফ উৎপাদনে খরচ হচ্ছে ৭০ থেকে ৮০ টাকা। এরপর বিদ্যুৎ বিভাগ সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত বরফকল বন্ধ রাখতে বলেছে। যে কারণে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে।
বরফকল মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এ মুহূর্তে যে পরিমাণ ট্রলার বরফের জন্য প্রতিদিন ঘাটে অপেক্ষা করছে ওই পরিমাণ বরফ সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না। এ জন্য বরিশাল-খুলনা থেকে বরফ আমদানি করে তাঁরা বিক্রি করছেন। ফলে বরফের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে।
কলাপাড়া পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির উপমহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) সুদেব কুমার সরকার জানান, মহিপুর-আলীপুর ও কুয়াকাটায় শতভাগ বিদ্যুৎ সরবরাহের চেষ্টা রয়েছে তাদের। কিন্তু মাঝেমধ্যে সবগুলো বরফকল একত্রে চালাতে গিয়ে তখন লোড ক্রাইসিস হয়ে যায়। তখন কখনো দুই এক ঘণ্টা লোডশেড করতে হয়। তারপরও বরফকল মালিকদের জন্য সবচেয়ে বেশি সময় বিদ্যুৎ সরবরাহ করার চেষ্টা রয়েছে তাঁদের।